অস্থি থেকেই স্বস্তি খুঁজছেন মোদী-অমিতরা। জীবনের শেষ পর্বে যে প্রবাদপ্রতিম রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্বকে তারা দলে ব্রাত্য করে রাখলেন; যার নামটুকু উচ্চারণ করতে তারা কুণ্ঠাবোধ করতেন; এমনকি যার ঘনিষ্ঠ অনুগামীদেরও দলে নানা ছুতোনাতায় যারা এখনও হেনস্থা করে চলেছেন; এখন সেই তারাই সদ্য প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীকে আঁকড়ে ক্ষমতায় থাকতে চাইছেন। অটজির অস্থিকলসকে নিয়ে তারা দেশজুড়ে এক সহানুভূতির আবহাওয়া তৈরি করে আগামী ভোটে আবার ক্ষমতায় ফিরতে চাইছেন। মোদী-অমিত এর এই হঠাৎ অটলজি- প্রীতির এটাই আসল কারণ।
এমনিতে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছনোর মত কোন রাজনৈতিক কর্মসূচি নীরব মোদী, মেহুল চোকসীদের বন্ধু বিজেপির নেই। নিজেদের কুকর্ম অপরাধীরা সবচাইতে বেশি বুঝতে পারে। মোদী-অমিতরা জানেন জীবনের শেষ পর্বে মহীরুহসম যে মানুষটিকে উপেক্ষা করার সাহস দেখিয়েছিলেন সেই খেলা অটলজির মৃত্যুর পর শেষ হয়ে গেছে। অটলজিকে ঘিরে দেশের মানুষের উন্মাদনা দেখেই তারা সুর বদলে ফেলেছেন। বুঝতে পেরেছেন নিজেদের মহান ভাবমূর্তি নির্মাণের জন্য কোটি কোটি টাকা অপব্যয় করে তাদের সবরকম ব্র্যান্ড বিল্ডিং কৌশল ব্যার্থ হয়েছে। তারা বুঝে গেছেন জীবিত অটলজির চেয়ে মৃত অটলজি আরও বেশি শক্তিশালী। তাঁর মুখটি মানুষের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য। শোকযাত্রা আর অস্থিকলসের রাজনীতিতে তারা এখন নিজেদের মুখে অটলজির মুখোশটি পরে ফেলেছেন।
এমনটাই যে হতে চলেছে তা মোদী-অমিত ব্রিগেডের তৎপরতা দেখে আগেই বোঝা গিয়েছিল। এমনকি অটলজির অন্তিম মুহূর্তে তাঁর ঘনিষ্ঠ নেতা ও ভাবশিষ্যদেরও ঘেঁষতে দেননি তারা। ব্যাপারটা খুব দৃষ্টিকটু হয়ে যাচ্ছে দেখে পরবর্তীকালে নিজেদের দাঁত-নখ একটু ঢেকে নিয়েছেন। কিন্তু এত করেও শেষরক্ষা হয়নি। বরং প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী নানা সিদ্ধান্তের সঙ্গে মোদী-অমিতদের সিদ্ধান্তের তুলনা চলছে দেশজুড়ে। এই তুলনা কিন্তু তাদের সবরকম ভাবমূর্তি নির্মাণের কৌশলে জল ঢেলে দেবে। মৃত্যুর পর ইন্দিরা হাওয়া, রাজীব হাওয়ায় ভর দিয়ে কংগ্রেস ভোটে জিতেছিল। অটলজির বেলায় কিন্তু তা ঘটবে না। কারণ, মোদী-অমিতের হঠাৎ অটলপ্রেমী হওয়ার কারণটা মানুষ ধরে ফেলেছেন।
অস্থিকলসের এই রাজনীতি আমাকে একটা পুরোনো ইতিহাস মনে করিয়ে দিচ্ছে। একসময় প্রবল ইন্দিরা বিরোধী বামেরা আরেক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর তাঁর চিতা ভস্ম নিয়ে ইন্দিরাপ্রেমী সাজার চেষ্টা করেছিলেন। বামফ্রন্টের তৎকালীন পূর্ত মন্ত্রী জ্যাকিদা মানে যতীন চক্রবর্তী বিমান বন্দর থেকে তাঁর চিতাভস্মের কলস মাথায় তুলে নিয়েছিলেন। গণমাধ্যমে তার সেই ছবি আজকের ভাষায় ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। প্রবল ইন্দিরা হাওয়ায় সেদিন দেশজুড়ে বাম-ডান সব বিরোধী উড়ে গিয়েছিল। অস্থি কলসের এই রাজনীতি বিজেপিকেও কোন ডিভিডেন্ট দেবে না। কারণ, বামেদের রাতারাতি ইন্দিরাপ্রেমের মত মোদীদের রাতারাতি অটলপ্রেমও দেশবাসী প্রত্যাখ্যান করবে।
দলের কর্মী ও নেতাদের নিয়ে স্থানীয় নদী এবং গঙ্গায় অস্থিকলস বিসর্জন ও সেই শোকযাত্রা জায়গায় জায়গায় থামিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের যে দেশজোড়া কর্মসূচি বিজেপি নিয়েছে তা এই সহানুভূতির হাওয়া তোলার জন্যই। এ রাজ্যেও গঙ্গাসাগর থেকে শুরু করে ফরাক্কা, মহানন্দা, নবদ্বীপ, ত্রিবেণীর জলে অস্থি কলস বিসর্জন দেওয়া এবং ভবানীপুরে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িসহ রাজ্যের ১৮টি জায়গায় শ্রদ্ধা জানানোর কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে একই কারণে। নিজের অটল আনুগত্য প্রমাণ করার জন্য মোদী স্বয়ং বিভিন্ন রাজ্যের দলের সভাপতি ও মুখ্যমন্ত্রীদের মধ্যে অস্থিকলস বিতরণের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছেন। মোদী-অমিতদের বিশ্বাস, এর ফলে ডিমনিটাইজেশন থেকে শুরু করে তাদের যাবতীয় আর্থিক দুর্নীতি ঢেকে ফেলা যাবে। মুছে ফেলা যাবে জাতীয় নাগরিক পঞ্জী তৈরির নামে দেশ থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের তাড়ানোর চক্রান্ত। ভুলিয়ে দেওয়া যাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধানো এবং বিরোধীদের ওপর নৃশংস আক্রমণ ও হামলার ইতিহাস।
পাপস্থালন করতে দেশজুড়ে ১৯শের ভোট অবধি নানাভাবে অটলজির স্মৃতিকে জীবন্ত রাখার চেষ্টা করে যাবেন তারা। নানা সরকারি প্রকল্প, যোজনা, প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়, স্মারকস্থল তৈরি হবে অটলজির নামে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই উদ্যোগগুলিকে দেখার পাশাপাশি এর সঙ্গে যারা যুক্ত সেই মানুষগুলিকেও দেখবেন দেশবাসী। বাংলার কথাই বলি, বাঙালির কাছে অটলজির যে ইমেজ তা গড়ে উঠেছে সংসদে তাঁর বাগ্মিতা, জরুরি অবস্থায় জেলে যাওয়া, প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তাঁর নানারকম সংস্কারমূলক কাজ, কার্গিলে যুদ্ধজয়, পোখরানের পারমাণবিক বিস্ফোরণ ইত্যাদির সুবাদে। এমন কোন কীর্তি কি মোদী-অমিতদের ঝুলিতে আছে? অটলজি তো দূরের কথা, এমনকি এই দুজন আদবানি, যোশী, সুষমা স্বরাজ, যশবন্ত সিং, অরুণ শৌরিদেরও ধারেকাছে আসেন না। এই প্রচেষ্টা অটলজির সুকর্মের বদলে মোদীদের দুষ্কর্মকেই মনে করিয়ে দেবে। মনে করাবে অটলজির মত একজন সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলতে পারা মানুষের সঙ্গে মোদীদের সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার কথা।
অটলজির প্রয়াণের পর মোদীর ম্যানেজাররা তার এক পদাতিক ভাবমূর্তি তুলে ধরছেন। বলছেন, অটলজির শেষযাত্রায় মোদীজি নাকি ছ-ঘন্টা হেঁটেছেন। এর সত্যি মিথ্যা আমি জানিনা। কিন্তু হাঁটার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দক্ষতার কি সম্পর্ক আছে তা আমি বুঝতে পারছি না। এই যুক্তি মানলে যারা তারকেশ্বরে বাবার মাথায় জল ঢালতে বাঁক কাঁধে জল নিয়ে রাতভোর হাঁটেন তাদেরকে আরও বেশি যোগ্য লোক বলতে হয়। আমাদের দিদি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো দেশে, বিদেশে শহরে গ্রামে, পাহাড়ে, মিছিলে বরাবরই হাঁটেন। হেঁটেই তিনি মানুষের কাছে পৌঁছে যান। দেশবিদেশের রাস্ট্রনায়করাও তার এই হাওয়াই চটি পরে হেঁটে যাওয়া দেখে বিস্মিত হন। মোদী ম্যানেজারদের একথা বলতে হচ্ছে কারণ,ঘন ঘন বিদেশ সফর, দামী জামাকাপড় ইত্যাদির কারণে মোদীর ইমেজটা মোটেই মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষদের মত নয়। তাই তার ম্যানেজারদের একথা ফলাও করে বলতে হচ্ছে।
অটলজির প্রয়াণের পর মোদী-অমিতের রাতারাতি অটলপ্রেমী হয়ে ওঠা দেখে লোকে হাসছে। তাদের একটাই প্রতিক্রিয়া- জীবনে যারে তুমি দাও নি মালা, মরণে কেন তারে দিতে এলে ফুল। মানুষের এই উপলব্ধি মোদী-অমিতদের মুখে লাগানো অটলজির মুখোশটি বারবার টেনে খুলে দিচ্ছে।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )