শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সেক্রেটারি থাকার সময়ই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন সাংস্কৃতিক জ্ঞান, উদারনীতি এবং রাজনৈতিক যুক্তিবাদিতা দিয়েই নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়। তবেই নেতা হিসাবে একজন দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। নিজের শাসনকালে সেই বার্তাই তিনি দিয়েছেন বারবার। প্রয়োজনে কড়া হয়েছেন, আবার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সবাইকে নিয়ে চলতেও পেরেছিলেন। হ্যাঁ, তিনি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারি বাজপেয়ী। যিনি বৃহস্পতিবার শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন। তবে গোটা দেশের কাছে রেখে গেলেন পথ চলার বার্তা। একদিকে কবি, অন্যদিকে সুবক্তা তথা অসাধারণ সাংসদ ছিলেন তিনি। তাই রাজনৈতিক মহলের সর্বস্তরে জনপ্রিয়ও হয়ে উঠতে পেরেছিলেন তিনি। যিনি মনে করতেন প্রত্যেকেরই আগে মানুষ হওয়া দরকার। তবে তো দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে। মানুষ হওয়া মানে বিনয়ী হওয়া, কিন্তু দুর্বল হওয়া নয়। মানুষ হওয়া মানে শক্তিশালী হওয়া, হিংস্র হওয়া নয়। তাই তাঁর প্রয়াণে রাজনৈতিক ধ্রুবতারার পতন ঘটল বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।
১৯২৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়রে মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন অটলবিহারি বাজপেয়ী। বাবা কৃষ্ণাবিহারি বাজপেয়ী ছিলেন স্কুল শিক্ষক ও কবি। মা কৃষ্ণা দেবী। ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মেও তিনি সবসময়ই ছিলেন উদারমনস্ক। গোয়ালিয়রের স্বরস্বতী শিশু মন্দিরে জীবনের প্রথম পাঠ নেন তিনি। স্কুল জীবন শেষ করে ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে পাশ করেন স্নাতক। তারপর কানপুরের অ্যাংলো–বৈদিক কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। আসলে যুব বয়সেই তিনি বুঝেছিলেন দেশকে রক্ষা করতে হলে রাজনীতিই একমাত্র পথ। স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন। ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। ১৯৩৯ সালে যোগ দেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘে (আরএসএস)। তিনি রাষ্ট্রধর্ম হিন্দি মাসিক পত্রিকায়, পঞ্চজন্য হিন্দি সাপ্তাহিক এবং স্বদেশ ও বীর অর্জুন দৈনিক কাগজে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। সারাজীবন রইলেন অবিবাহিত। কাজ করে গেলেন দেশের জন্য। দত্তক নিয়েছিলেন মেয়ে নমিতাকে। ১৯৯৮ সালে রাজস্থানের পোখরানে পাঁচটি পারমানবিক বোমা পরীক্ষা করে নিজের সরকারের দৃঢ়তা যেমন বুঝিয়েছিলেন, তেমনি গুজরাটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনায় নিজের দলের মুখ্যমন্ত্রী বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বলেছিলেন রাজধর্ম পালন করতে। কারণ তিনি খুব কষ্ট অনুভব করেছিলেন গোধরা দাঙ্গায় নিহত মানুষদের জন্য। আবার ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনায় আক্ষেপ করে বলেছিলেন, এই ঘটনা বিজেপির সবচেয়ে খারাপ ও ভুল কাজ। তাই তো আজও তাঁর জন্মদিন ২৫ ডিসেম্বরকে পালন করা হয় সুশাসন দিবস হিসাবে।
১৯৫৭ সালে লোকসভা নির্বাচনে বলরামপুর আসন থেকে জয়ী হয়ে প্রথম সংসদে প্রবেশ করেন অটলবিহারি বাজপেয়ী। তারপর একের পর এক সাফল্য তাঁর ঝুলিতে প্রবেশ করেছিল। তবে তার জন্য তাঁকে কোনও ছলচাতুরি করতে হয়নি। ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন জারি করা জরুরী অবস্থার বিরুদ্ধে ১৯৭৫ সালে জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে আন্দোলনে নেমেছিলেন। কিন্তু সেখানেও তিনি মেনেছিলেন রাজনৈতিক সীমারেখা। জনসংঘ পরিণত হয়েছিল জনতা পার্টিতে। ১৯৭৭ সালে মোরারজি দেশাইয়ের সঙ্গে জনতা পার্টি জোট করে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়েছিলেন বাজপেয়ী। বিদেশমন্ত্রী হিসাবে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায় তিনিই প্রথম হিন্দি ভাষায় বক্তব্য রেখেছিলেন। ১৯৮০ সালে লালকৃষ্ণ আদবানি, ভৈরব সিং শেখওয়াত সহ–বিভিন্ন নেতাদের নিয়ে তৈরি করেছিলেন ভারতীয় জনতা পার্টি। দশবারের সাংসদ হিসাবে ৫০ বছর সাংসদ হিসাবে নজির গড়েছিলেন প্রবীণ এই রাষ্ট্রনেতা। ১৯৯৬ সালে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে না পারায় ১৩ দিনের মাথায় পদত্যাগ করতে হয়। ১৯৯৮ সালে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু জোট সরকার থেকে এআইএডিএমকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেওয়ায় ১৩ মাসের মাথায় সরকার পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ১৯৯৯ থেকে ২০০৪ সালে মেয়াদ পূর্ণ করেছিলেন অকংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারি বাজপেয়ী। ভারত–পাকিস্তানের মধ্যে শান্তিস্থাপন করতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশারফের সঙ্গে আগ্রা সামিট চুক্তি সাক্ষর করেছিলেন। কাশ্মীরে শান্তি বজায় রাখতে দিল্লি–লাহোর বাস সার্ভিস চালু করেছিলেন ১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। কিন্তু পাকিস্তান তখন পিছন থেকে ছোড়া মেরে আক্রমণ করেছিল কার্গিল। তখন ভারতীয় সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি যুদ্ধের। দুর্গম এলাকায় ভারতীয় সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশের মাটি রক্ষার্থে। নাম ছিল সেই যুদ্ধের অপারেশন বিজয়। জয়ী হয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী। যা তাঁর সাফল্যের আর একটি দিক। বহু বিদেশি বিনিয়োগ তাঁর আমলে এদেশে এসেছিল। জাতীয় সড়কগুলির উন্নয়ন এবং প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার জন্য তাঁর নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আর ২০০৪ সালে এনডিএ সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতি থেকে চিরতরে নিজেকে সরিয়ে নেন এই রাষ্ট্রনায়ক। যাঁর ঝুলিতে রয়ে গিয়েছে, লিবারেশন ওয়ার অ্যাওয়ার্ড, পদ্মবিভূষণ, ডি লিট, লোকমান্য তিলক পুরষ্কার, সেরা সাংসদ পুরষ্কার, ভারতরত্ন পণ্ডিত গোবিন্দ বল্লভ পান্থ পুরষ্কার এবং ভারত রত্ন।