সম্প্রতি প্রাক্তন সাংসদ মইনুল হাসান সাংবাদিক সম্মেলন করে সিপিআইএম ছাড়ার কথা জানিয়ে দিয়েছেন। তাঁর ঘোষণার পরেই স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় সিপিআইএম তাঁকে আর্থিক দুর্নীতিগ্রস্থ ও অনৈতিক আখ্যা দিয়ে দিয়েছে। এখনখবরের জন্য কলম ধরলেন মইনুল হাসান।
সিপিআইএম একটি ভুল নীতি নিয়ে চলছে। বাইশতম পার্টি কংগ্রেসে যে নীতি নেওয়া হয়েছে তাও খণ্ডিত বলে আমার মনে হয়েছে।
অবশ্য সারা দেশে বিজেপি-র বিপদ যে সব চাইতে বড় বিপদ সেটা তারা স্বীকার করেছেন। আগের মতো সবাই খারাপ এবং ‘সমদূরত্বে’-র মতো ভেক কথা গুলো আর নেই। সমস্যা হল এই প্রধান বিপদকে পরাজিত করতে হবে কাদেরকে নিয়ে, সে ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার করতে হবে।
সারা দেশে সিপিএমের ভোট চার শতাংশেরও কম। একমাত্র মাঝারিমাপের একটি রাজ্যে তারা সরকার চালাচ্ছে। তা সত্ত্বেও বামপন্থীদের মধ্যে বড় পার্টি সিপিআইএম। এখনও সামান্য হলেও মানুষজন তাদের কথা শুনতে চায়। কিন্তু যারা নেতা আছেন তারা পুরনো আমলের কড়া ঘেরাটোপ থেকে বের হতে চান না। যা বলেন তাতে মানুষ বিভ্রান্ত হয় বেশি।
একটা উদাহরণ দিই,
বাইশতম পার্টি কংগ্রেসের রাজনৈতিক প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও আতাঁত করা যাবে না। আবার রাজ্যে রাজ্যে পরিস্থিতি অনুযায়ী নির্বাচনী সমঝোতা করা যাবে। অদ্ভুত ব্যাপার, এতদিন তো নির্বাচনকে সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক সংগ্রাম বলা হতো। আর পার্টি কর্মসূচিতে কংগ্রেসকে চরম শ্রেনীশত্রু বলে চিহ্নিত করা আছে। তাহলে তাদের সঙ্গে জোট করার পরিপ্রেক্ষিত তৈরি হয়েছে ধরে নিতে হবে। তাহলে লুকোছাপা কেন?
দ্বিতীয় প্রশ্নটি হল বিজেপি কেমন দল?ফ্যাসিবাদী, না ফ্যাসিবাদের মতো শুধু দক্ষিণপন্থী দল? দেশের সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক শক্তি, দল, ব্যক্তি যখন ফ্যাসিবাদী দল বলছে তখন একমাত্র সিপিআইএম প্রায় এঁড়ে তর্ক করছে – বিজেপিকে দক্ষিণপন্থী ও ফ্যাসিস্টসুলভ বলে। আরএসএস এইসব কথাকে সাধুবাদ জানিয়ছে। ভাবা যায় না!
এবার ঐক্যের প্রশ্নে আসি। সিপিআইএম কার সঙ্গে থাকবে, না থাকবে বড় ব্যাপার নয়। কারণ, সারা দেশে কয়েকটা কেন্দ্র ছাড়া কোথাও একা জিততে পারবেনা তারা। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা’য় জেতার কোনও ব্যাপারই নেই। কেরালাতে যদি কংগ্রেসের সঙ্গে বোঝাপড়া না হয়, তাহলে উন্মুক্ত ধুসর প্রান্তর তাদের জন্য অপেক্ষা করছে মাত্র। কিন্তু আগেই বলেছি যে বামপন্থীদের সারা দেশে কিছুটা হলেও মানুষ পছন্দ করে।
তিনটে রাজ্যে বামপন্থীদের শক্তি আছে । কেরালা, ত্রিপুরা, পশ্চিমবাংলা। সারা দেশে সিপিএম বিজেপির বিরুদ্ধে সবাইকে নিয়ে জোট করতে চায়। কিন্তু কেরালা, ত্রিপুরায় কংগ্রেস ও পশ্চিমবাংলায় তৃণমূল কংগ্রেসের নাম করলে রে রে করে তেড়ে আসছে । অবশ্য সেই তেজ এবং লোকবল সবই অস্তমিত।
পশ্চিমবাংলায় স্লোগান দেওয়া হয়েছে ‘ বিজেপি হটাও- দেশ বাঁচাও, তৃণমূল হটাও রাজ্য বাঁচাও’। রাজ্যটা কবে দেশের বাইরে হলো? ফলে বিজেপি বিরোধী লড়াইটা দুর্বল হচ্ছে। বামপন্থী ভোটাররা এসব সহ্য করতে না পেরে খানিকটা বিজেপি ও খানিকটা তৃণমূল কংগ্রেসে চলে যাচ্ছেন। বিজেপি’র কান্ডকারখানায় মানুষ যে কতখানি আতঙ্কিত সেটা সিপিআইএম নেতারা বুঝতে পারছে না। মহেশতলা বিধানসভার উপনির্বাচনে বামপন্থীদের ২৫% ভোট কমেছে। ভোট শেষ হওয়ার পর শান্তিপূর্ণ ও অবাধ ভোটের প্রশংসা করেছেন সিপিআইএম নেতারা। হেরে গিয়ে বলেছেন তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপি ভোট ভাগাভাগি করে নিয়েছে। চূড়ান্ত হতাশার পরিচয়।
অনেক সময় দলের ঊর্ধ্বে দেশকে প্রাধান্য দিতে হবে। বরাবর বামপন্থীরা এটাই করে এসেছেন। জহরলাল নেহরু , ইন্দিরা গান্ধীর সমালোচনা করলেও দেশের স্বার্থে তাদের বহু নীতি সমর্থন করেছে। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন, ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ সে সবের মধ্যেই পড়ে। এখন যেন ম্যাড়মেড়ে ব্যাপার । কোনো আলোচনাতেই বসতে চায় না। কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করার জন্য হা- পিত্যেস করবো , কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে কোনো আলোচনায় করবো না। এটা অবশ্য পশ্চিমবাংলায়। দিল্লীতে নয়। এরকম করে একটা দলের জাতীয় নীতি ঠিক হতে পারে? এর ফলেই সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে বিজেপি। বিজেপির বিরুদ্ধে দীর্ঘকালীন সংগ্রামের ঐতিহ্য থাকলেও এখন সাময়িক লাভের চিন্তায় তারা পশ্চিমবাংলায় চূড়ান্ত সুবিধাবাদ ও দ্বিচারীতার নীতি নিচ্ছেন। সুবিধা হবে বিজেপির, দেশ বিপদে পড়বে। আমি একবার হিটলারের আমলে জার্মানির কথা স্মরণ করিয়ে দেব মাত্র।