দিন কয়েক আগে দুটো বাক্য খুব হোয়াটসঅ্যাপের ঝোড়ো হাওয়ায় ভাসছিল।
যা হয়, দিন কয়েকের জন্যই। তার পর যে বার্তা হাওয়া।
‘সাদা মনে একখান প্রশ্ন আছিল
ইলিশ মাছটা শরণার্থী না অনুপ্রবেশকারী…?
এ সব হোয়াটসঅ্যাপে ঘোরতর বিতৃষ্ণা আমার। এলেই ডিলিট।
সেদিন কী হল জানি না, একটা পাল্টা উত্তর লিখে ফেললাম,
‘ইলিশ মাছ হল ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি আসলে। কোনও দেশ থেকে নয়, ওরা আসলে আসে মহাসিন্ধুর ও পার থেকে। কোনও সঙ্গীত নিয়ে।’
পরে ভেবে দেখি, কোনও মাছই শরণার্থী বা অনুপ্রবেশকারী নয়। বরং বিশ্বনাগরিক। তাদের সব দেশে যাওয়ার পূর্ণ অধিকার।
সুন্দরবনের নদীতে যে চিংড়ির মীন ধরা হয়, সে কি বাংলাদেশ থেকে আসতে পারে না?
চিংড়ি মাছটা শরণার্থী না অনুপ্রবেশকারী? এ ধরণের প্রশ্ন করলে আমি বলব, ‘চিংড়ি হল শরৎ আকাশের মেঘের মতো। উড়ে বেড়ায় আকাশকে আরও নীল করে দিয়ে। সে মেঘ কোথা থেকে আসে, কেউ জানে না।’
হে অকুল গাঙের মাঝি, তোমার জাল ভরে উঠুক এ দুটো মাছে। কোন গ্রামে, কোন নগরে পৌঁছে যাবে সব। রান্নার পাত্রে তুলোর মতো নরম হয়ে মিশে যাবে সর্ষের সঙ্গে। দুটো মাছই মুখে দিলে গলে যাবে। কী তুষ্টি।
আমি মোহনবাগান নই। আমি ইস্টবেঙ্গল নই।
আমি ইলিশের। আমি চিংড়ির।
ইলিশনামা এবং চিংড়িনামা সারা দিন ধরে পড়ে যেতে পারি। রান্নাঘরে কড়াইয়ে সর্ষের তেলে দু’রকম মাছ পড়লে গন্ধেই ওম শান্তি! চুলোয় যাক মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল। বেঁচে থাক চিংড়ি-ইলিশের স্বাদ।
ইলিশের জন্য আমি অনায়াস প্রত্যয়ে বলতে রাজি, ‘ইল্লিশো মধুরো স্নিগ্ধো রোচনা বহ্নিবর্ধন:’ অথবা ‘ইলীশো জিতপীযূষো বাচা বাচামগোচরা। রোহিতো নো হিত: প্রোক্তো মদগুরো মদগুরো: প্রিয়:’।
চিংড়ি মাছের সংস্কৃত নাম চিঙ্গট। চিঙ্গট থেকে এসেছে চিংড়ি নামটা। সংস্কৃতে কত রকম নাম রয়েছে চিংড়ির। মহাশল্ক। গঙ্গাতেয়। জলবৃশ্চিক। বৃহছল্ক। পাতিন। গলানিল। গনালিন।
কী অবাক ব্যাপার। চিংড়ির অন্য নাম গলানিল। আবার গনালিনও। গঙ্গাতেয়—মানে গঙ্গার পুত্র? গঙ্গায় ইলিশ হয়, চিংড়িও। পদ্মায় নিশ্চয়ই তাই হয়।
ইলিশকে রুপোলি শস্য বললে চিংড়িকে শ্বেতশুভ্র শস্য বলব না কেন?
বড় ম্যাচের আগের দিন সকাল থেকে দুটো প্রশ্ন নিয়ে ঘুরপাক খেলাম। লাভ হল না।
ইলিশ এবং চিংড়ি মাছ দুটো ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগানের প্রতীক হল ঠিক কবে থেকে?
কারা এই প্রতীক ঠিক করলেন? কোন মানুষ?
প্রবীণ সাংবাদিক বা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে লাভ হল না।
সবাই জানেন, ও পার বাংলার সঙ্গে ইলিশ মাছের কী সম্পর্ক। সেখান থেকে যে ইলিশ ইস্টবেঙ্গলের হয়ে গেল, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু চিংড়ি, মানে গঙ্গাতেয় কী করে মোহনবাগানের হল? সেটাও জানতে পারলাম না। আর কবে থেকে যে দুটো মাছ দুটো ক্লাবের হয়ে গেল, কারও কোনও স্পষ্ট উত্তর নেই। কেউ বলছেন, চল্লিশ দশক। কেউ বলছেন, ষাটের দশক।
মজা হল, ইলিশ তো শুধু পদ্মাপারে পাওয়া যায় না। ডায়মন্ডহারবারের ইলিশ ভালো। কোলাঘাটের ইলিশ ভালো। ফারাক্কার ইলিশও ভালো। তা হলে কোথায় বা বলা যায় ইলিশ শুধু পদ্মাপারের প্রতিনিধি? ইস্টবেঙ্গলের প্রতীক ওইজন্য? ও পার বাংলার উদ্বাস্তুরা যেমন পদ্মার ইলিশ আনতেন, তেমন এ বাংলা থেকেও নিশ্চয়ই ইলিশ আসত। তা হলে আর দুটো প্রিয় জিনিসে এ বাংলা এবং ও বাংলা বিভেদ কেন?
চিংড়ি আর ইলিশের ময়দানি গল্প শুনতে শুনতে এমন এক গল্প শুনলাম, যা প্রথমে বিশ্বাস করা যায় না। এখনকার দিনে হবেই না। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে রাজকীয় ‘মৎস্যউৎসব’। সেখানে আলো করে থাকত চিংড়ি মাছের নানা পদ। মোহনবাগান ক্রিকেটাররা খেতে যেতেন সব।
কী ভাবে? ষাটের দশকের শুরুর দিকে তখন দুটো ক্লাবের এজমালি মাঠ। প্রতি বছর একটা প্রদর্শনী ক্রিকেট ম্যাচ হত দুটো টিমের। একধণ্টা লাঞ্চ। একবার মোহনবাগান লাঞ্চের ব্যবস্থা করত। একবার ইস্টবেঙ্গল। দুটো টিমেরই রাজকীয় লাঞ্চ। মোহনবাগানের কর্তাদের লা়ঞ্চে থাকত চিকেনের নানা পদ। ইস্টবেঙ্গলের লাঞ্চে থাকত মাছের নানা পদ। তাদের ক্রিকেট সচিব গুপি পণ্ডিতের ছিল নানা মাছের ভেড়ি। সে জন্য ইস্টবেঙ্গলের লাঞ্চে থাকত মাছের নানা পদ। চিংড়ি থেকে ইলিশ। সে সময়ের নামী ক্রিকেটার-সাংবাদিক শ্যামসুন্দর ঘোষ বললেন, ‘আমাদের ইস্টবেঙ্গলের লাঞ্চ হলেই চুনী এসে খোঁজ নিত, চিংড়ি মেনুতে আছে তো রে?’ মাছ খেয়ে ক্রিকেটাররা খেলতে নামছে, ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য। কিন্তু সেটাই হত তখন। আর ইস্টবেঙ্গল মাঠে যখন চিংড়ি খাওয়া হতো চুটিয়ে, তখনও তা হলে নিশ্চয়ই চিংড়ি মাছ প্রতীক হয়নি মোহনবাগানের। নইলে চিংড়ি বয়কটের সম্ভাবনা প্রবল ছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, চিংড়ি প্রতীক তা হলে হল কখন? চল্লিশ, পঞ্চাশ দশকের গল্পগুলো কি তা হলে স্রেফ কথার কথা?
সত্যি কি এখন ইলিশ-চিংড়ির বিক্রি বাড়ে মোহন-ইস্ট ম্যাচের স্কোরের ওপর? গড়িয়াহাটের পরিচিত মাছ বিক্রেতা বললেন, ‘আগের মতো আর বিক্রি বাড়ে না। পরদিন কথাই হয় বেশি। কেনাকাটা সামান্যই বাড়ে।’
(সংগৃহীত)