স্বপ্ন বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত তোমাকে স্বপ্ন দেখতে হবে। আর স্বপ্ন সেটা নয় যেটা তুমি ঘুমিয়ে দেখ, স্বপ্ন হলো সেটাই যেটা পূরণের প্রত্যাশা তোমাকে ঘুমাতে দেয় না।
তুমি তোমার ভবিষ্যৎ পরিবর্তন করতে পারবে না কিন্তু তোমার অভ্যাস পরিবর্তন করতে পারবে এবং তোমার অভ্যাসই নিশ্চিত ভাবে তোমার ভবিষ্যৎ পরিবর্তন করবে।
এই কথা গুলো ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি বিজ্ঞানী এ পি জে আবদুল কালামের।
১৯৩১ সালের ১৫ অক্টোবর কালামের জন্ম ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের পম্বন দ্বীপের একেবারে হতদরিদ্র্য এক পরিবারে। তাঁর পুরো নাম আবুল পকির জয়নুল-আবদিন আবদুল কালাম। বাবা নৌকায় করে মাছ ধরতেন সাগরে, আর গ্রামের মসজিদে ইমামতি করতেন। নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর চেয়েও খারাপ ছিল অবস্থা, পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট হওয়ায় তাঁর আবদারগুলো রাখার চেষ্টা করতেন বাবা মা। পড়ালেখার দিকে ছেলের ঝোঁক দেখে তাকে পাঠানো হলো সরকারী স্কুলে। পেটে ভাত নেই, তবে বিদ্যা অর্জনের বাসনা আছে মনে। কতবার পড়ালেখা বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে, কিন্ত হাল ছাড়েননি আবদুল কালাম, পরিবারও পাশে ছিল তাঁর। নিজেরা অশিক্ষিত না হলেও শিক্ষার গুরুত্ব ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন তাঁরা।
আহামরি ভালো ছাত্র ছিলেন না কালাম। তবে আগ্রহ ছিল ভীষণ, বিশেষ করে গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে খুব পছন্দ করতেন তিনি। তিরুচিপাল্লির সেন্ট জোসেফ কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন করার পর সবাই ভেবেছিল এবার বুঝি ছেলে চাকুরীতে ঢুকে সংসারে থিতু হবে। কিন্ত কালামের খেয়াল ছিল অন্যকিছু। জ্ঞানার্জনের ভূত চেপে বসেছিল মাথায়, গবেষণাধর্মী কিছু করবেন ঠিক করলেন। চলে গেলেন মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে, মহাকাশ বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে শুরু করলেন এখানে। পড়ার খরচটা নাহয় স্কলারশীপে চালিয়ে দেয়া গেল, কিন্ত থাকা-খাওয়ার টাকা আসবে কোত্থেকে? এগিয়ে এলেন কালামের বড়বোন। নিজের বিয়ের গয়না ভাইয়ের হাতে তুলে দিয়েছিলেন এই ভদ্রমহিলা!
এমআইটি থেকে গ্র্যাজুয়েশন করলেন ১৯৬০ সালে। এখানে থাকাকালে একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। তাঁর ডিপার্টমেন্টের ডীন একবার এক সিনিয়র ক্লাস প্রোজেক্টে তাঁর কাজে বেশ অসন্তুষ্ট হলেন, হুমকী দিলেন, আগামী তিনদিনের মধ্যে প্রোজেক্টটা আবার ঠিকভাবে জমা দিতে না পারলে তাঁর স্কলারশীপ বাতিল করে দেবেন। ব্যপারটা মোটামুটি অসম্ভবই ছিল, কিন্ত কঠোর পরিশ্রমী আবদুল কালাম তিনদিনের সময়সীমা পার হবার আগেই সেটা সম্পন্ন করে ডীনের রুমে নিয়ে গিয়েছিলেন। ডীন বলেছিলেন, “আমি জানতাম তুমি পারবে, এজন্যেই সময় কমিয়ে বলেছিলাম। আমি দেখতে চেয়েছিলাম, চাপে তুমি ভেঙে পড়ো কিনা।” কালামের স্বপ্ন ছিল পাইলট হবার, ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের বাছাই পরীক্ষায় সারাদেশের মধ্যে তিনি হয়েছিলেন নবম। কিন্ত প্রথম আটজনকেই শুধু সুযোগ দেয়া হয়েছিল, স্বপ্ন ভেঙে গিয়েছিল কালামের।
কিন্ত তিনি ভেঙে পড়েননি একটুও। এমআইটি থেকে পাশ করে অ্যারোনটিক্যাল ডেভেলপমেন্ট এস্টাবলিশমেন্ট অর্গানাইজেশনে যোগ দেন। ছোট হোভারক্রাফটের ডিজাইন করাটাই ছিল তাঁর কাজ। এই সময়ে তিনি কাজ করতেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী বিক্রম সারাভাইয়ের অধীনে। ১৯৬৯ সালে কালাম বদলী হলেন ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশনে। ভারতের প্রথম স্যাটেলাইট ভেহিকেল প্রোজেক্টের প্রধান করা হয় তাকে। ১৯৮০ সালে তাঁর নেতৃত্বেই ‘রোহিনী-১’ স্যাটেলাইট নিক্ষেপ করেছিল ভারত। দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে তাঁর নাম, ভারতের মহাকাশ গবেষণাক্ষেত্রে তিনি তখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি! ১৯৯২-৯৯ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছিলেন, এই সময়ে পোখরান-২ পারমাণবিক পরীক্ষার প্রধান প্রকল্প সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করে মিসাইলম্যান হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন আবদুল কালাম।
মিসাইলম্যান এ পি জে ছিলেন একজন সাদাসিধে মানুষ। দেশের জন্য অকাতরে শুধু নিজেকে সঁপে দিয়েছেন। এ জন্য এই নিরহংকারী মানুষটি ‘জনগণের রাষ্ট্রপতি’ হতে পেরেছিলেন। কালাম ২০০২ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন।
ভারত সরকার তাঁকে ১৯৮১ সালে পদ্মভূষণ দেয়। ভারতে প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং আধুনিকীকরণে তাঁর অবদানের জন্য কালাম ১৯৯৭ সালে ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্ন পেয়েছিলেন। ১৯৯৮ সালে পোখরান-২ পরমাণু বোমা পরীক্ষায় তিনি প্রধান সাংগঠনিক, প্রযুক্তিগত ও রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করেন। ২০১৩ সালে তিনি ন্যাশনাল স্পেস সোসাইটি থেকে “স্পেস – সংশ্লিষ্ট প্রজেক্টের ব্যবস্থাপনা এবং নেতৃত্বের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি ” হিসাবে ভন ব্রাউন আওয়ার্ড লাভ করেন। এ ছাড়াও একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সম্মান ও পুরস্কার পেয়েছিলেন কালাম।
২০০২ সালে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিলেও তিনি তাঁর বক্তৃতায় নিজের ছোটবেলাকার সময়কাল থেকে কর্মজীবন এর নানা অভিজ্ঞতার কথা বলে সকলকে উদ্বুদ্ধ করতে চাইতেন। বিশ্বাস করতেন ছাত্ররাই পারে দেশকে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে দিতে। মেঘালয়ের শিলংয়ে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টে এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন কালাম, বক্তৃতার মাঝেই হঠাৎ হৃদ যন্ত্রনায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে যান তিনি। ৮৪ বছর বয়সে এভাবেই ফুরায় তাঁর জীবনের অধ্যায়। বক্তৃতা করতেই ভালোবাসতেন তিনি। আর বক্তৃতার মাঝেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তাঁর প্রয়াণের তিন বছর পূর্ণ হলো। ২০১৫ সালের ২৭ জুলাই প্রয়াত হন এই অসাধারণ ব্যক্তি। তিনি প্রয়াত হলেও তাঁর অনেক কথা রয়ে গেছে আমাদের মাঝে।
কালাম ছিলেন প্রতিভাবান এক ব্যক্তি। তাঁর বাকচাতুর্য মনকে ভরিয়ে দেয়, হৃদয়কে করে ইস্পাতসদৃশ, আকুঞ্জন দৃষ্টিকে করে প্রসারিত। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে যেতেন তরুণদের জাগিয়ে তুলতে, তাদের ভেতরের জীবটি লালন-পালন করার জন্য। ছাত্রছাত্রীদের কাছে খুবই জনপ্রিয় সাধারণ পোশাকে থাকা এই অসাধারণ মানুষটি।
তিনি দারুণ আত্মবিশ্বাসী একজন মানুষ ছিলেন। তাকে বলা হয় পিপল’স প্রেসিডেন্ট, সম্ভবত ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাষ্ট্রপতিও তিনিই। যে রাজ্যে তিনি পদচারণা করেছেন, তা সুশোভিত করেছেন। তাই তো তাঁর অবদানকে আরো তাৎপর্যমণ্ডিত করতে তিনি তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতেন নিজের চিন্তাচেতনার কথা। তরুণদের মনে দারুণভাবে দাগ কেটেছিলেন আধুনিক বিজ্ঞানের এই মহিরুহ। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে তরুণ-তরুণীদের মনকে আন্দোলিত করতে ছুটে যেতেন। তিনি স্বপ্ন দেখাতেন তরুণদের।
তাঁর লেখা ‘Wings of Fire’, ‘Turning Points’ কিংবা ‘Ignited Minds’ যুবসমাজের মধ্যে যে শক্তি জুগিয়েছে, তা আসলে ঈর্ষণীয়। তাঁর ‘Wings of Fire’ অন্যতম বেস্ট সেলার। ১০ লাখের বেশি কপি বিক্রি হয়েছে এ বইটি। তাঁর লেখা জ্ঞানের এমন আধার, যার ভেতরে ধার ও ভার দুটিই আছে।
শিশুসুলভ এই মানুষটি অকপটে মিশে গেছেন সাধারণের ভেতর। কোট-টাই পরা শুরু করেছিলেন রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর। পোশাকে ছিলেন সাধারণ, কিন্তু ব্যক্তিত্বে ছিলেন অসাধারণ। ভারতের ১১তম রাষ্ট্রপতি আবদুল কালাম যেদিন রাষ্ট্রপতি ভবন ছেড়েছিলেন, সেদিন সেই জিনিসগুলোই তাঁর সঙ্গে ছিল, যেগুলো তিনি ভবনে প্রবেশের সময় সঙ্গে নিয়েছিলেন। তিনি অনুকরণীয় এবং দারুণভাবে অনুসরণীয়।
একাধারে তিনি একজন বিজ্ঞানী, রাষ্ট্রপতি, বক্তা, লেখক সর্বোপরি একজন ভালো মানুষ। জীবনে বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর জীবনের সবচেয়ে সেরা পুরস্কার মানুষের ভালোবাসা। তাঁর কর্মময় জীবনের জন্য তিনি বেঁচে থাকবেন কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে।
এই মানুষটি জীবনের আনন্দ খুঁজেছিলেন কাজের মাঝে। আর তাই কাজই তাঁকে অমর করে রেখেছে।