মে দিবস আর স্বাধীনতা দিবসে আমি যেন তেন প্রকারে ছুটি নিই। এদিনগুলোতে কাজ করলেই একটা সর্বহারা কমপ্লেক্স কাজ করে। তখন শৃঙ্খল ফিঙ্খল ভেঙে খিস্তি করে দিই উচ্চনেতৃত্বকে৷ ইয়ে মানে আপিসে। হঠাৎ লেবার ল’ জেগে ওঠে প্রানে। আদপে হিনমন্নতা আর চিত্তব্রত মজুমদারের রাজ্য থেকে আসার দাপট।
তো এ বছর ও বার্ষিক ভারতমাতা পুজোয় ছুটি নিয়েছিলাম। চাঁদবদনে আগে পাড়ার পতাকা উত্তোলনে যেতাম। জিলিপি ও সিঙ্গারা আজাদির থেকে ও লোভনীয় ছিল৷ একবার শেষ মুহুর্তে চিফ গেস্ট ধোকা দিয়ে দাওয়ায় আমার মাকে পতাকা উত্তোলনে অনুরোধ করা হয়। অবশ্যই পরিচয় দেওয়া হয় এলাকার বিশিষ্ট চিকিৎসক হিসেবে৷ তখন কে দেখে আমার ছাপান্ন ইঞ্চির ছাতি। বাড়ি থেকে উষার মাঠ ২০০মিটার। মাকে স্বসম্মানে আনতে ১০০টাকা রিক্সা ভাড়ার খরচ আমাকে দেওয়া হয়৷ ভাড়া ২০, বাকি আমার কাটমানি। উপরি হিসেবে আমার টিমের তিন বন্ধু ও আমাকে স্পেশাল গেস্ট প্যাকেট ও দেওয়া হয়। তখন রে ও মারটিন ভরসা। অক্সফোর্ড ইংরেজি ডিকশনারিতে নেপোটিজমের মানে থোড়াই জানি। সে প্রাগৈতিহাসিক কাল। কলকাতায় লোডশেডিং হতো।
আজ সকাল সকাল বাজারে গেছিলাম। হারুনের দোকানে মাংস কিনলাম৷ সে ব্যাটা অন্যদিন ফেজ টুপি পরে মাংস কাটে, আজ গোটা দোকান চেন ফ্ল্যাগে মুরে দিয়েছে। বাড়তি মেটে ও গিলে ফ্রি এক কেজির ওপর মুরগি কিনলে।
সব্জি বেচে যে সৈফুল সে দিনাজপুরের। যদিও মাঝে মধ্যেই নয়ডা পুলিশ বাংলাদেশী বলে জেলে ঢুকিয়ে দেওয়ার ভয় দেখায় ওকে৷ ওর একটা মিষ্টি বউ আছে। ঘোমটা পরে বাঙাল ভাষায় সব্জি বেচে। ওদের এনআরসি হয়নি এখনো। তাই হুমকি আসে বা টাকা যায়। এসব তখনই হয় যখন তোলা কম পরে।
সৈফুল আজ গাজর আর লংকার মাঝে রসুন রেখে জাতীয় সব্জির পতাকা বানিয়েছিল৷ যদিও বেটাচ্ছেলে ২০টাকার আলু নিলো ২৫। আর ক্যাপসিকাম পচা দিলো।আমি ও অবাঙালি ক্রেতা একসাথে প্রতিবাদ করায় বলে “আজাদি কা জশন মে”। আমরা চুপ৷ আজাদি ওর ও বটে৷
বন্ধুবর সোহমের সাহায্য নিয়ে তরল স্টক করে রেখেছি আগেই৷ এসব দিনেই তো গ্যালন গ্যালন গিলতে হয় আর মুতে পাকিস্তানিদের পগার পাড় করতে হয়৷ পিছনে হাই ভলিইউমে চলবে রহমান। আর রাত নটায় নেশন যা জানতে চায়। হিক! কেনার মধ্যে সোডা, গিন্নির জন্য মিষ্টি দই, চিপস, একটা দুধের প্যাকেট। ফুল ক্রিম।
মোদি সাহেবের দৌলতে আজ সবাই ডিজিটাল ওয়ালেট ব্যবহার করে। ক্যাশ পকেটে থাকেই না। তবু আজ বার্ষিক ভারতমাতা পুজো। আজ পাছা মোটা মানি ব্যাগ নিয়ে গেলাম মেগাস্টোরে। ওখানে আলপিন টু আমলকি সব পাওয়া যায়।
নির্দিষ্ট সময় নির্দিষ্ট জিনিস কেনা হয়ে গেলে ও ওখানে একটা লম্বা লাইন দিতে হয়৷ ওই সময় আরো কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস তুলে নেওয়া যায়। এই যেমন ডিসকাউন্ট এ ডিওস্প্রে,স্টক ক্লিয়ারেন্স চকোলেট, বাক্সবন্দি লজেন্স, দশটাকার রেজার ইত্যাদি।
আমার সামনেই যে লাইনে, ওর হাতে একটা দুধ আর একটা ডালের প্যাকেট ছিল। আর একটা একশো টাকার নোট। ক্যাশ কাউন্টারে সারি সারি পতাকা৷ ওর ভারী শখ হল একটা পতাকা কিনবে। পাঁচটাকা দাম৷ একশো চারটাকা বোধহয় হয়েছিল। ছুট্টা নেই৷ কাউন্টারের কর্মচারী চারটাকা দিতে বলে৷ নেই।
আমার কৌতূহল জাগলো এরপরের ঘটনা নিয়ে৷ কি হবে? তবে কি জাতীয় পতাকা রেখেই ওকে চলে যেতে হবে? জাতীয়তাবাদী ক্রেতা পুঁজিবাদের কাছে হেরে যাবে ইত্যাদি। আমার এঁদো পচা মনকে শান্ত করে কর্মচারী বললো ওকে, যান পরে দিয়ে যাবেন। চারিদিক থেকে বিউগলের শব্দ। গলার কাছে দলা পাকানো দেশত্ববোধ। এই তো চাই কাকা।
এবার আমার পালা। সোডা, দই, চিপস, দুধের প্যাকেট রাখলাম৷ চোখে এক অদ্ভুত সানি দেওলের উজ্জ্বলতা৷ কাউন্টার থেকে উঠে এলো বানী : স্যার ১৯৪ টাকা। গান্ধীজী রেডি৷ দুটো নোট এগিয়ে দিলাম।
অফিসে তিরঙ্গা ব্যাজ পেয়েছি। লোকাল নেতার থেকে গাড়িতে লাগানোর পতাকা। বাড়িতেও সৌখিন ফ্ল্যাগ আছে৷ ফ্ল্যাটে ঢোকার মুখে ও। জাতীয়তাবাদে কমতি নেই৷
কাউন্টারের কর্মচারী ২০০ টাকা নিয়ে অম্লানবদনে একটা ফ্ল্যাগ ও একটা ক্লোরমিন্ট ফেরত দিলো। ফ্ল্যাগের দাম বাজার ঠিক করেছে পাঁচটাকা। আর একটাকার মাউথফ্রেশনার।
জিজ্ঞেস করেছিলাম, ছুট্টা নেহি হে? রাগত চোখে ভাই আমার বললো, নেহি। ইসিলিয়ে তিরঙ্গা দিয়া।
আমার স্বাধীনচেতা অর্থে কেনা পাঁচটাকার তিরঙ্গা। ছুট্টার বদলে৷ বাজারনিয়ন্ত্রিত দেশত্ববোধ। ক্রেতার বা বিক্রেতার ছুট্টা না থাকলে। ওটা ফ্রিই।
( মতামত লেখকের ব্যাক্তিগত)