একটু লায়েক হওয়ার পর থেকেই দেখছি কাশ্মীরে অশান্তি লেগেই আছে। অথচ কি চমৎকার জায়গা কাশ্মীর আর চমৎকার সেখানকার মানুষজন। অথচ এই মানুষগুলিই বছরের পর বছর একদিকে পাক মদতপুষ্ট জঙ্গি অন্যদিকে তাদের দমনের নামে সাধারণ মানুষের ওপর সেনাবাহিনীর নির্বিচার হামলার শিকার হচ্ছেন। অবস্থাটা দিন কে দিন আরও খারাপ হচ্ছে। যখনই কোন শান্তিপ্রক্রিয়া দানা বাঁধছে তখনই কোন আক্রমণ, হত্যা, বোমা বিস্ফোরণ কিংবা গুলি চালানোর মত কোন ঘটনা এবং খুন পরিস্থিতিটাকে আবার পুরনো জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ঈদের প্রাক্কালে ‘রাইজিং কাশ্মীরের’ সম্পাদক শুজাত বুখারির হত্যার মধ্যে দিয়ে এই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি হল। থেমে গেল একটা কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন ও বিবেকবান কণ্ঠস্বর।
স্পষ্ট কথার জন্যই অনেককে চটিয়ে ছিলেন শুজাত। নির্বিচার সেনা অভিযানের সমর্থকরা তাকে ভারতবিরোধী বলে দেগে দিয়েছিল। অন্যদিকে জঙ্গিরা বলতো তিনি ভারত সরকারের দালাল। শুজাত-র অপরাধ, তিনি দুপক্ষেরই কট্টর সমালোচক। তিনি আফজল গুরুর ফাঁসির হুকুমের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন, বারবার বলেছেন আফস্পা তুলে দেওয়ার কথা। জঙ্গি তকমা লাগিয়ে সাধারণ কাশ্মীরিদের ওপর দমন পীড়নের পাশাপাশি জঙ্গিদের যুক্তিহীন ভারত বিরোধিতা ও নির্বিচার খুনের বিরুদ্ধে বারবার রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। এর আগে জঙ্গিরা তিনবার তার ওপর হামলা চালিয়েছিল। অবশেষে তারা সফল হল।
কাশ্মীর কোন পথে এগোবে সেটা ঠিক করবেন সেখানকার মানুষ এবং নির্বাচিত সরকার। আর কারো সেখানে মাথা গলানোর কোন অবকাশই নেই। কিন্তু বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী লোক, যার মধ্যে রয়েছে পাকিস্তানের মদতপুষ্ট জঙ্গি এবং এদেশের ট্রিগারহ্যাপি সামরিক প্রশাসক এবং একশ্রেণীর রাজনীতিবিদ। এদের কাজকারবার অবস্থাটাকে কিছুতেই স্বাভাবিক হতে দিচ্ছে না। অশান্তি জিইয়ে রাখাটাই যেন তাদের একমাত্র অ্যাজেন্ডা। এরা দুদিকেই আছেন। শুজাতর হত্যা বস্তুত সেনা অভিযান স্থগিত রাখার প্রক্রিয়াটা বানচাল করার বড় পরিকল্পনারই একটি অংশ। হিন্দু ও মুসলমান দুই উগ্রপন্থাই চায় কাশ্মীরে শান্তি স্থাপনের যে কোন প্রয়াস ব্যর্থ হোক। কারণ, এটা না হলে তাদের হাতের তাসটাই চলে যাবে। ঈদের প্রাক্কালে সেনা অভিযান স্থগিত রাখার পর সংঘর্ষ এবং সন্ত্রাসের বাতাবরণ কাটিয়ে কাশ্মীর যখন আবার একটু একটু স্বাভাবিক হচ্ছে তখন শুজাতর হত্যা পরিস্থিতিটাকে আবার অশান্ত করে তুলবে।
শুজাত ছিলেন কাশ্মীরে শান্তি এবং সৌহার্দ্য ফিরিয়ে আনার পক্ষে সক্রিয় এক যোদ্ধা। বরাবরই তিনি এই জঙ্গিদের চক্ষুশূল। তবুও তার কলম থামেনি। বরাবরই তিনি আলাপ আলোচনা, সংলাপের মাধ্যমে কাশ্মীরের শান্তি ফিরিয়ে আনার প্রয়াসের সমর্থক। ‘রাইজিং কাশ্মীর’ শুরু করার আগে ১৫ বছর যখন তিনি হিন্দু পত্রিকার কাশ্মীরের ব্যুরো চিফ ছিলেন তখনও তিনি এই চেষ্টাই চালিয়ে গেছেন। শত হুমকি তাকে নীরব করতে পারেনি। এও এক আশ্চর্য পরিহাস যে, যে যুদ্ধবিরতির পক্ষে তিনি সরব হয়েছিলেন তারই সুযোগ নিল জঙ্গিরা। পাহারা ও কড়াকড়ি শিথিল হওয়ার পরপরই নিরস্ত্র শুজাত আততায়ীর হাতে বুলেটবিদ্ধ হলেন।
শুধু পুলিশি নজরদারি আর সেনা অভিযান নয়, তিনি বিশ্বাস করতেন কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের নানা স্তরের মানুষের পারস্পরিক সংলাপে। শান্তি ও সম্প্রীতি ফেরানোর প্রক্রিয়া হিসেবে ট্র্যাক টু ডিপ্লোম্যাসিতে বিশ্বাস করতেন তিনি। তার বিশ্বাস ছিল, শুধুমাত্র দুদেশের মন্ত্রী, নেতা, রাজনীতিবিদ, সেনানায়কদের মধ্যে আলোচনা সীমাবদ্ধ না রেখে ভারত ও পাকিস্তান দুদেশের মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং আলোচনার মধ্যে দিয়েই আবহাওয়া বদলাবে। লাগাতার সমালোচনা ও যুক্তিহীন কুৎসা কোনটাই তাকে থামাতে পারে নি। সঙ্গত কারণে ওপারের জঙ্গি এবং এপারের দমন পীড়নের সমর্থক সেনাবাহিনীর একটা অংশের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন শান্তিপ্রিয়, আলাপ আলোচনায় বিশ্বাসী একজন মানুষ।
কলকাতায় আমার যেসব সাংবাদিক বন্ধুদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল তারাও আমাকে বলেছেন খুবই হাসিখুশি মজাদার এবং বন্ধুবৎসল ছিলেন শুজাত। যে কোন পরিস্থিতিতে বন্ধুদের প্রয়োজনে সহযোগিতার হাত বাড়াতে তিনি রাজি ছিলেন। কাশ্মীরে রিপোর্ট করতে যাওয়া বহু সাংবাদিক তার এই বিশেষ গুণটির প্রমাণ পেয়েছেন। কিন্তু ঘটনা হল এই ধরণের মানুষকে কোন স্বার্থান্বেষীরা সহ্য করতে পারেনা। শুজাতর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিল। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভাল, আততায়ীদের হাতে কিছুদিন আগে নিহত গৌরি লঙ্কেশের হত্যাকাণ্ডের তদন্ত এখন অনেকদূর এগিয়েছে। পুলিশ সুত্রের পরশু নামে যে ব্যাক্তি তার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত সে একজন দক্ষিনপন্থী সংগঠনের লোক।
সাংবাদিকরা এদেশে কত অরক্ষিত শুজাতর হত্যা তা আরেকবার প্রমাণ করে দিল। ১৯৯২ থেকে ২০১৮-র মধ্যে ভারতে ৭৭ জন সাংবাদিক মারা গেছেন। সাংবাদিকদের পক্ষে বিপজ্জনক জায়গা হিসেবে চিহ্নিত দেশগুলির তালিকায় ভারতের স্থান এখন আট নম্বরে। নিজেদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করাটাই সাংবাদিকদের একমাত্র অপরাধ। এই অপরাধ করেছেন বলেই পরপর খুন হয়ে গেলেন গৌরী লঙ্কেশ, বিজয় সিং, নবীন নিশ্চল এবং সবশেষে শুজাত বুখারি। সাংবাদিকরা তবুও বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের নবকুমারের মতই তারা বারবার অন্যের উপকারের জন্য জঙ্গলে কাঠ কাটতে যাবেন। সমাজকে সুস্থ ও সুন্দর করে তুলতে বারবার স্বার্থান্বেষীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন শুজাতরা। আর রাষ্ট্রের ভূমিকা শুধুমাত্র বিবৃতি, ক্ষোভ এবং দুঃখ প্রকাশের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )