ভারতীয় উপমহাদেশে সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতি হওয়া সত্ত্বেও প্রতিবেশীদের কাছে কার্যত একঘরে হয়ে গিয়েছে ভারত। বৈদেশিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, গত সাড়ে চার বছরে ভারত যে বিদেশনীতি অবলম্বন করে চলেছে, তাতেই বিরূপ হয়ে গিয়েছে প্রতিবেশী দেশগুলি। কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও সেই সম্পর্কের মধ্যে কোনও আন্তরিকতা নেই। আগে প্রতিবেশী দেশগুলির যে আস্থা ছিল ভারতের প্রতি, এখন তার বিন্দুমাত্রও নেই। সেই ফাঁকা জায়গা ধরে নিয়ে দ্রত ভারতীয় উপমহাদেশে নিজের প্রভাব বাড়াচ্ছে চিন। যা ভারতের পক্ষে রীতিমতো আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ডোকলাম ইস্যু সম্প্রতি সংবাদ মাধ্যমে সাড়া জাগিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার দাবি করছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে চিনের শীর্ষনেতা শি জিন পিঙের বৈঠকর মধ্যে দিয়েই ডোকলাম সমস্যা সমাধানের সূত্র মিলেছিল। কিন্তু এই সমাধানে ভারতের কী আদৌ কোনও লাভ হয়েছে? বিদেশ মন্ত্রক এ প্রশ্নে নীরব।
ভূটান, ভারত এবং চিনের সীমান্ত সংলগ্ন ডোকলাম ভূখণ্ডটি ভূটানের। যেহেতু সামরিক ক্ষেত্রে ভূটান ভারতের ওপরে অনেকটাই নির্ভরশীল, সেহেতু ডোকলামে চিন সেনা সমাবেশ করলে ভারতও পাল্টা সেনা সমাবেশ করে। চূড়ান্ত উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। কিন্তু ভারতের নিরাপত্তা পড়ে গেল প্রশ্নের মুখে। চিনের নাগালের মধ্যে চলে এল সিকিম এবং উত্তরপূর্বাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র সড়কপথ চিকেন নেক বা শিলিগুড়ি করিডোর।
গত সাড়ে চার বছরে ভারতের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হল দীর্ঘদিনের বন্ধু নেপালের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক শীতল হয়ে যাওয়া। নেপালের বর্তমান ক্ষমতাসীন কমিউনিষ্টরা ভারতের প্রতি, বিশেষ করে নরেদ্র মোদী সরকারের খুব একটা আস্থাভাজন নন। বরং তাঁদের সঙ্গে চিনের সম্পর্ক অনেকটাই সহজ। নেপালের গত নির্বাচনে ভারত বহু চেষ্টা করেও পুরনো বন্ধু নেপালি কংগ্রেসকে ক্ষমতায় ফেরাতে পারেনি।
অপরপক্ষে চিনের উদ্যোগেই নেপালের মাওবাদীদের সঙ্গে এমালে সংযুক্ত হয়ে সে দেশের বৃহত্তম চিনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি গঠনয়করতে চলেছে। এরই স্বাভাবিক ফলশ্রুতি হিসাবে ইতিমধ্যেই নেপাল ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক শীতলতার পর্ব শুরু করে দিয়েছে।
শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপ গত শতকের আটের দশকে তাদের অভন্তরীণ সমস্যার ক্ষেত্রে ভারতের থেকে সামরিক সহায়তা নিয়েছে। কিন্তু মোদী জমানায় মালদ্বীপের অভ্যন্তরীণ গোলমাল সামাল দিতে চিনা নৌবহরকে নোঙর ফেলতে দেখেও ভারতকে চুপ করে বসে থাকতে হয়েছে। বস্তুতপক্ষে মালদ্বীপকে ঘাঁটি করেই ভারত মহাসাগরে চিনা আধিথত্য ক্রমশই বিস্তৃত হচ্ছে। শ্রীলঙ্কার উপকূলের একইভাবে ভারতকে চরম উদ্বেগে রেখে চিনা নৌবহর নোঙর ফেলে রেখেছে।
দেশভাগের পর থেকে যে ভারত-পাক সম্পর্ক মধুর ছিল, একথা বলা যাবে না। ১৯৬৫ এবং ১৯৭১ সালে দু‘টি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ ছাড়াও ছায়াযুদ্ধের পরিস্থিতি সর্বক্ষণ বজায় থেকেছে। কিন্তু মোদী জমানায় পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। তথ্য বলছে, ইউপিএ জমানার তুলনায় এনডিএ জমানায় সীমান্ত সংঘর্ষ বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। উরি এবং পাঠানকোটের দুই সেনাঘাঁটিতে পাক হামলা হয়েছে। কাশ্মীর সমস্যাও ক্রমশই তীব্র হচ্ছে। কূটনৈতিক দৌত্যের এত গভীর ব্যর্থতা আগে কখনও ভারতের ক্ষেত্রে হয়নি।
প্রতিবেশীদের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশের সঙ্গেই ভারতের সম্পর্ক কিছুটা অম্লমধুর। কেননা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদকে তাঁর একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা জিয়াকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে ভারতপন্থী হতে হয়েছে। কিন্তু ভারতের জাতীয় নাগরিক পঞ্জির তালিকা প্রকাশ হওয়ার পরে দুই দেশের সম্পর্ক কোন খাতে বহমান হবে, তা বলা মুশকিল।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )