কী অসাধারণ খেলাটাই না হলো। বেলজিয়াম-জাপান ম্যাচটিকে ‘সহজ’ লড়াইয়ের তকমা দিয়ে যারা ঘুমোতে চলে গিয়েছিলেন, তারা আফসোসই করবেন। এবারের বিশ্বকাপের সেরা ম্যাচটাই কী তারা মিস করলেন! সেরা না হলেও দুর্দান্ত এক ম্যাচই কাল উপহার দিয়েছে বেলজিয়াম ও জাপান। বেলজিয়ানরা বাজিমাত করেছে ২-০ গোলে পিছিয়েও ম্যাচটা ৩-২ গোলে জিতে, জাপান জয় করেছে সাধারণ ফুটবল রোমান্টিকদের মন।
অসাধারণ লড়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের শেষ আটে নাম লেখানোর একেবারে প্রান্তেই পৌঁছে গিয়েছিল তারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেলজিয়ানদের স্কিল, হার না মানা মনোভাব আর ভাগ্যের কাছে নতি স্বীকার করতে হয়েছে এশীয় জায়ান্টদের। দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে বিদায় নিলেও জাপানিরা গর্ব করতেই পারে তাদের জাতীয় দল নিয়ে। কেবল জাপানিরাই নয়, এবারের বিশ্বকাপে জাপান যে ফুটবল খেলেছে, তাতে গর্ব হতে পারে গোটা এশিয়ারই।
খেলা শেষ হওয়ার ১৭ মিনিট আগেও জাপানিরা ভাবতে পারেনি যে ম্যাচটা তারা হারতে যাচ্ছে। ৪৮ মিনিটে ইয়ান ভারটংঘেন-র ভুলের সুযোগে গোলরক্ষক কোর্তুয়াকে ফাঁকি দিয়ে জাপানকে এগিয়ে দিয়েছিলেন গেঙ্কি হারাগুচি। ঠিক ৫ মিনিট পরই জাপান এগিয়ে গেল ২-০ গোলে। তাকাশি ইনুই প্রায় ২৫ গজ দূর থেকে গোল করে বেলজিয়ামকে প্রায় ছিটকে দিয়েছিলেন ম্যাচ থেকে। কিন্তু সেখান থেকেই ঘুরে দাঁড়াল এবারের বিশ্বকাপে জনমানুষের ‘ফেবারিট’রা। ৬৯ মিনিটে ইয়ান ভার্তোনে যে হেডে গোলটি করলেন, সেটিই তো অলৌকিক।
এটাই নাকি বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি দূরত্ব অতিক্রম করা হেডের গোল। ১৮.৬ মিটার দূর থেকে যখন ভারটংঘেন জাপানি গোলকিপার এইজি কাওয়াশিমা পরাস্ত হলেন তখনই কি বিধিলিপিতে হার লেখা হয়ে গিয়েছিল জাপানের?
৭৪ মিনিটেই মারোয়ান ফেলাইনির হেড জাপানের জালে। ২-২ অমীমাংসায় ম্যাচটি যখন শেষ হতে চলেছ, অতিরিক্ত সময়ের টেনশন নিতে যখন পুরো স্টেডিয়াম প্রস্তুত, ঠিক তখনই যোগ করা সময়ে নাসির চাডলির দুর্দান্ত গোলে কপাল পুড়ল জাপানের। গোলরক্ষক কর্তুয়ার প্রত্যুৎপন্নমতিতে গোলটি বেলজিয়াম পায় কেভিন ডি ব্রুইনা, টমাস মনিয়ের আর রোমেলু লুকাকুর পা ঘুরে। অসাধারণ এই গোলে জাপান ম্যাচটি হারলেও ফুটবল দুনিয়াকে তারা কিন্তু নিজেদের উঠে আসার জানান দিয়ে দিয়েছে।
জাপান ফুটবল কতটা উন্নতি করেছে, সেটারই একটা উদাহরণ আমরা দেখলাম এবারের বিশ্বকাপে। ১৯৯৩ সালে পেশাদার ফুটবল লিগ বা জে লিগ শুরুর পর থেকে আস্তে আস্তে ওপরের দিকেই উঠছে জাপানি ফুটবলের গ্রাফ। জে লিগ চালুর আগে থেকেই অবশ্য এশীয় স্তরে ফুটবলটা মোটামুটি ভালোই খেলত তারা। ১৯৯২ সালে এশিয়ান কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয় তারা। ১৯৯৪ বিশ্বকাপে অল্পের জন্য কোয়ালিফাই করতে না পারা জাপান প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলে ১৯৯৮ ফ্রান্স বিশ্বকাপে। ২০০২ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে বিশ্বকাপ আয়োজন করে জাপান নিজেদের ফুটবলকে নিয়ে যায় অন্য মাত্রায়। সেবার রাশিয়া ও তিউনিসিয়াকে হারিয়ে আর বেলজিয়ামের সঙ্গে ড্র করে জাপান চলে যায় দ্বিতীয় রাউন্ডে। কিন্তু তাদের জয়যাত্রার সমাপ্তি হয় তুরস্কের বিপক্ষে ১-০ গোলে হেরে।
এরপর ২০০৬, ২০১০ ও ২০১৪—পরের তিনটি বিশ্বকাপে জাপানি ঝলক দেখা গেলেও বলার মতো ফল তারা পায়নি। কিন্তু হাল ছেড়ে দেওয়ার দেশ তো জাপান নয়। তারা ঠিকই এবারের বিশ্বকাপে নিজেদের উন্নতির ছাপ রাখল। বিশ্বকে জানিয়ে রাখল বিশ্ব ফুটবলে আরও ওপরের দিকে ওঠার ব্রত নিয়েই এগিয়ে চলেছে জাপানি ফুটবল। কে জানে ২০২২ কাতার বিশ্বকাপে জাপানি ফুটবলের নতুন সূর্যোদয় দেখা যাবে কিনা!
জাপানি ফুটবলের এই সাফল্য এশিয়াকে জাগিয়ে দিক। এশিয়ার দেশগুলো বুঝতে শিখুক, চেষ্টা করলেই ফুটবল খেলাটাকে খুব ভালো করেই খেলতে জানে তাঁরা। বলতে পারেন, জাপান বিত্তবান দেশ, জাপান প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত, কিন্তু জাপানের চেষ্টাটা দেখবেন না?
এই চেষ্টাই ফুটবলে জাপানকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে এল! চেষ্টাই তো সব! তাদের চেষ্টার উদাহরণটাই তো বাকি সবার প্রেরণা।