করবেট সাহেব একাধিক বাঘ শিকার করলেও মানুষখেকো চিতা মেরেছিলেন মাত্র দুটি। ১৯১০ সালে পানারের চিতা বাঘ এবং ১৯২৬-এ রুদ্রপ্রয়াগের চিতা। পানারের চিতাবাঘটি প্রায় ৪০০ জন মানুষ মেরেছিল এবং রুদ্রপ্রয়াগের চিতার খপ্পরে পড়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন ১২৬ জন মানুষ। দীর্ঘ আট বছর ধরে বহু গ্রামের মানুষকে আতঙ্কিত করে রেখেছিল এই চিতাটি।
শিকারি হিসাবে করবেট সাহেব পরিচিত হলেও বন্য পশুকে হত্যা করা তিনি কিন্তু পছন্দ করতেন না। তাকে যে শিকার করতে হয়েছে সেটা খানিকটা পরিস্থিতির চাপে পড়ে, বাধ্য হয়ে। কুমায়ুন ও গাড়োয়ালের বিস্তীর্ণ পাহাড়ি অঞ্চলে যারা বাস করত তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে জঙ্গলের পথে যেতেই হত। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা উঁচু নিচু রাস্তা দিয়ে তাদের গৃহপালিত ছাগল বা গরু চড়াতে, জ্বালানীর জন্য গাছের শুকনো ডাল যোগাড় করতে, গ্রামের স্কুলে পড়তে যেতে, অন্য গ্রামের পরিচিত জন বা আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে অথবা বাজার হাট করবার জন্য জঙ্গলের পথে না গিয়ে উপায় ছিল না। তখন সে সব গ্রামে পাকা বা চওড়া রাস্তা কোথাও ছিলনা, গাড়ি ঘোড়া তো দূরের কথা। হিমালয়ের জঙ্গলে বিভিন্ন ধরণের বৈচিত্র্যময় পাখীর কূজন, দূর থেকে ভেসে আসা বন্য প্রাণীর ডাক বা কাছাকাছি বয়ে যাওয়া কোন নদীর স্রোতের শব্দ ছাড়া নৈঃশব্দ্য ভঙ্গের অন্য কোনো কারণ ছিল না। যাদের এরকম গ্রাম দেখার সুযোগ হয় নি এবং শহরাঞ্চলেই জীবন কেটেছে, তারা এই পরিবেশকে স্বপ্ন বলেই মনে করবেন। দারিদ্রে জীর্ণ এইসব মানুষেরা ছিল ধর্মভীরু এবং সহজ সরল জীবন যাত্রায় অভ্যস্ত। কিন্তু এই শান্ত ও নিস্তরঙ্গ পরিবেশ মাঝে মাঝে অশান্ত হয়ে উঠত মানুষখেকো বাঘের অত্যাচারে। সাধারণভাবে বাঘ মানুষকে নিজে থেকে আক্রমণ করে না, হঠাৎ সামনা সামনি পড়ে গিয়ে ভয় না পেলে। কিন্তু মানুষখেকো বাঘের কথা আলাদা। মানুষ শিকার করাই তাদের মূল লক্ষ্য।
বাঘের মানুষখেকো হয়ে ওঠার পিছনে অনেকগুলি কারণ করবেট সাহেব আমাদের জানিয়েছেন। সজারুর মাংস বাঘের প্রিয় খাদ্য। সজারু ধরে খেতে গিয়ে কোন কোন সময়ে সজারুর কাঁটা গভীরভাবে পায়ে বিঁধে যায় এবং আর বের হয় না। এতে বাঘ ক্রমশ: দ্রুত দৌড়োবার ক্ষমতা ও ক্ষিপ্রতা হারিয়ে ফেলে এবং এ কারণেই অন্য কোন শিকার ধরা তার পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। মানুষ বাঘের অত্যন্ত সহজ শিকার বলে, মানুষ মেরে খেতে খেতে ক্রমশ: মানুষখেকো হয়ে পড়ে। বাঘের বৃদ্ধ বয়সও এর জন্য দায়ী হতে পারে। অনেক সময়ে অন্য কোন শিকারির গুলিতে আহত হয়ে বেঁচে গেলেও কিছুটা অক্ষম হয়ে পড়ায় স্বাভাবিক শিকার ধরার ক্ষমতা অংশত: হারিয়ে ফেলে বাঘ ক্রমে মানুষখেকোতে পরিণত হয়। কোন এলাকার একটা বাঘ মানুষ মারতে শুরু করলে আশেপাশে বহু গ্রামের জীবন কার্যত বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। একটা বাঘ একদিনে অনেকদূর চলে যেতে পারে। তার গতিবিধি জানা না থাকায় বহু গ্রামের লোক তটস্থ হয়ে থাকে এবং সন্ধ্যার পরে বাড়ির বাইরে বেরোতে ভয় পায়। এরকম অনেক পরিস্থিতিতে জিম করবেটের ডাক পড়েছে – হয় গ্রামের মানুষের কাতর প্রার্থনা অথবা সরকার পক্ষ থেকে বাঘটি মারার জন্য অনুরোধ – এর কোন একটি বা দুটি কারণেই। এই অবস্থায় অনিচ্ছা সত্যেও করবেটকে বন্দুক হাতে তুলে নিতে হয়েছে, বিপন্ন গ্রামবাসীদের রক্ষা করার তাগিদে। বাঘ শিকার করেছেন তিনি মোট তেত্রিশটি। সবগুলি কাহিনী যে লিপিবদ্ধ হয়েছে তা নয়। তার প্রথম মানুষখেকো শিকার কুমায়ুনের চম্পাবত গ্রামে – চম্পাবতের মানুষখেকো নামে যে কাহিনী তার লেখা ‘ম্যান ইটারস অফ কুমায়ুনে’ তিনি বর্ণনা করেছেন। সরকারি নথি অনুযায়ী বাঘটি মোট ৪৩৬ টি মানুষ মেরেছিল। তবে সংখ্যাটা আরও বেশিই হবে কারণ সব মৃত্যুর খবর তো সরকারী দপ্তরে পৌঁছয় না।
করবেটের পূর্বপুরুষেরা আয়ারল্যান্ড থেকে ভারতে চলে এসেছিলেন। করবেটের মা ছিলেন মেরি জেন, আগ্রার চার্লস জেমস ডয়েলের স্ত্রী। সিপাহী বিদ্রোহের সময় মৃত্যু ঘটে চার্লসের। মেরির বয়স তখন মাত্র ২১ বছর, সঙ্গে তিনটি সন্তান। আলাপ হয় মুসৌরির ক্রিস্টোফার উইলিয়াম করবেটের সঙ্গে। ক্রিস্টোফার ছিলেন বিপত্নীক ও তিন সন্তানের পিতা। দু’পক্ষের ছ’টি ছেলেমেয়ে নিয়ে ক্রিস্টোফার ও মেরি নতুন সংসার শুরু করেন এবং ১৮৬২ সালে চলে আসেন নৈনিতালে। এই নৈনিতালেই (এখন উত্তরাখণ্ডে) ১৮৭৫ সালের ২৫শে জুলাই জন্মগ্রহণ করেন এডওয়ার্ড জেমস করবেট (পরে যিনি জিম করবেট নামেই খ্যাত)। জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন ইংরেজ। ষোল জন সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন অষ্টম। বাবা ছিলেন নৈনিতালের পোস্টমাস্টার। কাছেই কালাধুঙ্গি গ্রামে ছিল তাদের বাড়ি। ছোটবেলা থেকেই জিম বন্যপ্রাণী ও তাদের জীবনযাত্রা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসতেন। বন্য প্রাণীদের ডাক শুনে শুনে তার কান এত অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল যে তিনি সে সব ডাক অবিকল নকল করে শোনাতে পারতেন। বন্যপ্রাণীরাও বুঝতে পারত না সে ডাক আসল না নকল। অনেক সময়েই তার এই দক্ষতা পরবর্তী কালে তিনি শিকারের কাজে লাগিয়েছেন। স্থানীয় স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে নৈনিতালে এখন যেটা বিড়লা বিদ্যামন্দির, সে কলেজেরই তিনি এক সময়ে ছাত্র ছিলেন। ১৯ বছর বয়সে পড়াশোনায় ইতি টেনে রেল দপ্তরে চাকরিতে যোগদান করেন তিনি। করবেট ছিলেন একজন নামকরা ফটোগ্রাফার। বন্দুক হাতে নিয়ে চলার বদলে একটা ক্যামেরা থাকলে তিনি অনেক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। তার নামেই ১৯৫৭ সালে ‘করবেট ন্যাশনাল পার্কে’র নামকরণ হয়। ১৯৫৭ সালে জিম করবেট ও তার বোন ম্যাগি পূর্ব আফ্রিকায় কেনিয়ার নিয়েরি নামক স্থানে বসবাস করতে চলে যান। সেখানে তিনি বন্য প্রাণী সংরক্ষণের জন্য চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। এক সময়ে নিতান্ত নিরুপায় হয়ে যে বাঘ তিনি শিকার করেছেন তাদের সংখ্যা ক্রমশ: কমে আসায় তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ১৯৫৫ সালের ১৯শে এপ্রিল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি পরলোক গমন করেন।
ইংরেজ কুলোদ্ভব হয়েও জিম করবেট ছিলেন মনেপ্রাণে ভারতীয়। শিকারি জীবনে যে সব গ্রামে তিনি ঘুরে বেরিয়েছেন, সেখানকার গ্রামবাসীদের দারিদ্র্য, সরলতা, অমায়িক ব্যবহার ও অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা তাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। এদের প্রতি তার আন্তরিক ভালবাসা তিনি অকপটে তুলে ধরেছেন তার ‘মাই ইণ্ডিয়া’ নামক গ্রন্থে। বইখানি তিনি –“আমার বন্ধু, ভারতের দরিদ্র মানুষ”কে উৎসর্গ করেছেন। তার বিভিন্ন লেখায় এইসব দরিদ্র সরলমনা লোকদের কথা একাধিকবার উল্লেখিত হয়েছে। স্থানীয় লোকেরা তার নাম দিয়েছিল ‘কার্পেট সাহেব’।
জিম করবেটের লেখা উল্লেখযোগ্য বই গুলি হল – ‘ম্যান ইটারস অফ কুমায়ুন’ (১৯৪৪), ‘দি ম্যান ইটিং লেপার্ড অফ রুদ্রপ্রয়াগ’ (১৯৪৭), ‘মাই ইন্ডিয়া’ (১৯৫২), ‘জাঙ্গল লোর’ (১৯৫৩), ‘দি টেম্পল টাইগার অ্যান্ড মোর ম্যান ইটারস অফ কুমায়ুন’ (১৯৫৪)। এর মধ্যে প্রথম বইটির প্রথম সংস্করণ মোট আড়াই লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছে এবং ২৭টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। যারা তার লেখা পড়েছেন তারা জানেন যে তার লেখায় একটা আকর্ষণী শক্তি রয়েছে। একটা গল্প শুরু করলে শেষ না হওয়া পর্যন্ত বইটা ছাড়তে ইচ্ছা করে না। এমন ঝরঝরে ভাষায় সাবলীল ভঙ্গীতে তিনি তার যাত্রাপথ বা শিকারের বর্ণনা করেছেন যে মনে হয় যেন চোখের সামনেই সেগুলি ঘটছে। একা রাইফেল হাতে জঙ্গলের পথে দিনে বা কখনো কখনো রাতে মাইলের পর মাইল চড়াই উৎরাই পেরিয়ে পায়ে হেঁটে তিনি কি করে মানুষখেকো বাঘের পিছু নিয়েছেন ভাবলে অবাক হতে হয়। বেশ কয়েকটি পরিস্থিতিতে তিনি নিতান্তই দৈবক্রমে রক্ষা পেয়েছেন। ছোটবেলায় বন্য প্রাণীদের জীবনযাত্রা ও চলাফেরা সম্বন্ধে তিনি যে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন সে সব অভিজ্ঞতাই পরবর্তী সময়ে তাকে শিকারের কাজে সাহায্য করেছে।
জিম করবেটের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল তার নিরহঙ্কার ভাব ও অমায়িক ব্যবহার। তার লেখায় কাহিনীর নিখুঁত বর্ণনা ছাড়া কোন অতিশয়োক্তি, উচ্ছ্বাস বা গর্বের বিন্দু মাত্র ছায়া পড়ে নি। দিনের পর দিন বহু কষ্ট সহ্য করে, বিপদসংকুল পাহাড়ি পথে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে রাতের পর রাত জেগে কাটিয়ে যে সফলতা তিনি অর্জন করেছেন সেখানে কিছুটা উচ্ছ্বসিত হওয়াটা হয় ত খুব অস্বাভাবিক ছিল না, কিন্তু তার লেখায় সেটা কখনো প্রকাশ পায় নি। বাঘের হাত থেকে অত্যাচারিত গ্রামবাসীদের বাঁচানোতেই তার আনন্দ। এজন্য তিনি দিনের পর দিন শারীরিক কষ্ট সহ্য করতে বা ত্যাগ স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হন নি।
অনেকে বলেছেন যদি ভারতকে এতই ভালবাসতেন তবে দেশ স্বাধীন হবার পরেই তিনি ভারত ছেড়ে চলে গেলেন কেন। ঘনিষ্ঠ জনদের কাছে তার লেখা চিঠিতে প্রকাশ পেয়েছে, তার ভয় ছিল স্বাধীন ভারতে তার উপরে হয় ত অত্যাচার নেমে আসবে, ইংরেজ হওয়ায় তিনি হয় ত সুবিচার পাবেন না। ১৯৪৭-এর নভেম্বর মাসে লক্ষ্ণৌ থেকে মুম্বাই গিয়ে ‘এস. এস. অ্যারোন্দা’ জাহাজে মোম্বাসা, সেখান থেকে নাইরোবি হয়ে নিয়েরি শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন করবেট ও তার বোন ম্যাগি।
লক্ষ্ণৌতে যারা সেদিন করবেটকে বিদায় জানাতে এসেছিলেন তারা কেউ চোখের জল ধরে রাখতে পারেন নি। তার প্রিয় ভারতভূমি ছেড়ে যাবার আগে নৈনিতালের বাড়ি বিক্রি করে তার বহুদিনের বিশ্বস্ত সঙ্গী রাইফেল ও বন্দুকগুলি গভীর জঙ্গলে ‘সমাধিস্থ’ করে এসেছিলেন জিম করবেট।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )