১৯ শে মে, ১৯৬১ – বাংলা ভাষা এবং বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। আসামের বরাক উপত্যকা উত্তাল হয়েছিল বাংলা ভাষার মর্যাদা ও অধিকারের দাবিতে, পুলিশের গুলিতে শহীদ ১১ জন বাঙালি। যে ভাষা আন্দোলন ছিল সার্বিক, সর্বস্তরের বাঙালির। রক্ত ঝড়েছে, লড়াই চলেছে, কিন্তু আসামে বাঙালি উপযুক্ত মর্যাদা পায়নি। প্রতিনিয়ত জাতিবিদ্বেষের শিকার হয়েছে বাঙালি। শিলচর রেলস্টেশন আজও সেই রক্তাক্ত ইতিহাসের সাক্ষী। ১৯০৫ এ বঙ্গভঙ্গের সময় ব্রিটিশ সরকার বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি ভেঙে আসাম তৈরি করে, তীব্র প্রতিবাদে বঙ্গভঙ্গ রোধ হলেও বাঙালি অধ্যুষিত বিস্তৃতঅঞ্চল আসামেই রয়ে যায়। পরে সাতচল্লিশে দেশভাগের কারণে বাংলা আরও ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে। ভারতে থাকা বাঙালিরা মূলত তিনটি রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গ বাঙালির মূল ঘাঁটি, পরবর্তী কালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ভাষার ভিত্তিতেই তৈরি হয়। বাংলাদেশের ওপারে ছোটো রাজ্য ত্রিপুরায় বাঙালির বাস। দেশভাগের সময় একটা জায়গাতেই গণভোট হয়েছিল, সেটা হল আসামের একটা অংশ ও সিলেটে। অহমীয়াদের বড় অংশ চেয়েছিল পুরো বরাকভ্যালি পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাক, তাই ভোটাধিকার দেওয়া হয়নি চা বাগানের মানুষদের। সে পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কুখ্যাত গোপীনাথ বড়দলৈ। কিন্তু শেষমেশ গণভোটে সিলেটের একটা অংশ, বরাক উপত্যকা ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়।
তাই আসাম (অসম নয়) কোনো ভাবেই ভাষার ভিত্তিতে তৈরি রাজ্য না। আজকের আসামের বাঙালি কিন্তু ভূমিজ জাতি, বহিরাগত নয়। দেশভাগ এবং পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক কারণে বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য মানুষ আসে ভারতে। আসামে আশ্রয় নেন তাদের অনেকেই। ক্ষোভ বাড়তে থাকে স্থানীয় মানুষের, অহমীয়ারা অনুপ্রবেশকারীদের বিতাড়িত করার কথা বলে। ১৯৮৫ সালে স্বাক্ষরিত হয় ‘আসাম চুক্তি’। ঠিক হয়, ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ থেকে আসা সমস্ত মানুষকে আসাম থেকে বিতাড়িত করা হবে। আসে NRC বিল। কিন্তু NRC বিলের প্রথম ড্রাফটে বাদ পড়ে অসংখ্য বাঙালির নাম, যারা ১৯৭১ র ২৫ শে মার্চের আগেই এসেছেন। প্রায় ৭০ লাখ বাঙালি ঘোর বিপদে। ৩০ শে জুন, নির্ধারিত দিনে NRC র ফাইনাল ড্রাফট প্রকাশিত হয়নি বরাকে বন্যা পরিস্থিতির জন্য। ৩১ শে জুলাই দিন ধার্য করা হয়েছে ফাইনাল ড্রাফট প্রকাশের।
৩১ শে জুলাই লাখ লাখ বাঙালি দেশহীন, পরিচয়হীন নাগরিক হয়ে যাবেন। বাঙালি আবার নিজের মাটিতে উদ্বাস্তু হবে। বাঙালি আগ্নেয়গিরির মুখে এখন। আসাম গণ পরিষদ তীব্র বাঙালি বিদ্বেষী, তারা আসাম জুড়ে বাঙালি বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে। বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে অহমিয়া সংবাদমাধ্যমের বড় অংশ। বিজেপি- আসাম গণ পরিষদ জোট ক্ষমতায় আসার পর বাঙালি বিদ্বেষ চরমে ওঠে। স্বাভাবিক ভাবেই, বিজেপি বাঙালিকে হিন্দু-মুসলিমে ভাগ করে রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করছে। বিজেপি ও আসাম গণ পরিষদের নোংরা খেলায় আসামে বাঙালির কবর খোঁড়া হচ্ছে। বাঙালি জাতিকে শেষ করে দেওয়ার চক্রান্ত চরমে। অহমিয়া সংবাদমাধ্যমের বড় অংশ ডাক দিচ্ছে আসামে থাকতে গেলে অহমীয়া হতে হবে। বাঙালিদের ধরে ধরে ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে অকথ্য অত্যাচার চালাচ্ছে, যা নাৎসি জার্মানির কথা মনে করিয়ে দেয়।
আসামের বাঙালিরাও পালটা লড়াই দেওয়ার চেষ্টা করছেন। বীর বাঙালি, আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য তপোধীর ভট্টাচার্য কলম ধরেছেন, তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন। চেষ্টা চলছে বাঙালিকে সংগঠিত করার, বুক চিতিয়ে লড়ছেন বহু বাঙালি। দুদিন আগেই তপোধীর ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে এফ আই আর হয়েছে, কিন্তু তিনি মাথা নোয়াননি। প্রতিবাদে আসামে পথে নেমেছে হাজার হাজার মানুষ এবং নানা বাঙালি সংগঠন। কিন্তু বাধা অহমীয়াপন্থী বাঙালি বিদ্বেষী সরকার এবং বিজেপির সাম্প্রদায়িক তাস। আজ পশ্চিমবঙ্গের আসামের বাঙালির পাশে দাঁড়ানোর সময়। এই ঐতিহাসিক সংকটে, এ রাজ্যের বাঙালিকে দলমত-ধর্ম নির্বিশেষে আসামের অসহায় বাঙালির জন্য ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ তুলতে হবে। এ ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু সংগঠন এগিয়ে এসেছে। তবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভূমিকা হতাশাজনক।
‘বাংলা পক্ষ’ আসামের নিপীড়িত বাঙালির জন্য পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজে নেমেছে, তারা এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিচ্ছে। গত ২৩ শে জুন কলকাতা প্রেস ক্লাবে আসামের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে প্রেস কনফারেন্সে বক্তব্য পরিষ্কার করেছেন সংগঠনের প্রধান অধ্যাপক গর্গ চ্যাটার্জী। প্রতিরোধ গড়ে তোলার ডাক দিয়েছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘আসাম একটা ল্যাবরেটরি, সেখানে এক্সপেরিমেন্ট চলছে। সফল হলে কাল তা পশ্চিমবাংলায় হবে। আমরা সর্বশক্তি দিয়ে সে চক্রান্ত রুখব”। গত ৩০ শে জুন একাডেমি অফ ফাইন আর্টসের সামনে আসামের অসহায় বাঙালির সংহতিতে কর্মসূচী নেয় বাংলা পক্ষ। বক্তব্য রাখেন, চাকরি সূত্রে এবং বেতার, দূরদর্শন ও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার কাজে আসামে বেশ কয়েক বছর কাটানো, আসামের রাজনীতি নিয়ে অভিজ্ঞ পার্থসারথী বসু। প্রচারে ঝড় উঠেছে সামাজিক গণ মাধ্যমেও, আসামের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি এ রাজ্যের মানুষের সামনে তুলে ধরার জোর প্রচেষ্টা চলছে। সংগঠনের তরফে পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামের সকল সাংসদ কে চিঠি লেখার সিদ্ধান্ত হয়েছে এবং এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে আসামের বাঙালির পাশে দাঁড়ানোর আবেদন জানানো হয়েছে। আশ্বাস মতো মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এগিয়ে এলে, বুকে বল পাবেন আসামের বাঙালিরা। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে কলকাতায় আসাম ভবনের সামনে অবস্থান বিক্ষোভের কথা ভাবা হচ্ছে। সংগঠনের তরফে এরাজ্যের এবং আসামের সকল বাঙালি সংগঠনের সাথে যোগাযোগ ও যৌথ কর্মসূচী নেওয়ার চেষ্টা চলছে। বীর সন্তান তপোধীর ভট্টাচার্যের সাথেও ঘনিষ্ট যোগাযোগ আছে সংগঠনের।
এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের দাবী বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। যে জাতি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিল, স্বাধীন ভারতে তারাই সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত কেন? কেন নিজের ভিটেমাটি থেকে বাঙালি বারবার উৎখাত হবে? উদ্বাস্তু হওয়াই কি বাঙালির ভবিতব্য? সকল বাঙালিকে আসামের বাঙালির পাশে দাঁড়াতে হবে। প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে এটা সময়ের দাবী, মানবতার দাবী, সমানাধিকারের দাবী।
(মতামত ব্যক্তিগত)