লেলিনগ্রাদস্কির পার্কটা বিশাল। কবিগুরুর মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে বিদেশের মাটিতে বাঙালিয়ানা উপভোগ করার মাঝেই ছেদ পড়ল। এক প্রৌঢ় উঁকিঝুঁকি মারছেন। মানে গলায় ঝুলে থাকা ফিফার কার্ডটি দেখার চেষ্টায় রয়েছেন তিনি। চোখাচোখি হতেই একগাল হেসে প্রশ্ন, ‘ইন্ডিয়া?’ সম্মতিসূচক মাথা নাড়তেই পরের প্রশ্ন, ‘দ্য কান্ট্রি অব গ্রেট রবীন্দ্রনাথ টেগোর?’
মস্কোর সাতসকালে এভাবে যে রবি ঠাকুর ধরা দেবেন, কে ভেবেছিল! প্রশ্নকর্তার নাম আর্তুর ক্লোভোনায়া। পেশায় ব্যবসায়ী। তার থেকেও উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল, এতদিনে এই প্রথম এমন ঝরঝরে ইংরেজি বলতে শুনলাম কোনও রাশিয়ানকে। বলছিলেন, ‘তরুণ বয়সে প্রথম পড়েছিলাম গীতাঞ্জলী। তখন থেকেই আমি রবীন্দ্রপ্রেমী। বয়স যত গড়িয়েছে, টেগোরের প্রতি অনুরাগও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে।’
আশপাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে কিছু রুশ মানুষ। কেউ তাকাচ্ছেন মূর্তির দিকে। কেউ বা উদাসীন। এছাড়া আছেন সমর্থক। জার্মানি, স্পেনের…। দলের জার্সিই তাঁদের পরিচয়। বিশ্বকাপ দেখতে এসে বেরিয়েছেন মস্কো ঘুরতে। এমন একটা পরিবেশে হঠাৎ কবিগুরুর জন্য বাঙালি হিসেবে গর্ব হওয়াটা কম প্রাপ্তি নয়! অবশ্যই ওই কাব্যরসিক ব্যবসায়ী তার জন্য দায়ী। বলছিলেন, তাঁদের দেশের পুশকিনের সঙ্গে মিল খুঁজে পান রবি ঠাকুরের। দু’জনেরই জন্ম যুদ্ধের দেশে। সেখান থেকে দু’জনেই আন্তর্জাতিক কবি। আর শিল্পীও বটে।
পুশকিনের সেন্ট পিটার্সবার্গের খালপারের সেই বাড়িটিতে গেলে যে কেউ তাঁর স্কেচ, ড্রয়িং, নিজেকে নিয়ে আঁকা ব্যঙ্গচিত্র নিজের চোখে দেখতে পারবেন। মাঝেমাঝে তিনি পাণ্ডুলিপির মার্জিনেও এসব এঁকেছেন। এখানেও যে মিল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। কবিগুরুও তাঁর পাণ্ডুলিপিতে প্রথমে হিজিবিজি কাটাকুটি করতেন এবং সেখান থেকেই তৈরি হতো নির্দিষ্ট প্যাটার্ন। ভেসে উঠত এক একটা প্রতিকৃতি।
আসলে পার্কের নীরব রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে রাশিয়ার রবি ঠাকুরকে মাপতে গেলে একশোয় গোল্লা পেতে হবে। রাশিয়াজুড়েই আছেন রবীন্দ্রনাথ। শ্বেতলানা মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। তাঁর কাছেই শুনলাম, মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন-পাঠনে রয়েছেন বিশ্বকবি। গীতাঞ্জলীর বেশ কিছু কবিতা এবং রবীন্দ্রনাথের জীবন নিয়ে রয়েছে আদ্যন্ত একটা পেপার। উচ্ছ্বল শ্বেতলানা বললেন, ‘মূলত রাশিয়ান ছেলেমেয়েরাই টেগোরের ব্যাপারে আগ্রহী। অনেকে তো রিসার্চও করছেন।’
ঘরে-বাইরে বিশ্বকবির ছড়িয়ে থাকা শিকড়। যার সন্ধানে বেরলে একটা বই হয়ে যেতে পারে। ‘রাশিয়ার চিঠি’-র লেখক থেকে গিয়েছেন রাশিয়ার হৃদয়ে। রাশিয়ার অনেক সঙ্গীতশিল্পী, আর যন্ত্রশিল্পীই ভারতে যান অনুষ্ঠান করতে। যার মধ্যে অবধারিতভাবে থাকবেন রবীন্দ্রনাথ। তেমন বেশ কয়েকজনের কথা জানালেন শ্বেতলানা। কিন্তু বিশ্বকাপের মহামঞ্চে সেই সব শিল্পীদের হদিশ মেলাই তো ভার!
রাশিয়া মানেই এখন রঙের বাহার। সমর্থকদের ঢল। আর অবশ্যই ফুটবল মহাযুদ্ধ। সেখানে সাহিত্যের স্মৃতি হাতড়ানোর সুযোগ পাওয়াটাই মুশকিল। কিন্তু অসম্ভব নয়। একটু খুঁজতে হবে আর কী। আর তখনই একটু পুরনো দিনের মানুষদের সঙ্গে কথা বলে জোড়াসাঁকোর বাসিন্দাকে আবিষ্কার করতে হয় নতুনভাবে। আর প্রতিবার ফিরে আসে পুশকিনের সঙ্গে তাঁর একাত্ম হয়ে যাওয়া। আর্তুর বলছিলেন, ‘ভেবে দেখুন, দু’জনই ধনী বাবার সন্তান। নিরাপদ জীবন বেছে তো নিতেই পারতেন! কিন্তু দু’জনেই রুখে দাঁড়িয়েছেন শাসকের বিরুদ্ধে। এঁরা শুধু লেখক বা শিল্পী নন, সত্যিকারের আদর্শ।’
ভারত তো বিশ্বকাপের মূলপর্বে খেলার সুযোগই পায়নি। তাও জীবন কোথায় যেন সব দুইয়ে দুইয়ে চার করে দেয়! না হলে রোনাল্ডো, মেসিদের মায়াকাব্যের মাঝে এমন দেশ কীভাবে রুশদেশের হৃদয়ে জায়গা করে রাখে! রবি ঠাকুর যেখানেই থাকুন, নিশ্চয়ই বলছেন, তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি…।
–সোমনাথ বসু
(সংগৃহিত)