ভাবনার দিক থেকে দিল্লির রাজনীতিতে বাংলার নেতৃত্ব দেওয়ার কথা আমরা বইতে পড়েছি। কিন্তু আমার দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনে এর কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণ আমি পাইনি। জাতীয় রাজনীতিতে প্রণব বাবু, জ্যোতি বাবুর গুরুত্ব স্বীকার করেও আমি একথা বলছি। বাংলা আজ যা ভাবে কাল সারা দেশ তা ভাবে মহামতি গোখলের এই কথাটা যেন ইদানিং কালের রাজনীতিতে একটা বাতিল ভাবনা হয়ে গিয়েছিল। দিদি এই কথাটাতে যে
বাংলার কংগ্রেস সিপিএম ও বিজেপি নেতারা ২৪ ঘন্টা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যতই শাপশাপান্ত করুন না কেন তাকে ঘিরেই কিন্তু আজ আবর্তিত হচ্ছে দেশের বিজেপি বিরোধী রাজনীতি। দিদির সঙ্গে দিল্লি এসে এবার তারই প্রমাণ পেলাম আমি। সিপিএমের নেতারা নিস্ফল আক্রোশে তার বিরুদ্ধে যখন গালমন্দ করছেন ঠিক তখনই সারা দেশ জুড়ে বিজেপি বিরোধী ফেডারাল ফ্রন্ট গড়ে তোলার জন্য দিদি যে উদ্যোগ নিয়েছেন তাতে সামিল হওয়ার জন্য দিল্লির অন্ধ্র ভবনে বৈঠক করছেন দেশের চার মুখ্যমন্ত্রী। এই বৈঠকে কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারায় বিজয়নও ছিলেন। বঙ্গীয় বামেরা এতে বিরক্ত হলেও কিছু করার নেই। কারণ, ফেডারাল ফ্রন্ট আজ একটা বাস্তবতা। মোদী ব্রিগেডকে রুখতে গেলে এটা ছাড়া যে আর কোন উপায় নেই তা বিজয়নের মত বহুদর্শী প্রবীণ বামপন্থী নেতাও বুঝতে পেরেছেন। তাই কর্ণাটক, পশ্চিমবঙ্গ, অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে তিনিও এই বৈঠকে সামিল হয়েছেন। ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থের চাইতে দেশের মানুষের স্বার্থকেই বিজয়ন বড় করে দেখেছেন।
এখন দেশের ফেডারাল ফ্রন্টের রাজনীতি দিদিকে কেন্দ্র করেই ঘুরপাক খাচ্ছে। দিল্লির রাজনীতিতে পশ্চিমবঙ্গের একজন রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব এতটা গুরুত্ব পাওয়ার ঘটনা আমি আমার সাংবাদিক জীবনে দেখিনি। আগে দেখতাম পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যসভা নির্বাচনের প্রার্থী থেকে শুরু করে মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন তা ঠিক করে দিচ্ছেন হাইকম্যান্ড কিংবা পলিটব্যুরোর শিকড়হীন নেতারা। এখন সেই ছবিটা দিদি একেবারে বদলে দিয়েছেন। তারই দেখানো পথে চলেছেন দেশের তাবড় নেতারা। সিপিএম নেতারা দিদিকে গাল পাড়লেও দিদির সঙ্গে একই চিঠিতে সই করেছেন বিজয়ন। আবার কংগ্রেসও নিজেদের বড়দা সুলভ মনোভাব ছেড়ে আঞ্চলিক দলগুলিকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে। এই মনোভাবটাই আগে ছিল না। এটাও ঘটল সব বিরোধী শক্তিগুলিকে এক করার ব্যাপারে দিদির প্রচেষ্টার যে সাফল্য পাওয়া গেছে তার কারণেই।
দিদির রাজনীতি যে কত সঠিক তা বিজেপির প্রতিক্রিয়া দেখেও বোঝা যায়। এন ডি এ-এর শরিক দলগুলিকে চাকর বাকর মনে করা মোদী, অমিত শাহরাও ফেডারাল ফ্রন্ট গড়ার এই প্রচেষ্টায় ভয় পেয়েছেন। তারা আবার পাত্তা দিতে শুরু করেছেন নীতিশ কুমার আর উদ্ধব থ্যাকারেদের। বিরোধীদের মধ্যে রাজনৈতিক অনৈক্য যে শাসকদলের হাতই শক্তিশালী করবে দিদির বলা একথার গুরুত্ব কংগ্রেসও এখন বুঝতে পেরেছে। দিল্লির লোকসভা নির্বাচনে আসন সমঝোতার জন্য এখন তারা আপের সঙ্গেও আলোচনা চালাচ্ছে। উনিশে কি হবে জানি না কিন্তু এই মুহূর্তে দেশের সাধারণ মানুষের ওপর বিজেপি যে আক্রমণ নামিয়েছে তার একটা সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ জরুরি ছিল। দিদির প্রচেষ্টা মানুষের এই ইচ্ছেটাকে একটা বাস্তব চেহারা দিয়েছে।
দেশের ভালমন্দ এবং রাজনীতির নাড়ির গতি সঠিকভাবে বোঝেন বলেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন রাজনীতিতে কেউই অচ্ছুৎ নয়, সবাইকেই সঙ্গে নিয়ে পথ চলতে হবে এবং বিরোধী ভোট ভাগ হতে দেওয়া যাবে না। এই জন্যই একের বিরুদ্ধে এক শ্লোগান তুলেছিলেন তিনি। আজকে তো একথাটাই দেশের প্রায় সব নেতারাই বলছেন। কলেজ জীবনে শোনা ভূপেন হাজারিকার সেই বিখ্যাত গানটা মনে পড়ে গেল আমার প্রতিধ্বনি শুনি গো প্রতিধ্বনি শুনি। দিদির রাজনৈতিক ভাবনার প্রতিধ্বনি শুনছি দেশের কোণে কোণে।