পশ্চিমবঙ্গ ভাষার ভিত্তিতে তৈরি রাজ্য, যে রাজ্যের প্রধান ভাষা বাংলা, মোট জনসংখ্যার ৮৬ শতাংশ বাঙালি। কিন্তু হাতেগোনা কিছু ব্যাঙ্কের শাখা ছাড়া ব্যাঙ্কের ফর্মে বাংলার লেশমাত্র নেই, যা অনভিপ্রেত। ব্যাঙ্কের ফর্মে জ্বলজ্বল করছে হিন্দি ও ইংরেজি। ফর্মে বাংলা না থাকার জন্য সমস্যায় ভোগেন গ্রাম-বাংলার মানুষ থেকে শুরু করে শহরের বাংলা শিক্ষিত মানুষ- সকলেই।
প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে আমি, মাটির গন্ধ চিনি। জ্বলন্ত সমস্যা গুলো দেখি। LIC কিমবা পোস্ট অফিস, ব্যাংকের কাগজ, ইংরেজি-হিন্দিতে লেখা থাকে বেশিরভাগ। শুধু ছবির মতো করে দেখে বেশিরভাগ লোকজন, কারোর কাছে নিয়ে যায় পড়ে দেবার জন্য, ফর্ম পূরণের জন্য। অন্যের সাহায্য ছাড়া এই সব গুরুত্বপূর্ণ জিনিস দুর্বোধ্য তাদের কাছে। বাবা কাকা থেকে গ্রামের ভাই-বোন বেশিরিভাগই সমস্যায় পড়েন। কিছু মানুষ ব্যাঙ্কে ও পোস্ট অফিসের ফর্ম পূরণ করে দেন টাকার বিনিময়ে, এ দৃশ্য আমার চেনা। নয়ত ব্যাঙ্কের কর্মীর সাহায্যের প্রত্যাশায় অপেক্ষা করতে হয়। গ্রামে ব্যাঙ্কের শাখা কম, প্রচন্ড ভিড়। সরকারি ব্যাঙ্কের শাখাগুলোয় ছাত্র-ছাত্রী থেকে বয়স্কা বিধবা মহিলার লম্বা লাইন। সেখানে ব্যাঙ্ক কর্মীর সাহায্য পাওয়া কঠিন ব্যাপার। শুধু গ্রাম না, আমি আরামবাগের মতো মহুকুমা শহর কিমবা কলকাতার যাদবপুরের মতো উন্নত এলাকাতেও ব্যাঙ্কে দেখেছি, ব্যাঙ্কের নানা ফর্মে বাংলা না থাকায় সমস্যায় পড়েন সাধারণ মানুষ। বাংলা থাকলে একেবারে নিরক্ষর মানুষ ছাড়া সব মানুষেরই সমস্যা লাঘব হয়।
প্রথম কথা, এটা অধিকারের প্রশ্ন, যে প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া যায় না। ব্যাঙ্কের ফর্মে বাংলা থাকবে না কেন? পশ্চিমবঙ্গের মূল সরকারি ভাষা বাংলা, এটা ভাষাগত সমানাধিকারের প্রশ্ন। যে বাংলায় আলামোহন দাস চালু করেছিলেন দাস ব্যাঙ্ক, যে বাংলায় পথ চলা শুরু বেঙ্গল ব্যাংকের(যা আজ স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া), যে বাংলার মাটিতে কুমিল্লা ব্যাংক অর্থাৎ আজকের ইউবিআই ব্যাঙ্ক গড়ে উঠেছিল, সেই মাটিতেই ব্যাঙ্কে বাংলা ভাষা বঞ্চিত। এটা নাগরিক অধিকার হনন। স্বাক্ষর মানুষকে নিরক্ষর করে দেওয়ার চক্রান্ত। বাংলার বুকে একজন শুধুমাত্র হিন্দি জেনে যদি পরিষেবা পান, তবে একজন বাঙালি নয় কেন? দ্বিতীয় কথা, এটা গ্রাহকের সুবিধার প্রশ্ন। গ্রাহকের কাছে ব্যাঙ্কের দায়বদ্ধতা আছে। এভাবে শুধুমাত্র ইংরেজি ও হিন্দি ব্যবহার করে গ্রাহককে, গণ মানুষকে অসুবিধায় ফেলতে পারে না ব্যাঙ্ক। তাই পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত প্রতিটা ব্যাংকের ফর্মে বাংলা থাকা বাঞ্ছনীয়। রাজনৈতিক কারণে বাংলাকে বঞ্চিত করে শুধুমাত্র ইংরেজি ও হিন্দি রাখা একটা চক্রান্ত। পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ জায়গায় মানুষ হিন্দি পড়তে ও লিখতে পারেন না, প্রসঙ্গত ৮৩ শতাংশ বাঙালি বাংলা ছাড়া অন্য ভাষা জানেন না। ফর্মে হিন্দি রাখা অর্থহীন বেশিরভাগ শাখাতেই।
ব্যাঙ্ক আমানতকারীদের থেকে টাকা জমা নেওয়ার বিজ্ঞাপন বাংলায় দেয়, কিন্তু পরিষেবা বাংলায় না। এ কেমন খেলা? বাংলায় অবস্থিত রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাঙ্কগুলো টাকা জমা নেয় বেশি, বাঙালিকে ঋণ দেয় কম। বাঙালি কি দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক? এছাড়া অনেক ব্যাঙ্কে বাংলা জানা কর্মী নেই। এরফলে বিঘ্নিত হয় পরিষেবা। উত্তরপ্রদেশের ক্ষেত্রে ভাবতে পারেন যে সেখানে হিন্দি জানা কর্মী নেই? কলকাতায় যেসব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের হেড অফিস, সেই সব ব্যাঙ্কের ফর্মেও বাংলা নেই, দুঃখজনক।
তাই ব্যাঙ্কে ও পোস্ট অফিসের প্রতিটি ফর্মে বাংলা থাকা আবশ্যিক করা হোক। পরিষেবা প্রদানের জন্য ব্যাঙ্কের কর্মীদের বাংলা জানা খুব জরুরী, তাই সে ভাবেই কর্মী নিয়োগ করুক ব্যাঙ্ক। এটা বাংলার দাবী, এটা বাঙালির দাবী।