১৯৭৭ সালে ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেসের বিপুল পরাজয়ের পর জনতা সরকারের সদ্য শপথ নেওয়া পররাষ্ট্র মন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ি যখন বিদেশমন্ত্রকে প্রথমদিন প্রবেশ করলেন, তখন দেখেছিলেন, অত্যন্ত প্রত্যাশিতভাবে গোটা দপ্তর ঝকঝক করছে এবং কার্পেট থেকে পর্দা সবই আমূল বদলে ফেলা হয়েছে। এটা দস্তুর। নির্বাচনে সরকারি পালাবদলের পর চেষ্টা করা হয় পূর্ববর্তী সরকার তথা শাসক দলের স্বাক্ষর হিসাবে থাকা তাবৎ চিহ্ন সরিয়ে ফেলার। বিদেশমন্ত্রকে প্রবেশ করে নতুন মন্ত্রী বাজপেয়ি লক্ষ্য করলেন তাঁর দপ্তরের একটি দেওয়ালে কালো দাগ রয়ে গিয়েছে। তাঁর চকিতে মনে পড়ে গেল কেন ওই জায়গাটি শূন্য এবং কেন ওই কালো দাগ। তিনি সচিবকে বললেন, এখানে পন্ডিতজীর ছবি ছিল না? সেটা কোথায় গেল? সচিব আমতা আমতা করছেন। বোঝা গেল ইন্দিরা গান্ধীর পিতা জওহরলাল নেহরুর ছবি স্বাভাবিক কারণেই সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কারণ নেহরুর কন্যা জরুরি অবস্থা জারি করার পর বাজপেয়িকে জেলে ঢুকিয়েছিলেন। সুতারং খুব স্বাভাবিক এতদিন পর প্রথম দেশে এক অকংগ্রেসি সরকার আসার পর আর যাই হোক নেহরু পরিবারকে স্থান দেওয়া হবে না। কিন্তু সকলকে অবাক করে দিয়ে বাজপেয়ি বলেছিলেন, পন্ডিতজীর ছবি যেমন ছিল তেমনই রেখে দিতে হবে। আবার টাঙিয়ে দিন। এটাই ছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ি। তিনি রাজনৈতিক বিরোধ নিয়ে কখনও ব্যক্তিগত অসূয়া অথবা দূরত্ব তৈরি করতেন না। বস্তুত ঠিক এই কারণেই বাজপেয়ি যুগের তুলনায় নরেন্দ্র মোদী যুগের ফারাক অনেক বেশি স্পষ্ট।
মোদী যুগে ঠিক উলটো। দেশের যা কিছু ব্যর্থতা তার সবকিছুর ক্ষেত্রেই নেহরুকে দায়ী করাই নয়া বিজেপির মন্ত্র। বাজপেয়ি ছিলেন ভারতে সফল জোট রাজনীতির জনক। বিজেপি একক বৃহত্তম দল হলেও বাজপেয়ির আমলে বিজেপির মধ্যে বিগ ব্রাদার সুলভ মনোভাব ছিল না। সেই কারণেই ২৩টি দল নিয়ে এনডিএ জোট গঠন করতে পেরেছিলেন বাজপেয়ি। এবং বিজেপির উপর রাগ করে নয়, সম্পূর্ণ আঞ্চলিক রাজনীতির বাধ্যবাধকতায় কখনও জয়ললিতা, কখনও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রা সেই এন ডি এ জোটের বিপক্ষে গিয়েছেন অথবা জোটের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে কোনও জোটশরিক এমনকী বিরোধী দল কংগ্রেসও বাজপেয়ির সঙ্গে সম্পর্ক তিক্ত করেনি কখনও। ১৯৯৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর এনডিএ সরকারের চারজন মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে গিয়ে এক সকালে অনেকক্ষণ ধরে বলেছিলেন, সোনিয়া গান্ধীর বিরুদ্ধে কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। সবটা শুনেছিলেন প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী। সবশেষে সকলের বলা সমাপ্ত হওয়ার পর তিনি শুধু বলেছিলেন, তাহলে আমাদের সঙ্গে কংগ্রেসের পার্থক্য কী থাকবে? ক্ষমতায় এসেই যদি বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, এটা তো কংগ্রেসি কালচার! আমরা কংগ্রেসকে কেন নকল করব? মোদী সরকারের আমলে কিন্তু ঠিক উলটোটাই হচ্ছে। বিরোধীদের সবরকমভাবে টার্গেট করা হচ্ছে বিগত সাড়ে চার বছর ধরে। সুতরাং ২০০৬ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণের পর যে বিজেপিকে তিনি ছেড়ে যান সেই বিজেপির আমূল বদল ঘটেছে পরবর্তী সময়ে। বারংবার তাই এখনও বাজপেয়ির বিজেপি এবং মোদীর বিজেপির প্রতিতুলনা হয় অহরহ। ২০০২ সালের গুজরাত দাঙ্গার পর এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ি গুজরাত সফরে যান দাঙ্গাপীড়িত এলাকা পরিদর্শনে। তিনি ফেরার সময় আমেদাবাদে বলেছিলেন, আমি আশা করি মুখ্যমন্ত্রী রাজধর্ম পালন করবেন। তার আগে বাজপেয়ীর উপর প্রবল চাপ ছিল মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে মোদীকে সরিয়ে দেওয়ার। সেদিন যে মোদীকে বাজপেয়ি রাজধর্ম পালনের পরামর্শ দিয়েছিলেন, সেই মোদী তার মাত্র ১২ বছরের মধ্যেই বাজপেয়ির দল ও রাজপাটের প্রধান হয়ে উঠেছেন। বাজপেয়ি যা পারেননি তিনি সেটা অর্জন করেছেন। সেটি হল দলের একক গরিষ্ঠতা প্রাপ্তি। বাজপেয়ি সর্বজনমান্য নেতা হলেও দলের উপর তাঁর একচ্ছত্র রাশ ছিল না। কারণ দলের উপর কমবেশি সমান প্রভাব ছিল আর এক নক্ষত্রেরও। লালকৃষ্ণ আদবানি। বাজপেয়িকে প্রতিটি জোট শরিকের মন যুগিয়ে চলতে হয়েছে। সরকার চালাতে হয়েছে সতর্কভাবে। কিন্তু মোদী তাঁর দলেই নয়, সরকারেও একক শক্তিসম্পন্ন। কিন্তু তবু মোদীকে আরও কিছু পথ চলতে হবে। অপেক্ষা করতে হবে। কারণ বাজপেয়ি নিছক বিজেপির নয়, এনডিএর নয়, হয়ে উঠেছিলেন জনগণের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর রাজনীতির বিরোধী ছিল বিরোধীরা। ব্যক্তিবিরোধ ছিল না। এখন কিন্তু বিজেপি নয়, বিরোধীদের টার্গেট মোদীই!