শিল্পায়নের ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই বিশ্বের প্রধান দেশগুলোর তালিকার শীর্ষে উঠে এসেছে চীন। এবার নিজেদের আগ্রাসী ঋণ কুটনীতির মাধ্যমে, বিশ্বের অন্তত ৮০টি দেশকে নিজের হাতের মুঠোয় আনতে চায় তারা। বর্তমানে এমন কোনো পণ্য নেই যা এ দেশটি তৈরি করে না। এসব পণ্য রফতানির জন্য দরকার নতুন নতুন বাজার। বিশ্বব্যাপী বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্য নিয়ে প্রেসিডেন্ট জি জিনপিংয়ের উদ্যোগে তৈরি হচ্ছে এ নতুন সিল্ক রোড তথা বাণিজ্য পথ। বিগত ৫ বছর ধরেই চীনা প্রেসিডেন্ট ‘ওয়ান বেল্ট- ওয়ান রোড’- এর মাধ্যমে বিশ্ব বাণিজ্যে চীনকে চালকের আসনে বসাতে তৎপর। নিজের দেশের চারপাশ ঘিরে স্থল ও জলে নতুন এক সার্বভৌম বাণিজ্য পথ খোলার চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। ইতিহাসের প্রচ্ছদ দিয়ে একেই বলা হচ্ছে ‘সিল্করুট’। সিল্করুটের পথে পথে সমুদ্রবন্দর, সড়ক, করিডোর, বিদ্যুৎকেন্দ্র, বাঁধ ও বিমানবন্দর তৈরি হচ্ছে। ঋণের অর্থ ধরিয়ে দিয়ে অপরের জল ও স্থল সীমানায় চীন নিজের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য বাস্তবায়ন করে চলেছে এভাবে। আর এসব তাকে বিশ্ব পরিসরে আমেরিকার বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলেছে। চীনের বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, ইতিমধ্যে দেশটি তার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অর্ধেকের বেশি নিজের ভূখণ্ডের বাইরে ছড়িয়ে দিতে পেরেছে। আর এই কাজ সহজ করেছে ঋণ অস্ত্র।
তবে চীন বলছে, এসবই আসলে তাদের ‘উইন-উইন’ উদ্যোগ। প্রকল্পগুলো যত শেষ হবে, ততই প্রতিটি দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ঘটবে। সেই বিবেচনা থেকেই ‘ওয়ান বেল্ট-ওয়ান রোড’- এর জন্য এক ট্রিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার ইচ্ছে চীনের। ‘আমরা কেবল ঋণ দিচ্ছি না, উন্নয়নে সহায়তাও করছি’, দাবি চীনের। তারা সম্প্রতি প্যালেস্তাইনকে দেওয়া ১৫ মিলিয়ন ডলার ‘ডেভেলপমেন্ট এইড’-এর উদাহরণ দিচ্ছে। এভাবে ঋণ কিংবা উন্নয়ন সহায়তা, যেভাবে হোক, চীন সিল্করুটে অন্তত ৮০টি দেশকে হাতের মুঠোয় চাইছে। সর্বশেষ আরব দুনিয়ার দেশগুলোর জন্য ২০ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে চীন। সম্ভবত সিরিয়া, ইয়েমেন, জর্ডন ও লেবানন হবে এর প্রধান ভোক্তা।
উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে ঋণ সম্পর্কে চীনের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে এই কারণে যে, তার সঙ্গে ‘ওয়ান বেল্ট-ওয়ান রোড’-এ শরিকদের বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছেই। অর্থাৎ সিল্করুটে যুক্তরা ক্রমে চীনের বাজারে পরিণত হচ্ছে কি না, সে প্রশ্ন উঠছে। এভাবে অনেক দেশ ঋণচুক্তির শর্ত হিসেবে বড় বিনিয়োগগুলোতে ১০ বছরের কর ছাড় দিচ্ছে। এর ফলে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সঙ্গে চীনের বিনিয়োগের অসম প্রতিযোগিতা তৈরি হচ্ছে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক সামর্থ্যের বেশি ঋণ নিতে গিয়ে পাকিস্তান, মালদ্বীপ বা মন্টেনেগ্রোর সরকারগুলো কিংবা ঋণ দিতে গিয়ে চীন স্থানীয় জনসাধারণের মতামত নিয়েছে কমই। কোথাও কোথাও প্রকল্পগুলি এগচ্ছে জনবিচ্ছিন্ন সামরিক প্রক্রিয়ায়। তাই সেগুলোতে সময় বেশি লাগছে। দীর্ঘসূত্রতা ঋণের অঙ্ক বাড়িয়ে দিচ্ছে।
তবে চীনের কাছে ঋণগ্রস্ত দেশগুলোর জনগণ প্রায় জানেনই না, তাদের দেশ কেন এত ঋণ নিচ্ছে, এই ঋণ কীভাবে পরিশোধ করা হবে বা গৃহীত প্রকল্পগুলো কতটা জরুরি ছিল, আর আদৌ এসব প্রকল্প অর্থনৈতিক অসাম্য কমাতে কোনও ভূমিকা রাখবে কি না। এসব বিষয়ে অধিকাংশ সিদ্ধান্ত উপর থেকে গৃহীত হচ্ছে। কিন্তু সুদসহ ঋণ শোধ করতে হবে এসব দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও। আর সেটা পরিশোধে ব্যর্থ হলে অনেক দেশকেই কূটনীতিক সার্বভৌমত্বে আপোস করতে হবে। উপরন্তু অনেক প্রকল্পের মালিকানাই ইজারা হিসেবে ছেড়ে দিতে হবে চীনের কাছে। আর চীন এক বিশাল জলপথ ও স্থলবিভাগের মালিক হয়ে উঠবে।
এরমধ্যেই দক্ষিণ চীন সাগর থেকে উত্তর চীন সাগর, ভারত মহাসাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত অংশ নিজেদের প্রভাবের আওতায় নিয়ে আসায় সচেষ্ট চীনা সামরিক বাহিনী। ভারত মহাসাগর জুড়ে কয়েক ডজন নৌবন্দর নির্মাণ করা হচ্ছে। চীনের দাবি, এটি সহযোগিতার মাধ্যমে যৌথভাবে লাভবান হওয়ার নতুন এক মডেল। ভারত বরাবরই এর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। জানিয়েছে, এটি আসলে এক নতুন ধরনের উপনিবেশবাদ। এই কৌশল আদতে দুর্বল রাষ্ট্রগুলিকে ঋণের জালে বেঁধে ফেলবে।