জগন্নাথের প্রচলিত রূপটি হয়তো আর্যদের বিশেষ পছন্দ ছিলোনা। তাই একটি গল্পের অবতারণা করতে হয় তাঁদের। ভেসে আসা নিমকাঠটি থেকে দেবমূর্তির রূপ দেবার জন্য পিতামহ ব্রহ্মা’র ইচ্ছায় স্বয়ং বিষ্ণু এক ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে অবতীর্ণ হ’ন। তাঁর শর্ত ছিলো যতোদিন না কার্যসমাধা হবে, কেউ তাঁকে বিরক্ত করবে না। বেশ কিছুদিন পরেও যখন কাজটি সম্পূর্ণ হলোনা, তখন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন পত্নীর অনুরোধে মন্দির কক্ষের দরজা বলপূর্বক খুলে দেখেন সেই ব্রাহ্মণ কোথাও নেই আর কিছু ‘অর্ধসমাপ্ত’ দারুমূর্তি রাখা আছে। আর্য অহমের একটি প্রকাশ এখানে পাওয়া যাবে। অনার্যদের কল্পিত জগন্নাথবিগ্রহ তাঁদের বিচারে ‘অর্ধসমাপ্ত’। কারণ সেটি নান্দনিক বিচারে আর্য উৎকর্ষের নির্দিষ্ট স্তর স্পর্শ করেনা। আসলে এখন বিস্ময় লাগে, কীভাবে জগন্নাথবিগ্রহ স্তরের একটি সার্থক পরাবাস্তব শিল্পবস্তু সেই পুরাকালের শিল্পীদের ধ্যানে রূপ পেয়েছিলো। নিজেদের ধ্যানধারণা থেকে বহুক্ষেত্রে ভিন্নতা থাকলেও আর্য ব্রাহ্মণ্যবাদ বাধ্য হয়েছিলো জগন্নাথদেবকে নিজেদের বিষ্ণুকেন্দ্রিক প্যান্থিয়নে সসম্মানে স্থান করে দিতে। তার মূল কারণ দেশের এই প্রান্তে জগন্নাথের প্রশ্নহীন বিপুল লোকপ্রিয়তা। যেভাবে পূর্বভারতে প্রচলিত নানা শিব ও শক্তিভিত্তিক দেবদেবীদের জন্য ব্রাহ্মণ্যধর্মকে দরজা খুলে দিতে হয়েছিলো, সেভাবেই জগন্নাথও বিষ্ণুদেবতার সমার্থক হয়ে আর্য-অনার্য নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের পরিত্রাতা হয়ে ওঠেন।
এখনও জগন্নাথদেবের মূলপূজারী অব্রাহ্মণ, সাবর্ণ হিন্দুগোষ্ঠীর বাইরের মানুষ। সত্যিকথা বলতে কি সারা দেশে অন্ত্যজ, নিম্নবর্গীয় মানুষজনদের জন্য জগন্নাথমন্দিরের মতো এই পর্যায়ে ‘শাস্ত্র’সম্মত প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষা আর কোথাও দেখিনি। কবি যখন বলেন, ” জগন্নাথের জাত যদি নাই, তোদের কেন জাতের বালাই…”, একটি আর্ষ সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।
এহেন একজন ইতরের দেবতা, স্রেফ লোকপ্রিয়তার জোরে সর্বগ্রাসী ব্রাহ্মণ্য আনুকূল্যকে জিতে নিয়ে জাতিগোষ্ঠী নির্বিশেষে সমগ্র ‘জগতের নাথ’। হয়তো একটু অন্য রকমভাবে ভাবার দাবি তিনি রাখতেই পারেন। ব্রাহ্মণ্য অধ্যাত্মজগতে সম্ভবত এটিই একমাত্র সাম্রাজ্য যেখানে মুখ্য পূজারী দৈতপতির দল অনার্য শবরদের বংশধর। জগন্নাথ সৃজনের স্বীকৃতি হিসেবে অনার্যদের রাণী গুন্ডিচা, যিনি লোককথা অনুসারে একাধারে রাজা ‘ইন্দ্রদ্যুম্নে’র মহীষী ও জগন্নাথ রূপকল্পের মুখ্য ধাত্রী, তাঁর গৃহে জগন্নাথকে বছরে মাত্র সাতদিনের জন্য বিশ্রাম নিতে পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হলো। সঙ্গে এলো কৃষিভিত্তিক কৌমসমাজের রথযাত্রার আয়োজন। যেহেতু ‘ভগবানে’র মা কোনও মানবী হতে পারেন না, তাই তাঁকে মায়ের ভগ্নী মাসিমা হিসেবে সম্বোধন করা হয়। জগন্নাথ ধারণাকে ভ্রূণ থেকে সাবালকত্ব পর্যন্ত প্রতিপালন করার স্বীকৃতি হিসেবে এই সম্মান সমস্ত কৌম অনার্য মায়েদের গরিমান্বিত করে। ‘গুন্ডিচা’ শব্দটি মনে হয় দ্রাবিড়িয় ভাষা থেকে এসেছে। বীরত্বের সঙ্গে শব্দটির যোগাযোগ আছে। তিনি একজন অনার্য গ্রামদেবী। লোককথায় ইন্দ্রদ্যুম্নের রাণী । এভাবেই গুন্ডিচা’কে নিয়ে আর্য বৈষ্ণব দুনিয়াকে আপোস করতে হয়েছিলো। এই নারী বা দেবী জগন্নাথের কাছে যাননা, জগন্নাথ তাঁর কাছে আসেন রথে চড়ে। যাবতীয় ঐশী অহংকারকে তাকে রেখে।
অনেকেই বিশ্বাস করেন জগন্নাথ আরাধনার ঐতিহ্য বৌদ্ধ মহাযানী পূজার্চনার বিবর্তন হিসেবে এসেছে। আগে উল্লেখ করেছি, বেশ কিছু পণ্ডিত জগন্নাথের নবকলেবরে ‘ব্রহ্মস্থাপন’কে বৌদ্ধস্তূপের অন্দরে বুদ্ধের দেহাবশেষ রক্ষণ করার সঙ্গে তুলনা করেছেন। চতুর্থশতকে ফাহিয়েন কলিঙ্গবাসকালে দন্তপুর নামক স্থানে বুদ্ধের দেহাবশেষ নিয়ে শোভাযাত্রা দেখেছিলেন। বর্তমানে এই আচারটি শ্রীলংকার ক্যাণ্ডিতে অনুষ্ঠিত হয়। বেশ কয়েকজন প্রসিদ্ধ পণ্ডিত যেমন উইলসন, ফার্গুসন বা কানিংহামসাহেব জগন্নাথ, বলভদ্র এবং সুভদ্রাকে বৌদ্ধ ত্রিরত্ন বুদ্ধ, ধর্ম ও সঙ্ঘের সমতুল বলে মতপ্রকাশ করেছিলেন।
বৈদিকধর্মে দেবালয় নির্মাণের কোনও প্রথা ছিলোনা। যাবতীয় জ্ঞান ও ধর্মচর্চার কেন্দ্র ছিলো মুনিঋষিদের আশ্রম বা অরণ্যকুটীরগুলি। বৌদ্ধধর্ম ও লোকাচারে উপাসনার কেন্দ্র হিসেবে স্তূপ বা চৈত্যের নির্মাণ প্রথম শুরু হয়। পরবর্তীকালে এই পথ অনুসরণ করে তন্ত্রমতে শিব বা শক্তির নামে দেবমন্দির তৈরি হতে শুরু করে। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরকে অনেকেই তন্ত্রমতে নির্মিত বলে প্রমাণ করতে চেয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য রত্নসিংহাসনের ভৈরব বা শ্রীচক্রের উপস্থিতি ছাড়াও মন্দিরের গায়ে মিথুনমূর্তি বা প্রচলিত দেবদাসীপ্রথা তন্ত্রচর্চার সঙ্গে সম্বন্ধিত লোকাচার। জগন্নাথের রথযাত্রাও বস্তুত অনার্যসমাজের প্রাচীন প্রথা। সনাতনধর্মে এর অনুপ্রবেশ বৌদ্ধরীতির হাত ধরেই। নাস্তিক্যবাদও জগন্নাথ ও বুদ্ধের মধ্যে একটা প্রধান যোগসূত্র।
সনাতনধর্মে শৈব ও বৈষ্ণবদের মধ্যে দেবতা জগন্নাথকে নিয়ে কাড়াকাড়ি চলছে গত হাজার বছর। প্রাথমিকভাবে পূর্বভারতে অনার্য ও নিম্নবর্গীয় জনতার দেবতা শিব বুদ্ধের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান। পিয়দস্সি অশোক ও মৌর্যশাসনের পর বৌদ্ধসংস্কৃতির নাভিকেন্দ্র যখন সম্রাট কণিষ্কের রাজত্ব , অর্থাৎ উত্তর-পশ্চিম ভারতের দিকে সরে যায় তখন দেশের এইপ্রান্তে অন্ত্যজ, অনার্য মানুষজনের কাছে শিব বা মহাদেব ও বুদ্ধদেবের ভাবমূর্তির মধ্যে ব্যবধান প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিলো। যুক্তিগতভাবে সেটাই স্বাভাবিক ছিলো। কিন্তু কুমারিলভট্ট, মণ্ডন মিশ্র এবং আদিশংকরের ক্রমাগত প্রয়াসে ব্রাহ্মণ্য ভাবধারার পুনরুজ্জীবন ঘটে। বিষ্ণুপূজক, বর্ণাশ্রমবাদী শক্তিগুলি আবার মানুষের অধ্যাত্মিক স্পেসটি দখল করে নেয়।
মধ্য গুপ্তযুগে রচিত হরিবংশ বা শ্রীমদ্ভগবতগীতায় বিষ্ণুর নবম অবতার হিসেবে বুদ্ধের কোনও উল্লেখ নেই। কিন্তু পরবর্তী পুরাণযুগে, অর্থাৎ সনাতনবাদী পুনরুত্থান ঘটে যাবার পর সংকলিত পদ্মাপুরাণে লেখা হয় বিষ্ণু বুদ্ধশরীর গ্রহণ করেছিলেন। অগ্নিপুরাণেও বলছে বিষ্ণু শুদ্ধোদনপুত্র হয়ে জন্ম নিয়ে ছিলেন ‘মায়ামোহ’ নামক দানব প্রবৃত্তিগুলি নাশ করার জন্য। এছাড়া গরুড়পুরাণ, ভাগবতপুরান ইত্যাদি সংকলনে কোথাও বিষ্ণুকে জিনপুত্র (জৈনমতে) বা মোহনাশক বুদ্ধের অবতারে বর্ণনা করা হয়েছে। মোদ্দাকথা, বিষ্ণুপূজকরা পূর্ণ প্রয়াস করেছেন বুদ্ধকে নবম অবতার হিসেবে প্রতিপন্ন করতে। ওড়িশায় বিষ্ণুর নবম অবতার হয়ে এসেছেন জগন্নাথ। পুরীর মন্দিরে মূল প্রবেশদ্বার, সিংহদ্বারের শীর্ষে বিষ্ণুর দশ অবতারের মূর্তি রয়েছে। সেখানে হলধর ও কল্কি অবতারের মাঝে নবম অবতার হিসেবে জগন্নাথের প্রতিকৃতি দেখা যাবে। এছাড়া ভিতরে জগমোহনের সামনে গরুড়স্তম্ভের পাশের দেওয়ালেও দশাবতারের নবম সদস্য হিসেবে জগন্নাথকে দেখা যাচ্ছে। ওড়িশার সনাতনধর্মীয় ভক্তবৃন্দ বুদ্ধ ও জগন্নাথকে এক করেই দেখে এসেছেন পুরাণযুগ থেকে।
(‘নীলমাধব: একটি বিকল্প নিমপুরাণ’ ও
“দেবতার সন্ধানে-একটি অনার্য অডিসি”)