হঠাৎ চমকে ওঠে হাওয়া
সেদিন আর নেই-
নেই আর সূর্য-বিকিরণ
আমার জীবনে তাই ব্যর্থ হল বাসন্তীমরণ!
আমার দরজায় নেমে এল
নিঃশব্দে উড়ন্ত গৃধিনীরা।
সেইদিন বসন্তের পাখি
উড়ে গেল
যেখানে দিগন্ত ঘনায়িত।
অবৈধ। কবি সুকান্তের লেখা কবিতার কয়েকটি লাইন। অসমে কলমের এক খোঁচায় একসঙ্গে ৪০ লক্ষ মানুষকে যে ভাবে অবৈধ নাগরিক ঘোষণা করা হয়েছে, তার প্রেক্ষিতে কবির অমোঘ এই লাইন গুলিই মনে পড়ল।
ভারতে একজন অবৈধ অভিবাসী হলেন ভারতীয় আইন দ্বারা নির্ধারিত সরকারী অনুমতি ব্যতীত ভারতে বাসকারী একজন ব্যক্তি। যারা স্পষ্টভাবে শরণার্থী হিসাবে সুনির্দিষ্টভাবে মঞ্জুরিপ্রাপ্ত তারা এই বিভাগের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু অবৈধ অভিবাসী ও শরণার্থীর মধ্যে বিভাজনটা করবে কে? রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, সুপরিকল্পিতভাবে যদি একটি গোষ্ঠীকে রাতারাতি অবৈধ ঘোষণা করা হয়, তাহলে কি এই প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে কি আদৌ প্রশ্ন উঠবে না?
যে খসড়া নাগরিকপঞ্জী অসমে প্রকাশ করা হয়েছে তার জন্য বহু দশক ধরে লড়াই করছে আসু এবং এজিপি। এই দুই সংগঠনই দাবি করে তারাই আসলে ভূমিপুত্র, অন্য ভাষাভাষীর মানুষ সবাই অভিবাসী।
অসমে ১৯৬০-এর দশকে “বাঙ্গাল খেদাও” আন্দোলন শুরু হয়েছিল। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের ফেরত পাঠানোর দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। এক সময়, “বাঙ্গাল” বলতে সমস্ত বিদেশীদের বোঝানো হত। সময়ের সাথে সাথে, ঔপনিবেশিক শাসনকালে এই শব্দটি শুধুমাত্র বাঙালিদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয়।
সমসাময়িক বিশ্ব ব্যবস্থায়, কোন রাষ্ট্র একতরফাভাবে অভিবাসন করতে পারে না। শুধু একটি রাষ্ট্র সিদ্ধান্ত নেয় যে একজন ব্যক্তি অন্য দেশের নাগরিক, অন্য দেশটি এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য নয়। বড়জোর অন্য দেশের সংশ্লিষ্ট নাগরিকদের ফেরত পাঠানোর জন্য দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর করা যেতে পারে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে এমন কোনও চুক্তিই নেই। তাই যে ৪০ লক্ষ মানুষকে রাতারাতি অবৈধ ঘোষণা করা হল, তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো যেতে পারে না।
এনআরসির খসড়ায় বাদ পড়া অন্তত ২২ লক্ষ নাম হিন্দু বাঙালির। কিন্তু মিডিয়াতে ধুঁয়ো তোলা হচ্ছে যে বেশিরভাগ অনুপ্রবেশকারীই নাকি মুসলমান। এনআরসি সম্পন্ন হওয়ার আগেই সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট বিল, ২০১৬ পাস করার জন্য কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দল (বিজেপি) চেষ্টা চালিয়ে যাবে, এমন যথেষ্ট সংকেত রয়েছে। কিন্তু অসমে বিলটি নিয়ে তাদের প্রতিবাদের মুখে পড়তে হবে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ থেকে আগত হিন্দুও অননুমোদিত অভিবাসী হিসেবে গণ্য হবে, যা বিজেপি চায় না।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকের, মোহাম্মদ আজমল হক, নামটি তালিকায় পাওয়া যায় নি। অনেক ক্ষেত্রে স্বামীর নাম তালিকায় আছে, স্ত্রীর নাম নেই; বাবা-মার নাম আছে, কিন্তু সন্তানের নাম নেই। বাঙালি মুসলমানরা, সাধারণত যাদের বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী বলে সন্দেহ করা হয়, বঞ্চিত। লক্ষ লক্ষ হিন্দুদের নাম, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই বিজেপি সমর্থক, তালিকার বাইরে রয়েছে। গোর্খা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা বলছেন যে কমপক্ষে তাদের এক লাখ লোক তালিকাভুক্ত নয়। এমন অনেক ইঙ্গিত রয়েছে যে বোড়ো সম্প্রদায়ের অনেক দরিদ্র পরিবারের অনেক সদস্যরাও তালিকার বাইরে রয়েছেন। অন্যদিকে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন হিন্দিভাষীদের নাকি এই তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হবে না।
হয়তো এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে অবশেষে এদের মূল বাসিন্দাদের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হবে। তবে, অসমের মূল বাসিন্দা হওয়ার যোগ্যতাটি কেউই নির্ধারণ করেনি। এবং এই যোগ্যতার মানদন্ড হিসেবে মেয়াদের কোনও সংজ্ঞা নির্ধারণ করার জন্য একটি আবেদন সুপ্রিম কোর্ট খারিজ করেছে। অসমের বিভিন্ন অংশে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন বাসিন্দা ছিল যারা মূল বাসিন্দা হওয়ার দাবি করতে পারে।
চলার নামই জীবন। রাষ্ট্র তো একটা ভূখন্ড মাত্র। ইতিহাসের নিদারুণ পরিহাসের ফলে যাদের ভিটেমাটি ছেড়ে অন্য জায়গায় নিজের ‘মাটি’ খুঁজতে হয়, তাদের কথা কি ভাববে না রাষ্ট্র?
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )