নৃত্যের তালে তালে আজ তুমি শতবর্ষে পা দিলে। ভারতীয় সংস্কৃতিকে যারা বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছেন তুমি তাদের একজন। এটা বাংলা কেন গোটা ভারতের সৌভাগ্য যে তুমি এখনও তোমার ভাবনা ও মননে আমাদের পথ দেখাচ্ছো। তোমার শিল্পকলা নিয়ে কোন আলোচনা করার দুঃসাহস আমার নেই। সাংবাদিক হিসেবে তোমার বাড়ি ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তোমার সঙ্গে আমার অনেকবার কথা হয়েছে। প্রতিবারই অবাক হয়েছি এই ভেবে যে এত সাফল্যের পরেও তুমি এত সহজ, সরল, সাধারণ থাকো কি করে? যে স্বকীয়তা বজায় রেখে তুমি তোমার নৃত্যকলাকে বিশিষ্ট করে তুলেছো সেই স্বকীয়তা তোমার জীবনযাপনেও। নাচ তো বটেই সবকিছুই তুমি কেমন যেন সহজভাবে করে ফেলো।
তোমার ছবি আমি বেশ কয়েকবার তুলেছি। প্রতিটি ছবি তোলাই যেন একেকটা বিশেষ অভিজ্ঞতা। কিন্তু এর মধ্যে একটি ঘটনার কথা আমি কোনদিনও ভুলতে পারবো না। সেদিন আমি তোমায় ও পণ্ডিত রবিশঙ্করকে মিথ্যে কথা বলেছিলাম। সেইজন্য আজ আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। ক্ষমা চাওয়ার এমন চমৎকার সময়ও আমার জীবনে আর আসবে না।
সম্ভবত ২০০০ সালে শুরুর দিকেই হবে। খবর পেলাম বহুদিন পর তোমার আদরের দেওর রবু মানে পণ্ডিত রবিশঙ্কর কলকাতায় আসছেন। অনিবার্যভাবে কলকাতার সব টিভি, খবরের কাগজ এয়ারপোর্টে হাজির। পন্ডিতজী এসব ব্যাপার চমৎকার হ্যান্ডেল করতেন। আমাদের দেখেই বিমানবন্দরের বাইরে হাসিমুখে পোজ দিলেন। নীল ট্রাউজার্স, হাতে কোট, পন্ডিতজীকে সেদিন দারুণ লাগছিল। সবার আবদার মিটিয়ে তিনি স্ত্রী সুকন্যাশঙ্করকে নিয়ে গাড়িতে তাঁর গন্তব্যের দিকে রওনা দিলেন।
আমি তখন আনন্দবাজারের কলকাতা কলকাতা বিভাগে প্রতিদিন ভেতরের পাতায় একটা বিশেষ ছবি তুলতাম। চমৎকার ক্যাপশান সহযোগে ছবিটা ছাপা হত। বলতে বাধা নেই এই ছবি তোলার সুত্রেই দেশের বহু সেলিব্রেটির সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ও যোগাযোগ গড়ে ওঠে। যা এখনও অটুট। যাকগে যা বলছিলাম, এয়ারপোর্টে ওই ছবিতে আমার ক্ষিদে মিটলো না। কারণ কলকাতা পাতার জন্য আমার একটা এক্সক্লুসিভ ছবি চাই। তাই বিশেষ কিছু করতে হবে ভেবে রবিশঙ্করের গাড়ির পিছু নিলাম। সেই গাড়ি ঢুকলো বালিগঞ্জের লালা শ্রীধরের বাড়িতে। পন্ডিতজী কলকাতায় এলে এই বাগান বাড়িতেই উঠতেন।
পন্ডিতজীর পিছু পিছু আমার গাড়িও সেই বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়েছে। আমায় দেখেই পন্ডিতজী বললেন, অ্যাই ছেলে, আজ আর কিছু হবে না। দুদিনের প্লেনের ধকলে আমি খুব ক্লান্ত। আজ আর কিছু কোরো না। একথা শোনার পর তার সচিব রবিন পাল আমায় প্রায় গেট পর্যন্ত নিয়ে এসে বিদায় দিলেন। আমি কিন্তু হাল ছাড়লাম না, একটু অন্যভাবে ভাবতে শুরু করলাম। একটা নতুন ভাবনা এলো। বাইরে গাড়িতে বসেই ফোন করলাম তোমার বাড়িতে। কাজের সূত্রে এই বাড়িতে আমার যাতায়াত ছিল। মমদি, তনুশ্রী আমায় ব্যাক্তিগতভাবে চিনতেন।
আমার সেই ফোন ধরলেন একজন হিন্দিভাষী মানুষ। আমি আমার নিজস্ব হিন্দিতে তাকে বললাম, অমলাশঙ্কর কোথায়? উনি বললেন, স্নান করতে গেছেন। আমি বললাম, ঠিক আছে আমি লালা শ্রীধরের বাড়ির থেকে বলছি। দিদিকে বলবেন রবিশঙ্কর ওঁর সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন। সব শুনে তিনি বললেন, একটু পরে ফোন করে দিদিকে বলুন। দশ মিনিট পর আমি আবার ফোন করলাম, তখন তুমিই ফোন ধরলে। আমি আমার সেই বিখ্যাত হিন্দিতে বললাম, পন্ডিতজী আপনাকে দেখতে চাইছেন। তুমি বললে, আমায় তো পরশু যেতে বলেছেন, এখন কেন? ঠিক আছে আপনি বলুন আমি পুজো সেরে যাচ্ছি।
আমি শ্রীধরের বাড়ির সামনে অপেক্ষা করতে থাকলাম। মিনিট ২০ পরেই দেখি তোমার গাড়ি লোহার ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢুকছে। ব্যস, আমিও ক্যামেরা নিয়ে ঢুকে পড়লাম। বাড়ির এদিক ওদিক দু একজন হিন্দুস্থানি লোক ঘোরাফেরা করছে। তুমি তাদের কাছে জানতে চাইলে রবিশঙ্কর কোন ঘরে আছেন? প্রথমবার ঢোকার ফলে আমি জানতাম তিনি কোন ঘরে আছেন। আমি নিজেই এবার তোমাকে নিয়ে সেই ঘরে ঢুকিয়ে দিই।
পন্ডিতজী খাটের ওপর বসেছিলেন। দূরে সুকন্যা একটা ছোট স্পিৎজ কুকুরকে আদর করছিলেন। তুমি ঘরে ঢুকেই বললে, কিরে রবু কেমন আছিস? দেওরকে তুমি এই নামেই ডাকতে। পন্ডিতজী অবাক হয়ে বললেন বৌদি তুমি এইসময়? তুমি বললে, কেন, তোর এখান থেকেই তো আমায় ফোন করে বললো তুই আমায় ডেকেছিস। পন্ডিতজী অবাক হয়ে বললেন, সে কি আমি তো এমন কথা কাউকে বলিনি – কী সব ভুতুরে কান্ড রে বাবা! এই কথা বলাবলির সময় আমি তোমাকে টেনে নিয়ে খাটে বসিয়ে দিই। পন্ডিতজী বৌদিকে জড়িয়ে ধরেন। তুমিও জড়িয়ে ধরলে আদরের রবুকে। সুকন্যাকে অনুরোধ করি পাশে এসে বসতে। উনি না চাইলে তোমার অনুরোধে পন্ডিতজীর পাশে এসে বসেন। পন্ডিতজী ও তুমি এবার আমার কাছে জানতে চাইলে, আমি কি করে এলাম? পন্ডিতজী বললেন, বৌদি আসবে জানলেই বা কি করে? আমি কোন কোনমতে ম্যানেজ করে তোমাদের দুজনকে প্রণাম করে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। বেরোনোর সময় রবিন পালের সঙ্গে দেখা। তিনি মিটিমিটি হেসে বললেন, তুমি একটা গুন্ডা। আমি তোমায় বাধা দিতে পারতাম। কিন্তু যে ফ্রেম তুমি আজ পেয়েছো তা যত্ন করে রেখে দিও। এটা ইতিহাস হয়ে থাকবে।
আমরা কয়েকজন চিত্র সাংবাদিক বন্ধু মিলে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো ডে -তে একটা চিত্র প্রদর্শনী করেছিলাম। তুমি মমদিকে নিয়ে সেই প্রদর্শনী দেখতে এসেছিলে। আমার খুব আনন্দ হয়েছিল। ছবিটা দেখার পর বারবার আমায় বলেছিলে, অশোক তুমি আমায় এই ছবিটা দিও। আমি বড় করে বাঁধিয়ে বাড়িতে রাখবো। মমদিও পাশে দাঁড়িয়ে অনুরোধ করেছিল, অশোক প্লিজ মাকে ছবিটা দিও। না অমলাদি, তোমায় ছবিটা এখনও আমার দেওয়া হয়নি। এটা আমার একটা বদভ্যাস। কিন্তু আজ কথা দিলাম তোমার বাড়িতে এই ছবিটা আমি পোঁছে দিয়ে তোমায় প্রণাম করে আসবো।
খুব ভালো থেকো।
প্রণাম নিও।
অশোক মজুমদার