মমতাকে আক্রমণ করতে গিয়ে বাংলার জনমতকেই অপমান করেছেন অমিত শাহ। রবিবার দিনভর দলের ধিক্কার দিবস থেকে এমনই দাবিতে বিজেপি বিরোধিতায় গর্জে উঠল তৃণমূল। তৃণমূলের বক্তব্য, ক্ষমতায় বসার পর থেকে সবস্তরের নির্বাচনে বাংলার রায় গিয়েছে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে। নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রীর তখতে বসা ইস্তক তাঁর জনপ্রিয়তার পারদ ক্রমে নিম্নমুখী। একাধিক উপনির্বাচনে গেরুয়া শিবিরের পরাজয় অব্যাহত। উল্টে প্রায় আট বছর রাজত্ব চালিয়েও নির্বাচনী সাফল্যের নিরিখে মমতা দিনকে দিন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছেন। সাম্প্রতিক পঞ্চায়েত ভোটের ফলেও তার যথাযোগ্য প্রমাণ মিলেছে। সেই তৃণমূল নেত্রীকে নিশানা করে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ বাংলা দরদি হতে গিয়ে বাংলার মানুষকেই আঘাত করে বসেছেন—এমনটাই মনে করছে রাজ্যের শাসকদল।
অসমের নাগরিকপঞ্জি বিতর্কের প্রেক্ষিতে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিদেশি চিহ্নিতকরণের নামে অসমের ৪০ লক্ষ বাসিন্দার নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে সদ্য প্রকাশিত এনআরসি’র চূড়ান্ত খসড়া তালিকা। যার মধ্যে অনুপ্রবেশকারীর সঙ্গে স্থান হয়েছে বহু বৈধ ভারতীয় নাগরিকেরও। বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবারের মতে, বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষকে ফেরত পাঠাতে হবে। রাজনৈতিক মহলের মতে, এই প্রশ্নে তারা ধর্মীয় বিভাজনকে উস্কে দিতে চাইছে। যার ফলে অহিন্দু বাংলাভাষীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গেও এনআরসি’র দাবি তুলেছে বিজেপি। দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ একধাপ এগিয়ে ক্ষমতায় এলে অনুপ্রবেশকারীদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাড়ানোর নিদান দিয়েছেন। ফলে, এ রাজ্যের সাধারণ মানুষও শঙ্কিত। স্বভাবতই বাংলাভাষী নাগরিকদের পাশে দাঁড়িয়ে এনআরসি’র প্রতিবাদে সরব হয়েছেন মমতা। আর তাতেই বাংলায় পায়ের তলার মাটি সরে যাওয়ার আশঙ্কা গ্রাস করেছে গেরুয়া শিবিরকে এবং শনিবার অমিত শাহের বক্তব্যে তার ইঙ্গিত আরও স্পষ্ট হয়েছে বলে মনে করেন তৃণমূল মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, বাংলাজুড়ে যে জনমুখী উন্নয়ন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে হচ্ছে, তাকে রাজ্যের মানুষ সমর্থন করেছে। বিগত নির্বাচনে বারে বারে তার প্রমাণ মিলেছে। তাই বাংলা ও মমতা এখন অভিন্ন। সেই মমতাকে সরানোর কথা বলা মানে বাংলার উন্নয়নকে স্তব্ধ করে দেওয়া। পার্থর জিজ্ঞাসা, এতই যদি বাংলার প্রতি দরদ, তাহলে রাজ্যের উন্নয়ন খাতে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ ছাঁটাই হচ্ছে কেন? সম্প্রতি দূরশিক্ষায় বাংলার একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়কে বাদ দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রের নীতিতে পদে পদে রাজ্যবাসী বিপাকে পড়ছে। তা নিয়ে অমিত শাহদের মুখে কথা নেই। রাজ্যের মানুষের জন্য কোনও এজেন্ডা তাঁর দলের নেই। তৃণমূল মহাসচিবের মতে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে আক্রমণ করে অমিত শাহ প্রকৃত অর্থে বাংলার মানুষের মতামতকে অপমান করেছেন।
উল্লেখ্য, আগামী বছরের লোকসভা ভোটের পটভূমিতে মমতার রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা বেড়েই চলেছে। বিরোধী দলগুলিকে নিয়ে জোট প্রক্রিয়ায় একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থী দাঁড় করাতে তৎপর হয়েছেন তিনি। যে ফর্মুলা মানতে বাধ্য হয়েছেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীও। কারণ তিনিও জানেন, মমতার কৌশলে না গেলে মোদীকে হটানো কঠিন। তৃণমূলের মতে, মমতার এই জোট সক্রিয়তাই চাপে ফেলে দিয়েছে মোদী-অমিত বাহিনীকে। তাছাড়া বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে বিভেদের রাজনীতি প্রয়োগ করেও ফল মেলেনি। প্রধানমন্ত্রীর বহুচর্চিত আচ্ছে দিনের স্বপ্ন অধরা থেকে যাচ্ছে। জনপ্রিয়তায় ধস নামার অশনি সঙ্কেত পেয়েই বিজেপি বাংলার দিকে নজর দিয়েছে বলে রাজনৈতিক মহলের ধারণা। তাই নিজের সাংগঠনিক ভিত্তি ও উন্নয়নের এজেন্ডায় ভর দিয়ে মমতা যখন রাজ্যের ৪২টি লোকসভা আসন জেতার ডাক দেন, তখন বিজেপির সভাপতি অমিত শাহকে অনুপ্রবেশ রোখার নামে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি উস্কে ২২টি আসন জয়ের হুঙ্কার ছাড়তে হয়েছে। অন্য রাজ্যে জমি হারানোর আশঙ্কায় নতুন জমি খুঁজছে বিজেপি। পার্থর মতে, বাংলার কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সঙ্গে বিজেপি’র কোনও সম্পর্ক নেই। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনেও কোনও অবদান নেই সঙ্ঘের। নেই সংগ্রামের ইতিহাস। তিনি বলেন, মমতাকে আঘাত করলে যে বাংলার গায়ে লাগে, সেকথা বুঝতে পেরেছেন। বাংলাকে নয়, মমতাকে সরাতে চান বলে তাই সাফাই দিতে হয়েছে বিজেপির সভাপতিকে।
এদিন দলের ধিক্কার দিবসে একদিকে এনআরসি’র প্রতিবাদ, অন্যদিকে বিজেপি নেতাদের কুৎসা ও অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে তৃণমূল। রাজ্যের মন্ত্রী তথা শ্রমিকনেতা শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় বলেন, মমতাকে উৎখাতের কথা বলে বাংলা থেকে বঙ্গবাসীকে সরানোর কথা বলেছেন। আগামী লোকসভা ভোটে এর যোগ্য জবাব বাংলার মানুষই তাঁদের দেবে।