সালটা ২০১০,আমি লেকটাউনের কাছে একটা বড়ো রেসিডেন্টিয়াল প্রজেক্টে কাজ করছি।সবে কালীপুজো ভাইফোঁটা শেষ হয়েছে,সাইটে লেবারের সংখ্যা আর কাজের চাপ দুটোই কম,…..পূজো চলে গেলেও তার আমেজটা পুরোপুরি যায়নি এখনও। কাজ বলতে একমাত্র ব্লক টুয়ের ফিফ্থ ফ্লোর স্ল্যাবের স্যাটারিং-এর কাজ চলছে।লাঞ্চের পর আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে বসে আড্ডা মারছি।একটু দূরে ব্লক ফোরের লেবার কন্ট্রাকটর মাসুদ বসে আছে বিল নিয়ে।ওরও আজ আট দশটা লোক ঢুকেছে সাইটে।মাসুদ লোকটাকে দু চোখে সহ্য হয় না আমার,এমনিতেই মুসলমান তার উপর চোখে মুখে যেন একটা হিংস্রতার ভাব লেগে রয়েছে সবসময়ে।লম্বায় প্রায় ছ ফুট,বুকের ছাতি বিয়াল্লিশ তেতাল্লিশ হবে…….মিশমিশে কালো গায়ের রঙ ওর…. ঠিক যেন একটা কষাই।লোকটা জুলু জুলু চোখে আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে।হঠাৎই আকাশ বাতাস ভেদ করে একটা তীব্র আর্তনাদ ভেসে আসল,সঙ্গে সঙ্গে উপর থেকে ভারী কিছু পড়ার শব্দ।আওয়াজটা এসেছে ব্লক টু র দিক থেকে।পড়িমরি করে সবাই ছুটলাম সেই দিকে।কোনো স্যাটারিং লেবারই পড়েছে উপর থেকে।ভীর সরিয়ে সামনে এগোতেই চোখে পড়ল এক বিভৎস দৃশ্য,পুরো জায়গাটা ভরে গেছে রক্তে,একটা বছর চল্লিশের লোক পড়ে আছে ইউজিআর এর স্ল্যাবটার উপর,মাথার একটা দিক পুরো থেতলে গেছে, সেখান থেকেই ব্লিডিং হচ্ছে প্রচন্ড পরিমাণে,লোকটা ডানদিক বাঁদিক করতে পারছে না,দেখে মনে হল কোমোর আর মেরুদন্ডের হাড় ভেঙেছে, ভাঙতে পারে শরীরের অন্যান্য অংশের হাড়ও, মুখ দিয়ে শুধু গোঙানির আওয়াজ আসছে….বাঁচার আশা খুবই কম মনে হচ্ছে।….আমাদের সবার পিছন পিছন মাসুদ যে কখন তার দলবল নিয়ে হাজির হয়েছে বুঝতে পারিনি….লোকটাকে দেখে হাহাকার করে ওঠে ও……”আরে এতো গোপাল দা গো,আমাগো পাশের হিন্দু পাড়ায় থাকে……ধর ধর, সবাই মিলে ধর দেখিনি,….ওকে তুলে দে আমার কোলে, এখুনি হাসপাতালে নিয়ে যাতে হইব।সুলেমান,সাহেব তুরা দৌড়ে গিয়ে একটা ট্যাক্সি ধর….বাকিরা সবাই আয় আমার পিছে…..দাদাকে আমাগো বাঁচাতেই হইব। ….ওর বুড়ি মা ডারে খবর দে রে কেউ”….এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে লোকটাকে বুকে নিয়ে ঝড়ের বেগে এগিয়ে যায় মাসুদ,সঙ্গে স্যাটারিং-এর দুটো লেবার।ট্যাক্সিতে উঠতে উঠতে আমাদের উদ্দেশ্যে বলে যায়…”স্যার, আরজিকর নিয়া যাচ্ছি,আপনারও আয়েন।”..
মিনিট পঁয়তাল্লিশ কেটে গেছে, আমরা সবাই এখন দাঁড়িয়ে আছি ইমার্জেন্সির বাইরে।ওটিতে নিয়ে যাওয়ার আগে বড়ো ডাক্তার বাবু ,সার্জেন আর অ্যানিস্থেটিস্টকে নিয়ে এসেছেন গোপালদাকে দেখতে।দশ মিনিট পরে গম্ভীর মুখে বেরিয়ে আসলেন সবাই…..আমাদের উৎকণ্ঠা মাখানো মুখ গুলোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে সার্জেন ডাক্তার বল্লেন “দেখুন,খুবই ক্রিটিকাল কন্ডিশন ,আপনাদের আসার কথা শোনাতে পারছি না, ওটি পরে প্রচুর রক্ত লাগবে…আপনারা এরেন্জ করে রাখবেন।”পাশ থেকে মাসুদ বলে ওঠে ….”রক্ত নিয়া আপনে ভাববেন না ডাক্তার বাবু, আমরা এত্তগুলা জোয়ান মরদ আছি কি কইরতা….এই এই আমার এই বিশাল শরীরডা দেখতেছেন এতে হনেক রক্ত অ্যাছে…নেন না নেন কত লাগবে আপনাদের…শুধু ঐ লোক ডারে বাঁচাইয়া দেন।” বলতে বলতে ডাক্তারের হাত দুটো চেপে ধরেছে মাসুদ….এ যেন এক ভাইয়ের জীবনের জন্য আর এক ভাইয়ের করূণ আর্তি।….মাসুদের কাধের উপর এক বার নিজের হাতটা রেখে ডাক্তার বাবু দ্রুত এগিয়ে যান।
প্রায় ছয় ঘন্টা অপারেশনের পর পেসেন্টকে আট বোতল রক্ত দিতে হয়েছে, মাসুদ দিয়েছে দু বোতল…. আইসিইউ তে গোপাল দাস এখনও মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে।ডাক্তার বাবু বলেছেন অপারেশন সাকসেসফুল কিন্তু বারো ঘন্টার আগে কিছু বলা যাবে না।হাত ঘড়িটা দেখলাম সাড়ে এগারোটা বাজে।প্রজেক্ট ম্যানেজার পার্থ দা বলে গেছিলেন আপারেশনটা কমপ্লিট না হওয়া পর্যন্ত আমি যেন থাকি। স্যাটারিং গ্যাং এর লোকজন আছে…আর একটু দূরে মাসুদ ঠায় বসে আছে ওর লোকজন নিয়ে….সবাইকে বলে যখন বেরচ্ছি আমি,…..ওর গলাটা শুনতে পেলাম …..” চিন্তা করবেন স্যার আমাগো গোপালদার কিচ্ছু হইব না,আল্লাহ মেহেরবান আছেন।”
পরদিন সকাল বেলা আবার এসেছি হসপিটালে, পরিস্থিতি এখন অনেকটাই ভালো….কিছুক্ষণ আগে নাকি ডাক্তার বাবু দেখে বলে গেছেন।একটু দূরেই দাড়িয়ে আছে মাসুদ…চোখে মুখে রাত জাগার ছাপ…আমাকে দেখে চওড়া হেসে পাশে এসে দাঁড়ালো।”দাদা আমার অনেকটা ভালো।” ওর সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ চোখ পড়ল করিডোরের দিকে।
আলু থালু বেশে দূর থেকে ধূকতে ধূকতে এগিয়ে আসছে এক বুড়ি, বয়স সত্তর পচাত্তরের কাছাকাছি হবে, বিধবার বেশ, অবিনস্ত রুক্ষ শুষ্ক চুলগুলো উড়ছে এদিক ওদিক ,পড়নের কাপড়টা শতচ্ছিন্ন,দারিদ্র যেন গ্রাস করে আছে জীর্ণ শীর্ণ শরীরটাকে,গাল দুটো ভেঙে ভেতরের দিকে ঢুকে গেছে, কোটরের ভিতর ঢুকে যাওয়া দুই চোখে দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট, চোখ দুটো যেন কাউকে খুঁজছে।পাশ থেকে মাসুদ চাপা স্বরে বলল “খোকনের মা”….আমরা সবাই একটু নড়েচড়ে উঠলাম….বুড়ি আমাদের সামনে এসে থমকে গেল, সন্ধানী চোখ দুটো আটকে গেছে মাসুদের দিকে….কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধান….”মাসুদ বাপ আমার আজ তোর রক্তেই আমার জোয়ান ছেলেডা বাইচ্চা গেল”…শুধু এই কটা কথা,তার পরেই বৃদ্ধ শরীরটা এসে ভেঙে পড়ল মাসুদের বুকের উপর তারপর নিঃশব্দে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল বুড়ি।আমার মনে হল এ কান্না জাতি ধর্ম নির্বিশেষে শুধু মানুষের জন্য মানুষের, এ কান্নার কোনো ভাষা হয় না,এ কান্না কৃতজ্ঞতার,ভালোবাসার,কষ্টের আর আনন্দের,এ কান্না উপলব্ধির….এই চোখের জল পাশের মানুষকেও সংক্রামিত করে,তাই আমাদের সবার চোখেই জলে ভেজা।মাথা নীচু করে কাঁদছে নিঃশব্দে মাসুদও,অজান্তে কখন ওর ডান হাতটা বুড়ির মাথার উপর উঠে এসেছে,যেন এক সন্তান তার বৃদ্ধা মাকে পৃথিবীর সমস্ত দুঃখ কষ্ট থেকে আড়াল করে ভরসা প্রদান করছে।
আমি অবাক হয়ে ভাবছি এ কি সেই ভারতবর্ষ,যেখানে হিন্দু মুসলিম দুই ধর্মের মানুষের রেষারেষি নিয়ে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত উত্তাল…. একি সেই দেশ যেখানে একে অপরের প্রতি চরম বিদ্বেষের আগুন বুকে নিয়ে বেঁচে রয়েছে এই দুটি ভিন্ন ধর্মালম্বী মানুষ,আর তাদের রেষারেষিকে ফায়দা করে এক নোংরা ভোট যুদ্ধের খেলা খেলতে ব্যাস্ত দেশের তামাম রাজনৈতিক নেতা নেত্রীরা…এই কি সেই ভারত যাকে নাকি স্বাধীণতা পূর্বে চতুর ইংরেজরা ধর্মের দোহাই দিয়ে ভেঙে দুভাগ করেছিল,বুদ্ধি করে সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশটার অগ্রগতিকে ঠেলে দিয়েছিল পঞ্চাশ বছর পিছনে।সেই দেশভাগের দগদগে ক্ষত এখনও বয়ে বেড়াচ্ছে দেশের মানুষ।এই কী সেই হিন্দুস্তান যেখানে আজও হিন্দু মুসলিম issue কে কেন্দ্র করে ছোট্ট কোনো একটা খবর,ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ কোনও ছোট্ট আর্টিকেল দেশে দাঙ্গার আগুন লাগাতে পারে ।পাড়ার মোড় গরম করার জন্য এই একবিংশ শতাব্দীতেও ঐ একটা ইস্যু যথেষ্ট।
না, বিগত বেশ কয়েক ঘন্টায় চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলোর সঙ্গে আমি একেবারেই মেলাতে পারছিনা আমাদের পরিচিত ভারতবর্ষকে।এ যেন এক নতুন দেশ,নতুন
ভারতবর্ষ যাকে আমরা সবসময়ে দেখতে চাই পেতে চাই।যেখানে দাড়িয়ে আমি দেখলাম জাতি ধর্ম নির্বিশেষে মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসাকে, চরম দুঃসময় একে অন্যের সমব্যথী হয়ে পাশে দাঁড়ানোকে, কষ্টকে ভাগ করে নেওয়াকে।মানুষের রক্তের, চোখের জলের কোন জাত হয় না এই সত্যটা প্রমাণিত হল আমার চোখের সামনে…..
দুটো লোক এসে গোপালদার মাকে আইসিইউ এর দিকে নিয়ে গেল।ঘড়িতে ঠিক বারোটা বাজে, দূরে কোন মসজিদ থেকে আজানের আওয়াজ ভেসে আসছে।পাশ থেকে মাসুদ বলে ওঠে “স্যার আপনারা অ্যাছেন তো ,আমি একটু নামাজ টা পইরা আসি।”…কাঁধের ব্যাগটা থেকে টুপিটা বের করে মাথায় পড়ে নেয় মাসুদ….তার পর ছ ফুট লম্বা বিশাল শরীরটা নিয়ে ধর্মপ্রাণ মানুষটা এগিয়ে চলে গেটের দিক।আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি আর ভাবছি ভুলটা আমারই,আজ এই সন্ডা কষাই মার্কা লোকটাই আমাদের সবাই কে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল “সবার উপরে মনুষ্যত্ব তাহার উপরে নাই ।” বাইরে থেকে ওকে চিনতে পারিনি….. আলেকজান্ডার ঠিকই বলেছিলেন “সত্য সেলুকাস কি বিচিত্র এই দেশ ।”