বিশ্বকাপ মানে চারিদিকে বৈভব আর অর্থের উৎসব। কোথাও খেলোয়াড়দের কোনো বিলাসীতায় বাঁধা নেই। আজকের দিনের ফুটবলের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছানো মানেই খেলোয়াড়দের রাজকীয় জীবন নিশ্চিত। কিন্তু সকলের সারাটা জীবন এমন ছিলো না।
সব মানুষ সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মায় না, সকলের শৈশব আনন্দে ভরা থাকে না। অনেককে শৈশবে লড়তে হয়েছে খাবারের জন্য, বেঁচে থাকার জন্য এবং একটু খেলার জন্য। এমন করেই অনেকে বড় হয়ে উঠেছেন এবং চলে এসেছেন এই বিশ্বকাপের আলোয়।
আজ ফিরে দেখা যাক এবার বিশ্বকাপের এমন কয়েকজন তারকাকে, যাদের শৈশব ছিলো ভুলে যাওয়ার মতো যন্ত্রণাময়।
মায়ের হত্যা দেখার স্মৃতি
জাকুব ব্লাজেকোওস্কি (পোল্যান্ড)![দুঃস্বপ্নের ছেলেবেলা থেকে বিশ্বকাপের আলোকিত মঞ্চে 25 ayB9ZBEENnMaNDpd IMDB](https://assets.roar.media/assets/ayB9ZBEENnMaNDpd_IMDB.jpg?w=750)
জাকুবের বয়স তখন মাত্র ১০। সেই বয়সে দেখেছিলেন নিজের বাবা ছুরি মেরে হত্যা করছেন মাকে। বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি জীবনের ওপর থেকে। সব আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। এমনকি ফুটবলও ছেড়ে দিয়েছিলেন। জাকুবের বাবার ১৫ বছরের জেল হয়ে গেলো। তারা দাদা এসে বড় ভাই দাউইদ ও জাকুবকে নিয়ে ভরণপোষণ করলেন।
এই সময়েই আরেকটি চমৎকার ঘটনা ঘটলো জাকুবের জীবনে। তার চাচা জের্জি ব্রেজেক এসে তাকে ফুটবলে উৎসাহ দেওয়া শুরু করলেন। এই ব্রেজেক ছিলেন পোল্যান্ড ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক। এই চাচার কারণেই মানসিক বিশেষজ্ঞর দ্বারস্থ হওয়া এবং ঐ স্মৃতিকে পেছনে ফেলে আবার ফুটবল মাঠে ফেরার চেষ্টা করা। চাচার চেষ্টা কাজে লেগেছে বলতে হবে। সেই জাকুব এখন বিশ্বকাপ দলের সাথে রাশিয়ায়।
ইমিগ্রেশন থেকে ফেরত
ফিরমিনো (ব্রাজিল)![দুঃস্বপ্নের ছেলেবেলা থেকে বিশ্বকাপের আলোকিত মঞ্চে 26 TkNCTNWmg62F5PW9 afp](https://assets.roar.media/assets/TkNCTNWmg62F5PW9_afp.jpg?w=750)
ফিরমিনোর বিশ্বকাপ খেলাটা একটা জাদুবাস্তবতার মতো ব্যাপার। এটা হওয়ার কথা ছিলো না। তিনি নিজেই শৈশবের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, “আমি যখন ছোট ছিলাম, আমার বাবা-মা আমাকে ফুটবল খেলতে দিতে রাজি ছিলেন না। তারা চাইতেন আমি যেন পড়াশোনা করি। কখনো কখনো আমাকে ঘরে তালা দিয়ে আটকেও রাখা হতো। যদিও আমি সুযোগ পেলেই দেয়াল টপকে খেলতে চলে যেতাম।”
ফিরমিনোর আরেকটা কাজ ছিলো। তাকে স্থানীয় বাজারে ডাবের পানি বিক্রি করতে হতো। এটা করতে হতো পরিবারের রোজগার বাড়ানোর জন্য।
কিন্তু এরকম পালিয়ে একদিন ফুটবল খেলতে থাকা ফিরমিনোকে দেখে ফেলেন স্থানীয় এক দাঁতের ডাক্তার মার্সেলুস পোর্তেলা। তিনি এই ছেলেটির খেলা দেখে তার এজেন্ট হয়ে যেতে চাইলেন। ২০০৯ সালে অলিম্পিক মার্শেইয়ের সাথে যোগাযোগ করে ফিরমিনোকে ট্রায়ালের জন্য নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হলো। কিন্তু ফ্রান্সে যাওয়ার পথে মাদ্রিদে আটকে গেলেন তিনি। এখানে ইমিগ্রেশন বিভাগ বলে দিলো, তাকে ছাড় দেওয়া হবে না। ১৭ বছর বয়সী ফিরমিনোকে ফিরিয়ে দেওয়া হলো দেশে। ফুটবল প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন তিনি হতাশায়।
দেয়ালে আঁকাই ছিলো যার কাজ
গ্যাব্রিয়েল জেসুস (ব্রাজিল)![দুঃস্বপ্নের ছেলেবেলা থেকে বিশ্বকাপের আলোকিত মঞ্চে 27 pki8LcxBOLe6ueHZ Ag%C3%AAncia Eleven](https://assets.roar.media/assets/pki8LcxBOLe6ueHZ_Ag%C3%AAncia-Eleven.jpg?w=750)
মাত্র চার বছর আগের কথা। জেসুস ছিলেন ব্রাজিলের রাস্তার পাশের রংমিস্ত্রী। ২০১৪ বিশ্বকাপের সময়ও প্রথম বিভাগ ফুটবলে অভিষেক হয়নি তার। সে সময় খুব মন দিয়ে ব্রাজিলের সাও পাওলো শহরের দেয়ালে ছবি আঁকতেন জেসুস। বিশ্বকাপ ছিলো তখন ব্রাজিলে। তাই মন দিয়ে বিশ্বকাপ তারকাদের ছবি আকতেন। খালি পায়ে রংয়ের ডিব্বা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো সেই ছেলেটি এখন ম্যানচেস্টার সিটির তারকা। সেই ছেলেটিই এখন বিশ্বের সবচেয়ে দামী বুট পরতে পারে চাইলে। তিনি এখন ব্রাজিলের বিশ্বকাপ দলের তারকা।
বাবার মৃত্যুর সেই দৃশ্য
হুয়ান গিলের্মো কুয়াদরাদো (কলম্বিয়া)![দুঃস্বপ্নের ছেলেবেলা থেকে বিশ্বকাপের আলোকিত মঞ্চে 28 THyiMccgyb1hIvZD travel colombia](https://assets.roar.media/assets/THyiMccgyb1hIvZD_travel-colombia.jpg?w=750)
১৯৯২ সাল; কলম্বিয়ার অ্যান্টিওকুইয়া প্রদেশের নেচোলি অঞ্চলের ঘটনা। কুয়াদরাদো তখন চার বছরের শিশু। এক আসবাবের আড়ালে লুকিয়ে ছিলো ছেলেটি। সেখান থেকেই শুনতে পাচ্ছিলো চিৎকার। একটু মুখ বাড়িয়ে দেখতে পেলো বাবা গুলি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে আছে। চারপাশ ভেসে যাচ্ছে রক্তে। একদল বন্দুকধারী সন্ত্রাসী এসে মেরে রেখে গিয়েছিলো তার বাবাকে।
সেই থেকে দুর্বিসহ এক জীবন কাটাতে করতে হয়েছে কুয়াদরাদো ও তার মাকে। তার মা একটি কলার খামারে কাজ করতেন। এরপর এক আইসক্রিম পার্লারে কাজ নিলেন। কুয়াদরাদো কখনো কখনো দাদীর কাছে থাকতেন। তবে একটা ব্যাপার কখনো ছাড়েননি। সেটা ফুটবল। ফুটবলই আজ তাকে রাশিয়ায় নিয়ে এসেছে।
যুদ্ধের কারণে বাবা-মাকে হারানো
ভিক্টর মোজেস (নাইজেরিয়া)![দুঃস্বপ্নের ছেলেবেলা থেকে বিশ্বকাপের আলোকিত মঞ্চে 29 raRE1Wc0QGggk9B6 afp 2](https://assets.roar.media/assets/raRE1Wc0QGggk9B6_afp-2.jpg?w=750)
ভিক্টর মোজেসের বাবা অস্টিন ছিলেন একজন খ্রিস্টান প্যাস্টর। আর মা জোসেফাইন তার কাজে সহায়তা করতেন। মোজেসের বয়স তখন ১১ বছর। একদিন রাস্তায় ফুটবল খেলছিলেন তিনি। তখনই হঠাৎ কে বা কারা চিৎকার করে বললো, তার বাবা-মাকে মেরে ফেলা হয়েছে। তিনি ছুটে গিয়ে দেখলেন সেই দৃশ্য। সেটা ছিলো ২০০২ সাল। নাইজেরিয়ায় তখন যুদ্ধ চলছে।
সেই সময় থেকে বেঁচে ফেরা মোজেস এখনও ভুলতে পারেন না বাবা-মাকে ওভাবে হারানোর যন্ত্রণা। ইংল্যান্ডে আশ্রয় নেওয়া মোজেস এক সাক্ষাৎকারে বলছিলেন, “আমরা তখন বুট ছাড়া, খালি পায়ে ছোট্ট বল দিয়ে রাস্তায় খেলতাম। সেই সময় ঘটেছিলো ঘটনাটা। এখন তারা যেখানেই থাকুন, আমার বাবা-মা নিশ্চয়ই আমাকে নিয়ে গর্ব করেন।”
সেই সময় পার করে আসা মোজেসের এটা দ্বিতীয় বিশ্বকাপ।
বোমার হাত থেকে বাঁচা
লুকা মদ্রিচ (ক্রোয়েশিয়া)![দুঃস্বপ্নের ছেলেবেলা থেকে বিশ্বকাপের আলোকিত মঞ্চে 30 bmTRTDNOnOUvztRc getti](https://assets.roar.media/assets/bmTRTDNOnOUvztRc_getti.jpg?w=750)
ক্রোয়েশিয়ার যুদ্ধ শুরু হয়েছিলো ১৯৯১ সালে। শেষ হয়েছে ১৯৯৫ সালে। মদ্রিচ তখন ছিলেন ৫ বছরের শিশু। তার শৈশব জুড়ে আছে ওই যুদ্ধের স্মৃতি। মদ্রিচদের ছোটবেলাতেই নিজেদের শহর ছেড়ে পালাতে হয়। এই যুদ্ধে মদ্রিচ তার বাবা স্টাইপকে হারিয়েছেন, যিনি ছিলেন ক্রোয়েশিয়ান আর্মির সদস্য। এই যুদ্ধে বাড়ির পাশেই বোমা বিস্ফোরণে মারা যান তার দাদা।
যুদ্ধ থেকে বাঁচার জন্য ছোট্ট মদ্রিচকে নিয়ে তার মা পালিয়ে যান। আরও অনেক উদ্বাস্তুর সাথে হোটেল কলোভারোতে জীবন কেটেছে তার এই সময়ে। আর এখানেই প্রথম ফুটবলের সাথে পরিচয় হয়।
মদ্রিচ এই সময়টা ভুলে যেতে চান। তিনি বলছিলেন, “ওই যুদ্ধ আমাকে আরও শক্ত করেছে। ওটা আমার জন্য, আমার পরিবারের জন্য খুব কঠিন সময় ছিলো। আমি ওই যুদ্ধের স্মৃতি আজীবন বয়ে বেড়াতে চাই না। তবে এটাও ঠিক যে, ওটা আমি ভুলতে পারি না।”
বাস চালক থেকে বিশ্বকাঁপে
কার্লোস বাকা (কলম্বিয়া)![দুঃস্বপ্নের ছেলেবেলা থেকে বিশ্বকাপের আলোকিত মঞ্চে 31 AmafEUPHoITHc4S6 bein sports](https://assets.roar.media/assets/AmafEUPHoITHc4S6_bein-sports.jpg?w=750)
বাকা নিজে নিজের গল্প বলেছেন, “আমি যখন ২০ বছরের ছিলাম। তখন আমাদের শহর পুয়ের্তো কলম্বিয়াতে আমি ছিলাম এক বাসের সহকারী। জীবন মোটেও সহজ ছিলো না। এরপর আমি বাসের ড্রাইভার হলাম। আমি খুব ছোট একটা পরিবার থেকে উঠে এসেছি। ফলে আমাকে পরিবার চালাতে টাকা আয় করতেই হতো। ফুটবলের দরজা আমার জন্য অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। আমি ওটা নিয়ে আর ভাবতাম না। সেই সময় হঠাৎ করে ব্রাঙ্কুইলা দলে আমার একটা ট্রায়াল দেওয়ার সুযোগ এলো এবং আমি পাস করে গেলাম।”
ওখান থেকেই জীবন ঘুরে গেলো বাকার। জীবনে অবশ্য শুধু বাসে চাকরি করেছেন, তা-ই নয়। একসময় জেলে হিসেবেও কাজ করেছেন এই নিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ খেলতে আসা ফুটবলার।
ছোটবেলা মানেই কান্না
ক্যাসিমিরো (ব্রাজিল)![দুঃস্বপ্নের ছেলেবেলা থেকে বিশ্বকাপের আলোকিত মঞ্চে 32 XIygWAFFop0eTVup getti 2](https://assets.roar.media/assets/XIygWAFFop0eTVup_getti-2.jpg?w=750)
ক্যাসিমিরো তার শৈশবের কথা বলতে গেলেই কান্না করেন। তার মা ছোটবেলায় বুঝতে দিতে চাইতেন না যে, তারা কত গরীব। সামান্য অর্থ ছিলো না, যা দিয়ে ছেলেটিকে দুধ কিনে খাওয়াবেন তিনি। ক্যাসিমিরো নিজে বলেছেন, “আমি ছোটবেলা খুব কষ্টে ও দারিদ্রে কাটিয়েছি। আমার মা আমাকে জোর করে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতেন। কারণ, তিনি জানতেন, তার কাছে আমাকে কিছু কিনে খাওয়ানোর টাকা নেই।” আজ ক্যাসিমিরো চাইলে হাজার শিশুকে কিনে খাওয়াতে পারেন। এখন ব্রাজিল মিডফিল্ডের অন্যতম ভরসা তিনি।