আসামে বাঙালিকে বিদেশী বলে ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। রেহাই নেই ১০৩ বছরের বৃদ্ধা কিমবা ৯০ বছরের বৃদ্ধের। এ নিয়ে পশ্চিম বাংলার কোনো কাগজে হেডলাইন দেখেছেন? ডিটেনশন ক্যাম্পে মৃত্যু হয়েছে, এমনকি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। অকথ্য অত্যাচার চলছে, নাৎসি স্টাইলে ক্যাম্প। আতঙ্কে প্রহর গুনছে আসামের বাঙালিরা। এ নিয়ে প্রিয় চ্যানেলে ঘণ্টা খানেকের অনুষ্ঠান চোখে পড়েছে? ৩০ শে জুলাই NRC র ফাইনাল ড্রাফট প্রকাশের পর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে ত্রস্ত অনসমিয়ারা। বাঙালি বিদ্বেষের বিষে বিষাক্ত আসামের হাওয়া, দমবন্ধ হচ্ছে বাঙালির। প্রতিবাদে কলকাতায় কোনো বড় কোনো বিক্ষোভ-সমাবেশ-পোস্টার চোখে পড়েছে?
দেখুন আসাম ছাড়া বাকি ভারত কেমন নির্লিপ্ত। দেশভাগের কষ্টও বাংলা ও পাঞ্জাব ছাড়া কাউকে সেভাবে সহ্য করতে হয়নি। উদ্বাস্তু হওয়ার যন্ত্রণা উপলব্ধি করা এত সহজ না। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার বাস্তবতা অনুধাবণ করার ইচ্ছে কারোর তেমন নেই। কিন্তু সুযোগ বুঝে ইতিহাস ও বাস্তবতাকে অস্বীকার করে বিদ্বেষ ছড়াতে অনেকে সিদ্ধহস্ত।
আসাম নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির অবস্থান কি? বেশিরভাগ মানুষই এ বিষয়ে অবগত নয় বা ভাবিত না। একটা অংশ ক্রমাগত প্রচার করছে, আসাম থেকে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী মুসলমানদের তাড়ানো হচ্ছে, হওয়ারই তো কথা, ঠিক করছে। অর্থাৎ এই অংশটা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির শিকার বা নিজে থেকেই সাম্প্রদায়িকতা ছড়াতে ভালোবাসেন। কিন্তু বাস্তব অন্য কথা বলে, NRC র ড্রাফট থেকে নাম বাদ পড়েছে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের। অত্যাচারিত দুই সম্প্রদায়ই। নাম বাদ গেছে তপোধীর ভট্টাচার্যের, যিনি আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (কেন্দ্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়) প্রাক্তন উপাচার্য, যিনি স্বাধীনতা সংগ্রামী ও প্রাক্তন বিধায়কের সন্তান। তাই, এক কথায় শিকার বাঙালি। বাঙালি বাঙালি বলেই শিকার- এই বাস্তবতা থেকে চোখ ঘোরাতে সাম্প্রদায়িক গল্প হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফেসবুক ও হোয়াটস্যাপে বাঁচা আজকের সমাজের বড় অংশ অন্ধভাবেই সে গল্প গিলছে গপগপ। আর একটা ক্ষুদ্র অংশ, যারা সতেচন, সত্যটা জানেন, তারা প্রতিবাদ করছেন, এখানে জনমত গঠন করার চেষ্টা করছে।
অসমীয়ারা NRC বিলকে কাজে লাগিয়ে আসামকে বাঙালি শূন্য করতে চায়, অভাগা বাঙালির অস্তিত্ব শেষ করতে চায়। এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিচ্ছে অসম গণ পরিষদ ও বিজেপি। খেলার অংশ মূল ধারার সংবাদ মাধ্যম, এমনকি অহমিয়া বুদ্ধিজীবীরাও। আর একাজে সুবিধা করছে বিজেপি-আরএসএসের হিন্দু-মুসলিম খেলা।
বাঙালির পক্ষে দাঁড়িয়ে আসামের ভয়াবহ বাস্তবতার কথা পশ্চিমবঙ্গের নানা পত্র-পত্রিকায় তুলে ধরে আক্রমণের শিকার তপোধীর ভট্টাচার্য। প্রতিবাদ হচ্ছে, আসামের বাঙালি সংগঠনগুলি একত্রিত হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে, প্রায় ৪৩ টা বাঙালি সংগঠন প্রতিবাদে পথে নেমেছে। তপোধীর ভট্টাচার্য মাথা নীচু করার মানুষ না, পালটা প্রতিরোধের ডাক দিচ্ছেন তিনি।
এমতাবস্থায় পশ্চিম বাংলার বাঙালির নৈতিক কর্তব্য আসামের বাঙালির পাশে দাঁড়ানো। দায়িত্ব তপোধীর বাবুদের হাত শক্ত করা। আসামে বাঙালি জাতির অস্তিত্ব রক্ষা করা মানবতার দাবী। এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বাংলার রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা হতাশাজনক, অদ্ভুত ভাবে চুপ সবাই। মুখ্যমন্ত্রীতো আবার আসাম সীমান্তে কড়া নজরদারির কথা বলছেন, যা ভয়ের উদ্রেক করে। তাঁকে এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আসামের নিপীড়িত বাঙালির পাশে দাঁড়াতে হবে। অন্যদিকে, যারা বহির্বিশ্বের সমস্ত ঘটনা নিয়ে চিন্তিত হন, তারা নিজের জাতির সংকটে উদাসীন। কারণ স্বজাতির বিপদে কথা বললে, সমানাধিকারের কথা বললে পাছে প্রাদেশিকতার ছাপ লাগে পাট পাট করে ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবিতে। এটা চূড়ান্ত বাস্তব বিচ্ছিন্নতা এবং ভণ্ডামির লক্ষণ। তবে আশার কথা হল, দলীয় রাজনীতির বাইরে বেশ কিছু সংগঠন কাজ করছে। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের মধ্যে জনমত গড়ার প্রচেষ্টা জারি আছে। সভা, সেমিনারও হচ্ছে কলকাতার নানা প্রান্তে। এই সময়ে দাঁড়িয়ে বেশ কিছু সংগঠন সামাজিক গণ মাধ্যমে এবং বাস্তবের মাটিতে প্রচারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যৌথ কর্মসূচীও নেওয়ার পরিকল্পনা আছে। যত দ্রুত সম্ভব কলকাতায় আসাম ভবনের সামনে অবস্থান-বিক্ষোভের কথা ভাবা হচ্ছে।
পশ্চিম বাংলার বাঙালি হিসাবে আমাদের সর্বতোভাবে আসামের বিপন্ন বাঙালির পাশে দাঁড়াতে হবে। আসামের বাঙালি নিয়ে নিরুত্তাপ থাকা আসলে নিজের পায়ে কুড়ুল মারা, বাঙালি জাতির বুকে কুড়ুল মারা। নির্লিপ্ত থাকার মানে, বাঙালি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়নি। বাঙালির অনৈক্য, বাঙালি জাতিসত্তার নড়বড়ে ভিত্তি বাঙালিকে বারবার ভিটেমাটি ছাড়া করেছে, বাঙালি বারবার হেরে যায়। আর কতবার? একবার তো ঘুরে দাঁড়াতে হয়! এই সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত। আসামের বাঙালির জন্য অগ্নিপরীক্ষা, এ রাজ্যের বাঙালির জন্য লিটমাস টেস্ট। এ পরীক্ষায় বাঙালিকে জিততেই হবে। আরও একবার হারলে বাঙালি চিরতরে মুছে যাবে! এবার আর যেন তপোধীর ভট্টাচার্যদের পশ্চিম বাংলা থেকে খালি হাতে ফিরতে না হয়।
তাই, আসুন, আমরা শপথ নিই। আসামের বাঙালি বিদ্বেষী শক্তির বিরুদ্ধে একজোট হবো, সব চক্রান্ত ভেস্তে দেব। বাঙালি মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াবে।
( মতামত ব্যক্তিগত )