এই তো কয়েকদিন আগের ঘটনা। টালিগঞ্জ ম্যাচে তাঁর নােম জয়ধ্বনী উড়েছিল গ্যালারিতে। সেদিন ম্যাচ সেরার পুরস্কার নিয়ে কথা দিয়েছিলেন, ‘উচ্ছ্বাসে গা না ভাসালে চলবে না। ছন্দটা ধরে রাখতে হবে। ডার্বিতে ভাল ফল করতে হবে।’ কথা রাখলেন পিন্টু মাহাতো। জীবনের প্রথম ডার্বিতে নেমে স্নায়ুর চাপ সামলে গোল। ম্যাচ ড্র হলেও সেরার খেতাব নিয়ে গেলেন পিন্টুই। আর জীবনের প্রথম ডার্বির অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাবে ছোট ছোট শব্দে বললেন, ‘ভাল লাগছে। তবে ম্যাচ জিতলে আরও ভাল লাগত। এই গোল আর পুরস্কার বাবা–মা কেই উৎস্বর্গ করছি।’
টাইম মেশিনে চেপে সাত–আট বছর পিছিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকলে উঠে আসত এক অন্য ছবি। বর্তমানের সঙ্গে যার বিস্তর ফারাক। অশান্ত জঙ্গলমহলের ধডরাশোল গ্রাম। সেখানেই এক দরিদ্র চাষীর পরিবারে লালিত হচ্ছিলেন ২০১৮ সালের ২রা সেপ্টেম্বরের ডার্বির নায়ক। মা বালিকা মাহাতো গৃহবধূ। বাবা সুধীর মাহাতোর চাষাবাদেই চারজনের সংসার চলতো। অথচ সেই সুধীরবাবুই রোববারের ডার্বির নায়কের ফুটবল মাঠে নামার অনুপ্রেরণা। বাবাকে দেখেই ফুটবল পায়ে নেমে পড়া পিন্টুর। ধডরাশোলের বিবেকানন্দ ক্লাবে ফুটবলের হাতেখড়ি। সেখান থেকে মেদিনীপুর শহরের রাঙামাটি স্পোর্টিং ক্লাব হয়ে মোহনবাগান আকাদেমি। তারপর তিন বছর আগে সিনিয়র দলে সুযোগ। বাকিটা আজ যেন ইতিহাস।
২০১১ সালে মোহনবাগান অনূর্ধ্ব ১৪ দলে ট্রায়াল দিতে প্রথমবার কলকাতায় এসেছিলেন পিন্টু। প্রথম দিনেই তাঁর খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন নির্বাচকরা। তবে তারচেয়েও বেশি অবাক হয়েছিলেন বাগান জুনিয়র দলের কোচ অমিয় ঘোষ। কোথায় থাকবে, প্রশ্নের জবাবে বছর ১৪–র একটা ছেলে যে উত্তর দিয়েছিল, তা অবাক করে দেওয়ার মতোই ছিল। হাওড়া স্টেশনে রাত কাটিয়ে সকালে ঠিক সময়ে মাঠে পৌঁছে যাওয়ার অঙ্গীকার চমকে দিয়েছিল। যা শুনে পিন্টুকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন অমিয় ঘোষ। তারপর থেকে তিন বছর পিন্টুর ঠিকানা ছিল অমিয় ঘোষের বাড়িই। যদিও সিনিয়র দলে সুযোগ পাওয়ার পর ঠিকানা বদলেছে। এখন পিন্টু ইলিয়ট রোডে মোহনবাগান মেসের বাসিন্দা।
নুন আনতে পান্তা ফুরনোর জোগাড়। বাস্তব জীবনে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াইটাই যেন ফুটবল মাঠেও পিন্টুকে লড়াইয়ের রসদ জোগায়। যেখানে লড়াইটাই সব। বাকি সবকিছু নিমিত্ত মাত্র। তা না হলে বাংলার ফুটবলের এমন হাইভোন্টেজ ম্যাচে নায়কের শিরোপা পাওয়ার পর, কেউ প্রচারমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য কাকুতি–মিনতি করেন! নিজেকে প্রচারের শিরোনামে তুলে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ হেলায় সরিয়ে লাজুক মুেখ টিম বাসের দিকে দৌড় লাগায়। আসলে শিকড়টা যে ভোলেননি পিন্টু। লড়াইয়ের সঙ্গে এটাও যেন তাঁকে আলাদা পরিচিতি দিচ্ছে।