বাঙালি ‘জিনিয়াস’। এই কথাটি শুনে অনেকেরই মনে চিত্রপটে অঙ্কিত হয়ে যাবে বাংলার রেনেসাঁ যুগের ও তার কিছু পরের কয়েকজন মনীষীর নাম। তথা-রাজা রামমোহন রায়,ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ইত্যাদি অজস্র নাম। গোটা বাংলায় জিনিয়াসের সংখ্যা নেহাত কম নয় বরং উপমহাদেশের মধ্যে অনেক বেশিই বৈকি। নয়ত সাধে কি আর সেই অমোঘ বাণী উচ্চারিত হয়- ‘what Bengal thinks today, India will think tomorrow’। যাই হোক বাঙ্গালী জিনিয়াসের অবদান স্মরণ করেই এখন আমরা জানতে চলেছি এমন এক জিনিয়াসের কথা যঁর নাম এখন আর বিশেষ শোনা যায় না।অথচ রেনেসাঁ যুগে তাঁর অবদান, তাঁর আবিষ্কার অনস্বীকার্য।আসলে, বলা হয় না যে ‘বাঙালি আত্মবিস্মৃত জাতি’।তা সেই আত্মবিস্মৃতির তলানি থেকে ইতিহাসের পাতায় দেখা যায় সেখানে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে কিংবদন্তি বাঙালি ডাক্তার ও বিজ্ঞানী ইন্দুমাধব মল্লিক এর জীবনী যা এই রকম।
ছেলেবেলা ও শিক্ষা
ইন্দুমাধব মল্লিক জন্মগ্রহণ করেন ৪ই ডিসেম্বর, ১৮৬৯ সালে হুগলী জেলার কালনা থানার অন্তর্গত গুপ্তিপাড়ায়। এই আবিষ্কারক শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্রচন্দ্র মল্লিকের পিতা ও বাংলা চলচ্চিত্রের বিখ্যাত অভিনেতা রঞ্জিত মল্লিকের পিতামহ। ইন্দুমাধবের পিতার নাম রাধাগোবিন্দ মল্লিক। তাঁদের আদি বাড়ি ছিল বর্ধমান জেলার শ্রীখণ্ড গ্রামে।কলকাতার ভবানীপুরের বিখ্যাত ‘মল্লিক বাড়ি’-র তিনি এক পূর্বপুরুষ।
আসলে ছোটবেলা থেকেই ইন্দুমাধবের মধ্যে জিনিয়াসের লক্ষণ দেখা যায়। ছোটবেলা থেকেই পড়ার বইয়ের বাইরে যে বৃহৎ দুনিয়া পড়ে আছে পড়ে আছে তা উপলব্ধ করে পাঠ্যবইয়ের বাইরে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বই তিনি পড়ে যেতেন। একান্নবর্তী পরিবারের মধ্যে সবাই এই যে জিনিয়াস হবার গুনটি দেখেছি্লেন পরবর্তীকালে তা চারা থেকে মহীরুহে পরিণত হল। স্নাতকের সময় তাঁর মেধাবী গুনগুলি প্রকাশ পায় বাংলা গুণীজনদের কাছে।
১৮৯১ সালে দর্শনশাস্ত্রে, ১৮৯২ এ পদার্থবিদ্যা ও জীববিদ্যায় এম এ পাশ করেন।তখন বিজ্ঞানের বিষয়ের স্নাতক ও স্নাতকত্তোরে বি এ ও এম এ ডিগ্রী দেওয়া হতো।এরপর ১৮৯৪ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনের ডিগ্রির পরীক্ষাতেও সসম্মানে উত্তীর্ণ হন। এরপর ১৮৯৮ সালে কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজ থেকে তিনিই প্রথম বটানি তে এম এ পাশ করেন। এর এক বছর পর তিনি প্রাণিবিদ্যা ও শরীরবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। তাই বলাই যায় অল্প বয়সে তিনি হয়ে উঠেছেন লজিক, দর্শন, পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা তথা ভৌত বিজ্ঞান এবং জীববিজ্ঞান ও দর্শন,লজিকের এক বড়ো পন্ডিত। বাইশ থেকে আঠাশ এই ছবছরে অতগুলো বিষয়ে যাকে বলে ‘মাস্টার’।কেউ কি ভাবতে পারে?
এরইমধ্যে ১৮৯৭ সালে তিনি যোগ দেন বঙ্গবাসী কলেজে দর্শনের অধ্যাপক রূপে। তাঁর পড়ানোর ধরণ তাঁর জ্ঞান ছাত্রদেরকে মুগ্ধই করেছিল এবং তাঁরাও হয়ত জানতে পেরেছেন যে তাঁদের এই অধ্যাপক ভদ্রলোকটি মোটেও কেবলমাত্র একটি বিষয়ের জ্ঞানী নয়।ইনি আরো অন্যান্য বিষয়েরও একজন জ্ঞানী ব্যক্তি।তাই তাঁদের আবদারে ইন্দুমাধবকে পড়াতে হল উপর্যুক্ত প্রায় সবকটি বিষয়।।তিনি ১৮৯৭ থেকে ১৯০০ সাল অবধি কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজে লজিক, পদার্থবিদ্যা, দর্শন ও রসায়নের অধ্যাপনা করেছেন। ১৯০০ সালে বঙ্গবাসী কলেজে অধ্যাপনা ছেড়ে তিনি আইনজীবী হিসেবে প্র্যাকটিস করেন।
কিন্তু ইন্দুমাধব যে জিনিয়াস একটি বিশয়ে বা পেশায় তিনি বসে থাকেন কি করে? তাই, এরপর ১৯০৮ সালে তিনি মেডিসিনে মাস্টার(এম ডি) ডিগ্রী লাভ করেন।
চিকিৎসক হিসেবে
চিকিৎসক হিসেবে শুরু হলো তাঁর দেশের মানুষের মধ্যে ভ্যাকসিনেশনের সচেতননটা বাড়ানোর কর্মসূচি। অটোভ্যাকসিন চিকিৎসা পদ্ধতি ভারতে প্রথম চালু করায় অগ্রনী ছিলেন ইন্দুমাধব। সমাজ সংস্কারে তিনি খুবই উৎসাহী ছিলেন। দেশের জনসাধারনকে স্বাস্থ্যবিধি, পরিচ্ছন্নতা, আহার্য বিধি ইত্যাদি ব্যাপারে শিক্ষিত করে তোলার কাজে তাঁর প্রয়াস সত্যি অপরিহার্য।এইসব সেই সময়ের কথা যখন দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ বিদেশি শোষণের ফলে গরীব, অর্ধশিক্ষিত, কুসংস্কার ও জাতিভেদ প্রথায় নিমজ্জিত এবং বেশিরভাগ মানুষই ভুখা। ১৯০৯ সালে ‘মর্ডান রিভিউ’ পত্রিকায় বের হয় তার ম্যালেরিয়া সংক্রান্ত গবেষণা পত্র যা আজও ডাক্তারদের কাজে লাগে।তাই বলাই যায়, চিকিৎসক হিসেবে তাঁর বেশ খ্যাতি ছিল।
ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি তাঁর প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল। বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত দেওঘরে বোমা পরীক্ষায় আহত হলে গোপনে তাঁর চিকিৎসা করেন।
ইকমিক কুকার
এবার আসি ইন্দুমাধবের সেই আবিষ্কারের প্রসঙ্গে যার ফলে তিনি জীবদ্দশাতেই হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তি। সেই আবিষ্কারের নাম ‘‘ইকমিক কুকার’’। ১৯১০ খৃষ্টাব্দে ইকমিক কুকারের উদ্ভাবন করেন ইন্দুমাধব। ইকমিক কুকারের রান্না করা খাবারের স্বাদ বলা হয় স্বর্গীয় অনুভূতির মতো। আজ যাঁরা বয়স্ক মানুষ তাদের অনেকেই দেখে থাকতে পারেন এই যন্ত্রটিকে হয়ত ভাঁড়ার ঘরের কোণে কিংবা রান্নাঘরে। আর সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া হতো পিকনিকে। এই যন্ত্রটির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারতেন এটি ইন্দুমাধব মল্লিকের আবিষ্কার। এই যন্ত্রটিকে দেখতে ভারী আশ্চর্য। বাইরের চোঙাপাত্রের ওপরে আর নীচে অনেকগুলো ফুটো। ভিতরের পাত্রগুলি তিন-চারটে ডাব্বার সমান। এই যন্ত্রের একেকটি পাত্রে চাল,ডাল,মাছ,মাংস ভরে একেবারে নীচের পাত্রে কাঠ কয়লার আগুন জ্বেলে নিশ্চিন্তে কাজে বেড়ানো যেত।কাজ সেরে ফিরে এসেই মিলত সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর খাদ্য যা কেবলমাত্র বেড়ে খেয়ে নিত সবাই। অকৃতদার এবং বেড়াতে গিয়ে যাদের রান্না করার বিশেষ পরিবেশ পাচ্ছে না তাদের বন্ধু হয়ে উঠেছিল এই ইকমিক কুকার।
পাখি বুড়ো সালিম আলী খুবই ভক্ত ছিলেন এই ইকমিক কুকারের।তাই ভরতপুরে দেখা যেত বাইনোকুলার যন্ত্র ঝুলিয়ে জঙ্গলে হেটে যাচ্ছেন সালিম আলী আর পেছনে রয়েছেন সহকারী যাঁর হাসে ঝুলছে ইকমিক কুকার। এতোটাই ইকমিক কুকারের ফ্যান ছিলেন ভারতবিখ্যাত এই পক্ষীবিদ।
সারা ভারতবর্ষ জুড়ে যে যন্ত্রের এতো বিক্রি সেই যন্ত্রের আবিষ্কারকের নামে দুর্নাম করেছিল তৎকালীন সমাজে নিন্দুকেরা।তাদের মতে এই ইকমিক কুকার যন্ত্রের আবিষ্কারের আইডিয়া এক বাঙালি গৃহবধূর এবং সেই আইডিয়া ঘটনাচক্রে জানতে পেরে ইন্দুমাধব নিজের নামে পেটেন্ট করে নেন। এ যে ঘোরতর অন্যায়! অথচ ইন্দুমাধব এই নিন্দায় পাত্তাই দেননি। তিনি নিঃশব্দে নিজের মতো কাজ করে গিয়েছিলেন। সমালোচনায় কান না দেওয়া জিনিয়াসদের লক্ষণ আর যখন জিনিয়াসরা নতুন কিছু আবিষ্কার করেন তখন সমাজের নিন্দুকরাই তাঁদের নামে মিথ্যে নিন্দে করে বেড়ান।এই প্রবণতা বোধহয় বঙ্গসমাজে প্রবল।
সাহিত্য চর্চা
আগেই বলেছি, কোনো এক বিষয়ে বসে থাকার মানুষ ছিলেন না ইন্দুমাধব। সাহিত্যেও অবদান রেখে গেছেন তিনি। নানা পত্রপত্রিকায় অজস্র লেখালেখি করেছেন তিনি। বিদেশের বহু স্থানে ভ্রমণ করেছেন তিনি আর তাঁর উল্লেখযোগ্য বিখ্যাত তিনটি ভ্রমণ গ্রন্থের নাম ‘চীন ভ্রমণ’, ‘বিলেত ভ্রমণ’, ‘বিলাতের পথে’। এই বইগুলি পড়লে পাঠকের মনে হবে যেন তিনি ইন্দুমাধবের অসাধারণ বর্ণনার দরুন পৌঁছে গেছেন সেইসব দেশগুলিতে। এইক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো যে নানা রকম মূল্যবান পান্ডুলিপি সংগ্রহ করার অভ্যাস ছিল তাঁর।
পরিশেষ
এবার শেষ কথায় আসা যাক।৪৮ বয়সও পেরোতে পারেননি ইন্দুমাধব মল্লিক । ৮ মে, ১৯১৭ সালে মৃত্যু তাঁকে আমাদের মধ্যে থেকে নিয়ে চলে যায় পরলোকে। ইন্দুমাধবের জীবন আমাদের মনে করিয়ে দেয় এরেক জিনিয়াসের কথা যাঁর নাম শ্রীকান্ত জিচকর।ডাক্তারি, আইন, সংস্কৃত ইত্যাদির উচ্চ ডিগ্রি নেওয়া আইপিএস,আইএএস শ্রীকান্তও উনপঞ্চাশ পেরতে পারেননি।সাধারণত এই ধরনের স্বল্প সময়ের জন্য পৃথিবীতে আসেন।কিন্তু, মহৎ কাজ করে তাঁরা অমরত্ব লাভ করেন। কিন্তু আজ ইন্দুমাধব মল্লিকের নাম তেমন আর শোনা যায় না। আর তাঁর ইকমিক কুকার নামক যন্ত্রটির সাথে বর্তমান প্রজন্ম আর তেমন কিছুই জানেন না। আসলে হাল আমলের প্রেসার কুকারে্র সিটির ধোঁয়ায় হয়তো মিলিয়ে গেছে ইকমিক কুকার আর তাঁর আবিষ্কর্তার নাম।কিন্তু শোনা যায়, আজও কলেজ স্ট্রিটের কিছু দোকান অর্ডার নিয়ে বানিয়ে দিতে পারে ইকমিক কুকার এবং পুরনো ইকমিক কুকার সারাতেও পারে। আজও বাংলা ছাড়াও ভারতবর্ষের অনেক পুরনো বাড়িতে পাওয়া যেতে পারে এই অভিনব যন্ত্রটি। তাই তো বলা হয় যে জিনিয়াসরা ও তাঁদের কাজ মিলিয়ে যায় না।
কিন্তু অত অল্প বয়সের মধ্যে এত পড়াশোনা,এত কাজ,এত পরিশ্রম তার সাথে কিংবদন্তি আবিষ্কার সত্যি ভারী বিস্ময় জোগায় বৈকি!