গোটা দেশের সামনে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিলেন তিনি। একটানা ৪০ বছরের সম্পর্ক যে দলের সঙ্গে, সাংবিধানিক দায়বদ্ধতার কারণে সেই দলেরই একেবারে বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে যেতে দ্বিধা করেননি। যে দলের পলিটব্যুরো সদস্য হয়েছিলেন, সেই দলই বহিষ্কার করতে পারে— এমন আশঙ্কা যে রয়েছে, তা আঁচ করছিলেন ভালই। কিন্তু কোনও আশঙ্কা, কোনও হুঁশিয়ারি, কোনও শাসানি হারাতে পারেনি সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে। কিন্তু এ বার তিনি হেরে গেলেন। ৮৯ বছর বয়সে আত্মসমর্পণ করলেন বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন অসুস্থতার কাছে।
জন্ম অসমের তেজপুরে। ১৯২৯ সালের ২৫ জুলাই, ব্রিটিশ ভারতে। বাবা নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তখন দাপুটে আইনজীবী এবং অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভার স্বনামধন্য নেতা। মা বীণাপানি দেবী। সোমনাথের পড়াশোনা অবশ্য কলকাতাতেই। প্রথমে মিত্র ইনস্টিটিউশন। তার পরে প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। তাতেই অবশ্য থামেনি শিক্ষা জীবন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শেষ হতেই সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় চলে যান বিলেত। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতক হন ১৯৫২ সালে। স্নাতকোত্তর ১৯৫৭ সালে। আইন পাশ করে দেশে ফেরেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা হাইকোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করেন।
সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেন ১৯৬৮ সালে। তবে বাবা নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দল হিন্দু মহাসভাতে যাননি তিনি। যোগ দেন সিপিএমে। তত দিনে নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিজেও অবশ্য অনেকটা দূরে সরে এসেছিলেন হিন্দু মহাসভা থেকে।
১৯৫২ সালে দেশের প্রথম লোকসভা নির্বাচনে হুগলি থেকে হিন্দু মহাসভার প্রার্থী হিসেবে জিতেছিলেন নির্মলবাবু। তার পরে ১৯৬৩ সালে নির্দল প্রার্থী হিসেবে তিনি জয়ী হন বর্ধমান লোকসভা কেন্দ্র থেকে। সিপিআই-এর সমর্থন ছিল তাঁর সঙ্গে। ১৯৬৭-তে ফের বর্ধমান থেকেই জয়ী হন নির্মলবাবু, ফের নির্দল প্রার্থী হিসেবেই। কিন্তু ১৯৭১ সালে সাংসদ থাকাকালীনই নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণ ঘটে।
বাবার প্রয়াণের বছর তিনেক আগেই সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় সিপিএমে যোগ দিয়েছিলেন। বাবার মৃত্যুতে শূন্য হওয়া আসনে তিনিই প্রার্থী হন। তবে সিপিএম প্রার্থী নন, নির্দল হিসেবে দাঁড়ান তিনি, সমর্থন দেয় সিপিএম। সোমনাথবাবু বর্ধমান থেকে জয়ী হন।
১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রের সিপিএম সাংসদ ছিলেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা হত্যার প্রেক্ষিতে হওয়া নির্বাচনে হেরে যান কংগ্রেস প্রার্থী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। ১৯৮৫ সালে বোলপুর লোকসভার উপনির্বাচনে ফের জেতেন সিপিএম প্রার্থী হিসেবে। সেই থেকে টানা ২০০৯ সাল পর্যন্ত সাংসদ ছিলেন। ১৯৮৯ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত লোকসভায় সিপিএম সংসদীয় দলের নেতা ছিলেন। ২০০৪ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত লোকসভার স্পিকার।
সিপিএমের সঙ্গে ৪০ বছরের সংযোগ অবশ্য শেষ হয়ে যায় ২০০৮ সালে। ইউপিএ-১ সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে নিয়েছিল বামদলগুলি। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় তখন স্পিকার। সিপিএমের তৎকালীন নেতৃত্ব চেয়েছিলেন, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ও সরকারের বিরোধিতাই করুন। কিন্তু তিনি রাজি হননি। স্পিকার হিসেবে তিনি কোনও দলের নন এবং অনাস্থার প্রক্রিয়া চলাকালীন তাঁকে নিরপেক্ষ ভূমিকাই নিতে হবে, সেটা তাঁর সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা— দলকে জানিয়ে দেন সোমনাথ। লোকসভার অন্দরে ভোটাভুটিতে সে বার টিকে গিয়েছিল মনমোহন সিংহের সরকার। কিন্তু হেরেও হারতে চাননি প্রকাশ কারাতরা। ২৩ জুলাই, ২০০৮, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে বহিষ্কার করে সিপিএম।
বাংলার সিপিএম কর্মী-সমর্থকরা খুব ভাল চোখে দেখেননি পার্টির সর্বোচ্চ নেতৃত্বের এই সিদ্ধান্ত। এ রাজ্যের সিপিএমের সর্বস্তরেই সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু বিমান বসুরা তা সত্ত্বেও সে দিন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধেই বয়ান দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার দিনটা তাঁর কাছে অত্যন্ত দুঃখের, ঘনিষ্ঠ বৃত্তে একাধিক বারই জানিয়েছিলেন সোমনাথবাবু। তবে দলে ফেরার আর কোনও চেষ্টা করেননি। ২০০৯ সালে স্পিকার পদে তাঁর মেয়াদ শেষ হয়। তার পরে আর সক্রিয় রাজনীতিতে থাকেননি। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় দলে ফিরে আসুন, এমনটা পরবর্তী কালে চেয়েছিল বাংলার পার্টি। সোমনাথবাবু একবার আবেদন করলেই দল বাকিটার ব্যবস্থা করে নেবে— এমন বার্তাও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সিপিএমে ফেরার আবেদন করতে আর রাজি হননি সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। অন্য কোনও দলেও কখনও যোগ দেননি তিনি।
গত কয়েক বছর ধরে বার্ধক্যজনিক অসুস্থতায় অশক্ত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক ইস্যুতে প্রয়োজন মতো মুখ খুলতে দেখা যেত তাঁকে। মাসখানেক আগে সেরিব্রাল অ্যাটাক হয় সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের। তার পর থেকেই আরও বেশি অশক্ত হয়ে পড়েন। সম্প্রতি শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা খুব বেড়ে যায়। প্রথমে বাড়িতেই কৃত্রিম ভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস চালানোর ব্যবস্থা হয়। পরে দক্ষিণ কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু বেশ কয়েক দিন ধরে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েও চিকিৎসকরা আর জীবনে ফেরাতে পারলেন না সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে।
চলে গেলেন প্রথম বাঙালি স্পিকার । অবসান হল সংসদীয় রাজনীতির একটি অধ্যায়ের।