নাম শুনে কি ইস্টার সানডের কথা মনে পড়ছে? না, ভুল ভাবেননি। আসলেই ইস্টার সানডের সাথে রয়েছে ইস্টার আইল্যান্ডের একটা যোগসূত্র। কীরকম? ১৭২২ সালের ৫ এপ্রিল ছিল ইস্টার সানডে। সেদিন ডাচ ভ্রমণকারী Jacob Roggeveen এই দ্বীপে এসে পড়েন আর নাম দেন Paasch-Eyland, যার অর্থ ডাচ ভাষায় ইস্টার আইল্যান্ড। এই দ্বীপের বর্তমান নাম স্প্যানিশে Isla de Pascua, এর মানেও ইস্টার আইল্যান্ড। বর্তমানে এ দ্বীপের নাম স্থানীয় পলিনেশিয় ভাষায় রাপা নুই (“বড় রাপা”)। মজার ব্যাপার, এই দ্বীপে কিন্তু জ্যাকব ভুল করে চলে এসেছিলেন, তিনি মূলত খুঁজছিলেন ভিন্ন এক দ্বীপ, ডেভিস আইল্যান্ড কিংবা ডেভিডস আইল্যান্ড। কিন্তু ভাগ্যগুণে চলে এলেন এখানে।
চিলির অধীনের এ দ্বীপের অবস্থান হলো দক্ষিণ-পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে, পলিনেশিয় অঞ্চলে। ১৯৯৫ সালে ইউনেস্কো এ দ্বীপকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট নাম দেয়। দ্বীপের বড় একটা অংশ এখন রাপা নুই ন্যাশনাল পার্কের অধীনে সুরক্ষিত।
এ দ্বীপের আদিবাসীরা সম্ভবত ৭০০ থেকে ১১০০ সালের মাঝে এখানে এক সুন্দর সমাজ গড়ে তুলেছিল, কার্বন ডেটিং অন্তত তাই জানায় আমাদের। তারাই বানিয়েছিল বিশালাকারের ৮৮৭টি মূর্তি, যাকে স্থানীয় ভাষায় বলে মোয়াই। তারা চাষ করত মিষ্টি আলু। সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া “মোয়ানা” হলিউড অ্যানিমেশন ফিল্মটা দেখে থাকলে হয়ত পাঠকের পলিনেশিয় দ্বীপ নিয়ে ধারণা হয়ে যাবে বেশ।
ধীরে ধীরে গাছ কাটা বাড়তে থাকে, জনসংখ্যাও বাড়তে থাকতে, আর সাথে হানা দেয় পলিনেশিয় ইঁদুর- সব মিলে দুর্বল হয়ে যায় রাপা নুই সমাজ। আগে যেখানে জনসংখ্যা ছিল ১৫,০০০, সেখানে ডাচ ভ্রমণকারী যখন এলেন তখন জনসংখ্যা মোটে দুই কি তিন হাজার, বাকিরা চলে গিয়েছে। তাছাড়া ডাচ ব্যবসার কারণেও পরে মানুষ কমে যায় দ্বীপ থেকে। একটা পর্যায়ে দ্বীপের মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র ১১১ সেটা ১৮৭৭ সালের কথা।
এ দ্বীপটা এতটাই গহীনে অবস্থিত যে এ দ্বীপে যে সমাজ ছিল এটাই একটা রহস্য আর বিস্ময়কর ব্যাপার। সবচেয়ে কাছের বাসযোগ্য দ্বীপ পিটকেয়ার্ন আইল্যান্ড এখানে থেকে ২০৭৫ কিলোমিটার দূরে! আর সত্যিকারের শহর যেখানে মানুষ মোটে ৫০০, সেটাও প্রায় ২৬০৬ কিলোমিটার দূরের মাঙ্গারেভা আইল্যান্ড। আর সত্যিকারের স্থলভাগ বা মহাদেশ সবচেয়ে কাছের যেটা সেটা হলো মধ্য চিলিতে, তাও ৩৫১২ কিলোমিটার দূরে!
১৮৮৮ সালে চিলির অধিভুক্ত হয় ইস্টার আইল্যান্ড। ২০১২ সালের হিসেব মতে এ দ্বীপে এক্ষন ৫,৮০০ মানুষ বাস করে। এর ৬০% হলো আদিবাসী রাপা নুই এর বংশধর।
ইউরোপীয় ভ্রমণকারীরা যখন এখানে আসতেন, তখন স্থানীয়দের সাথে কথা বলতে পারতেন না, কারণ তারা তো ভাষা জানতেন না। অবশেষে জেমস কুকের অভিযানের সময় তার একজন ক্রু ছিলেন স্থানীয় পলিনেশিয় (বোরা বোরা থেকে), তিনি মাঙ্গারেভান ভাষায় কথা বলতে জানতেন। ঐ ভাষার সাথে ৮০% শব্দ মিলে যায় রাপা নুই-দের। একটু আগে বলেছিলাম ২৬০৬ কিলোমিটার দূরের মাঙ্গারেভা-র কথা। এমনকি স্থানীয় নৌকা দিয়ে ঐ জায়গা থেকে ইস্টার আইল্যান্ডে ১৯৯৯ সালেও পৌছাতে লেগেছে ১৯ দিন!
১৮৬০ সাল থেকে মিশনারিরা খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারকরা এ দ্বীপে আসতে থাকেন। তখন এ দ্বীপের সমাজে চরম বর্ণপ্রথা ছিল। একজন আরিকি ছিলেন, অর্থাৎ যিনি প্রধান, তিনি নয় গোত্র শাসন করতেন। প্রধান বা হাই চিফ হতে হবে এমন একজনকে যিনি কিনা হবেন এই দ্বীপের পৌরাণিক প্রতিষ্ঠাতা হতুমাতুয়া-র বংশধর। তার প্রথম সন্তান হতে হবে। প্রাচীন পূর্বপুরুষদেরকেই তারা মূর্তি আকারে সাজিয়েছে দ্বীপে। এগুলোকেই মোয়াই বলে। এ দ্বীপের কোনো লিখিত ইতিহাস নেই, স্থানীয়রাই এগুলো বর্ণনা করেন। প্রথম প্রথম তারা দেবতাদের খুশি করতে নরবলিও দিত।
ঐ যে বলেছিলাম, ডাচ ভ্রমণকারী জ্যাকব এসেছিলেন প্রথম; তিনি এসেই তার ক্রুদের দিয়ে এখানে আগুন ধরিয়ে দেন, যাতে মারা যায় ১২ জন স্থানীয়। অনেকেই আহত হয়। একটা ভুল বোঝাবুঝি থেকে এরকম হয়েছে বলে বলা হয়। এরপর আসে দুটো স্প্যানিশ জাহাজ সান লরেঞ্জো আর সান্তা রোজালিয়া, তারা এসে দেখে এক ক্ষেতবিহীন দ্বীপ, তীর ঘেঁষে অনেক মূর্তি। ১৭৭৪ সালে ব্রিটিশ ভ্রমণকারী জেমস কুক এসে দেখলেন অনেক মূর্তি পড়ে গেছে। আর যখন ব্রিটিশ জাহাজ এইচএমএস ব্লসম এসে পৌছল ১৮২৫ সালে, ততদিনে কোন মূর্তি আর দাঁড়ানো নেই। ঐ শতকে আদিবাসীরা আর কোনো বহিরাগত আসতে দিত না, আসলেই আক্রমণ করত।
১৮৬২ সালে পেরুভীয় দাস ব্যবসায়ীরা আক্রমণ করে ১৫০০ মানুষকে ধরে নিয়ে যায়। জনসংখ্যা অর্ধেক হয়ে যায়। তার উপর জলবসন্ত ছড়িয়ে পড়ে। সে এক মহামারী! এরপর আক্রমণ করল ধনুষ্টংকার রোগ। ওতেও মারা গেল অনেকে। এভাবেই নামতে নামতে জনসংখ্যা এসে দাঁড়াল ১১১ তে।
১৯৬০ সালে আদিবাসীদের এক কোণে দিয়ে ঐ দ্বীপ উইলিয়াম-ব্যালফোর কোম্পানি ভেড়ার ফার্ম হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত। ১৯৬৬ সাল থেকে চিলি নেভি এ দ্বীপ নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। তখন থেকে রাপা নুই-রা চিলির নাগরিক।
ইস্টার আইল্যান্ডে আছে তিনটি মৃত আগ্নেয়গিরি। দ্বীপ জুড়ে থাকে ট্রপিকাল রেইনফরেস্ট আবহাওয়া। বেশ বাতাস আর বৃষ্টিও হয়। তবে সাইক্লোন হারিকেন এসব এখানে হয় না।
স্থানীয় বাসীরা পুরনো ধর্মই মেনে চলে। তাদের ধর্মের পৌরাণিক চরিত্রগুলোর নামের মধ্যে আছে মাকেমাকে নামের এক দেবতা, আছেন আকুয়াকু যিনি গুহা পাহাড়া দেন। আছে মোয়াইকাভাকাভা। গুহাতে ঢুকার সময় তারা এই মন্ত্র পড়েঃ “হেকাই ইতে উমু পারে হাওঙ্গা তাকাপু হানাউ এপে কাই নরুয়েগো।”
এত কিছু বাদ দিলেও কেবল মূর্তিগুলো দেখতেই ছুটে যান পর্যটকরা। এই মূর্তি নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে পেট্রোগ্লিফ আবিষ্কৃত হয়, অর্থাৎ পাথরের উপর খোদাই করে লিখা।
পুরো দ্বীপ জুড়ে আছে অনেক অনেক গুহা, আছে পারিবারিক গুহাও। কাছের মতুনুই দ্বীপেও গুহার অভাব নেই। ভেতরে চাষবাসের নজিরও আছে। গুহার দেয়ালে থাকে প্রাচীন পৌরাণিক ছবি আর কাহিনী। তাদের প্রাচীন লিখিত ভাষার নাম ছিল রঙ্গরঙ্গ। ছবি আর জ্যামিতিক আকৃতির সমন্বয়ে এই ভাষা।
ইস্টার আইল্যান্ডে যাওয়ার জন্য আছে মাতাভেরি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর! সেখানে জেট বিমান সার্ভিস আছে, বোয়িং ৭৬৭ এবং বোয়িং ৭৮৭। সুতরাং এখন আর মোটেও দুর্গম নয় একসময়ের বিস্ময় ইস্টার আইল্যান্ড। চাইলে আপনিও হতে পারেন ইস্টার আইল্যান্ড চষে বেড়ানো এক পর্যটক।