ক-দিন আগে আনোয়ার শা রোডে ঢাকা কালী বাড়ির মোড়ের উল্টো দিকের মাজারটাতে দেখছিলাম হিন্দু, মুসলমান সবাই একসঙ্গে পীরের দরগায় মানত করছেন। এন আর সি বিতর্কের কোন আঁচ সেখানে পড়েনি। এভাবেই একসঙ্গে বাঁচে এই শহর। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না সবই আমরা একসঙ্গে ভাগ করে নিই। এই শহরের এটাই বেগ আবার এটাই আবেগ। দেশ ভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার উদ্বাস্তু স্রোত, ক্রমাগত প্রতিবেশী রাজ্যগুলি থেকে আসা মানুষের চাপ কোন কিছুই এখানকার মানুষের মুখের হাসি কেড়ে নিতে পারেনি। জাতীয় নাগরিক পঞ্জি তৈরির নামে বিজেপি আসামে যে সাম্প্রদায়িক তাসটি খেলেছে তাতেও এই শহরে সবাই মিলে একসঙ্গে থাকার মনোভাব বদলাবে না। বাংলায় এন আর সি কে যে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের অস্ত্র করা যাবেনা তা বিজেপিও এখন বুঝে গিয়ে উল্টো সুরে গাইবার চেষ্টা করছে।
প্রশ্ন হচ্ছে বিজেপি একাজ করল কেন? তারা কী সত্যিই জাতীয় নাগরিক পঞ্জি তৈরির ব্যাপারে সিরিয়াস? উত্তর হল না, এব্যাপারে তারা মোটেই সিরিয়াস নয়। এটা একটা ঠাণ্ডা মাথার গেম প্ল্যান। ২০১৯এর ভোটের আগে দেশের হিন্দু ও মুসলমান ভোটব্যাঙ্ককে একেবারে বিপরীত শিবিরে নিয়ে আসার জন্যই তারা খসড়া নাগরিক পঞ্জির তালিকা প্রকাশ করেছে। তারা জানে, তাদের বক্তব্য যুক্তিগ্রাহ্য নয় বলে বাতিল হয়ে যাবে। তখন তারা দুঃখ প্রকাশ করে ভুল স্বীকার করে নেবে। এরপর হিন্দু বাঙালিদের সামনে গাজরের মত ঝোলানো হবে, নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল। বিজেপি বলবে এই বিলের মাধ্যমে তারা যেসব হিন্দু বাঙালির নাম জাতীয় নাগরিক পঞ্জিতে নেই সেখানে ঢোকাবে। বিজেপির বিশ্বাস, এর ফলে হিন্দু, মুসলমান ভোট ব্যাঙ্কের যে মেরুকরণ হবে তার ফলে সব হিন্দু ভোট তারাই পাবে। জাতীয় নাগরিক পঞ্জি নিয়ে বিজেপির হৈচৈ-এর এ হল মূল রহস্য।
কিন্তু ঘটনা যা গড়াচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে তাদের মুখ পুড়তে চলেছে। এন আর সি-র কো-অর্ডিনেটর প্রতীক হাজেলা এবং রেজিস্টার জেনারেল অফ ইন্ডিয়া শৈলেশকে আসামের নাগরিক পঞ্জি তালিকা প্রকাশ নিয়ে এক্তিয়ার বহির্ভূত তৎপরতার জন্য ধমকেছে সুপ্রিম কোর্ট। তারা স্পষ্টভাবেই এই দুজনকে বলেছেন, তারা সরকারি আধিকারিক। তাদের কাজ নাগরিক পঞ্জি তৈরি করা, সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলা নয়। সমন পাঠিয়ে তাদের কোর্টে ডেকে এনে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদ্বয় একথা জানিয়েছেন। এই দুই আধিকারিক সত্যিই এন আর সি নিয়ে এক অস্বাভাবিক তৎপরতা দেখাচ্ছিলেন। হাজেলা বলতে শুরু করেন, কেন এদের নাম বাদ গেল? এদের ভবিষ্যৎ কী? বাদ পড়াদের কীভাবে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আসামে এন আর সি-র চূড়ান্ত খসড়া তালিকা প্রকাশ করার পরপরই প্রতীক ও শৈলেশ দাবি করেছিলেন এন আর সি-তে নাম তোলার ক্ষেত্রে নতুন নথি বিচার্য হতে পারে। বস্তুত এই দুজনের মন্তব্যের জেরেই জাতীয় রাজনীতিতে প্রবল তৎপরতা শুরু হয়। সুপ্রিম কোর্ট তাদের সরাসরি জিজ্ঞাসা করেছে, এসব কথা বলার আপনারা কে? এজলাস সূত্রে জানা গিয়েছে দুজনেই এ ব্যাপারে তাদের ভুল স্বীকার করেছেন।
বাংলার মানুষের আদালতেও বিজেপির এই বিভাজনের খেলা খুব একটা পাত্তা পাবেনা। কারণ, বহু কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে বাংলার মানুষ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখেছেন। আমাদের রামকৃষ্ণদেব বলেছেন, ‘যত মত, তত পথ’। কখনও বা তিনি বলেছেন, ‘কালী, কৃষ্ণ, খোদা, যিশু সব এক’। পবিত্র কোরানের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন গিরিশ চন্দ্র সেন। চৈতন্যদেবের শিষ্য ছিলেন যবন হরিদাস। বাংলায় ঈদ আর দুর্গা পুজো দুটোই কোন ধর্মের গণ্ডিতে আটকে না থেকে হয়ে উঠেছে রাজ্যের সব মানুষদের উৎসব। বিভেদের সংস্কৃতির এখানে দাঁত ফোটানোর কোন অবকাশ নেই। বাংলায় প্রতিটি মানুষের নিজের বিশ্বাস নিয়ে বাঁচার অধিকার আছে। নাগরিক পঞ্জি থেকে ৪০ লক্ষ মানুষ বাদ পড়া নিয়ে দিলীপ-রাহুলরা উচ্ছাসিত হলেও এ রাজ্যের সাধারণ মানুষ তাতে গলা মেলাননি। নজরুল লিখেছিলেন শ্যামা সঙ্গীত আর রবীন্দ্রনাথ লালনের সুর আর কথাকে মিলিয়েছিলেন তার গানে। ইসলামি দেহ আর বৈজ্ঞানিক মস্তিষ্ক নিয়ে এক গৌরবময় ভারত গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। এ বিবেকানন্দকে ধর্মের ভিত্তিতে দেশকে ভাগ করায় বিশ্বাসী বিজেপির বিবেকানন্দ ভক্তরা চেনেন না। চিনলে আসামে এন আর সি-র তালিকা প্রকাশ করে হিন্দু ভোট বাড়ানোর খেলায় নামতেন না।
আসল মুশকিলটা হল, বিজেপির থিঙ্ক ট্যাঙ্করা এদেশের মাটি ও মানুষ কোনটাকেই চেনেন না। এই লেখাটা লেখার একদিন আগে গিয়েছিলাম মার কাছে। মা বলল, অতগুলো লোককে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে? ওরা কোথায় যাবে বলতো? এই বলে নিজেই উত্তর দিল, দেখবি ওদের তাড়াবে না। এভাবে তো বাড়ির কুকুর, বিড়ালকেও তাড়ানো যায় না। রাজনীতি মানুষকে বাদ দিয়ে হয়? মার এই কথাটা দেশের অনেক মানুষেরই মনের কথা। তাদের মধ্যে ঝগড়া, বিবাদ, হিংসা সবই আছে। আবার মিলেমিশে থাকাটাও আছে। কোন অর্থ নয়, প্রযুক্তি নয় মানুষ পৃথিবীর বুকে টিকে আছে স্রেফ এই মিলেমিশে বেঁচে থাকার শক্তিটাকে বোঝার জোরেই। বিজেপির বিভেদ পন্থা তাই কোনদিন সফল হবে না।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )