বিশ্বকাপ ফুটবল ঘিরে পাগলামি একেই বলে। ব্রাজিল বিশ্বকাপের সময় অ্যাটলেটিকো মিনেইরোয় আর্জেন্টিনা বেস ক্যাম্পের সময় দেখেছিলাম ক্যারাভান নিয়ে হাজির একদল মেসিভক্ত। বেস ক্যাম্পে ঢোকার অনুমতি ছিল না তাঁদের। তবু উৎসাহে ভাটা পড়েনি। থাকা–খাওয়া, রান্নাবান্না সবই ক্যারাভানে। এবার তেমনই অনেক ফুটবল উন্মাদ সমর্থকের দেখা মিলল রেড স্কোয়্যারে। কেউ সাইকেলে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে পৌঁছেছেন মস্কোয় প্রিয় দলকে সমর্থন জানাতে, কেউ কেউ আবার বাইকবাহিনী নিয়ে হাজির বিশ্বকাপের আসরে। তেলের খনির মালিক আরব দেশের সমর্থকরা অবশ্য এত কষ্ট করবেন কেন? চার্টার্ড বিমানেই আসা–যাওয়া।
এমনিতেই শনিবারের বিকেলে ক্রেমলিনের সামনে রেড স্কোয়্যারে উপচে পড়া ভিড়। কত দেশের মানুষ যে সেখানে হাজির, তা বলে শেষ করা যাবে না। তাঁদের অনেকের কাছে এটা রথ দেখা কলা বেচার শামিল। মস্কো ভ্রমণ আর বিশ্বকাপ ফুটবলের ম্যাচ দর্শনের কাজটা সেরে একরাশ তৃপ্তি নিয়ে দেশে ফিরবেন তাঁরা। লুঝনিকি স্টেডিয়াম থেকে মেট্রোতে পাঁচ স্টেশন দূরে অখতনি রিয়াদ। পাতাল ফুঁড়ে সেখান থেকে বেরোলে চোখের সামনে খুলে যাবে এক অপার বিস্ময়। এ যেন হ্যারি পটারের জাদুর দেশে কিংবা আলাদিনের রাজ্যপাটে প্রবেশ আশ্চর্য প্রদীপের জিনের কাঁধে চড়ে। ক্রেমলিনের রাজপ্রাসাদ যা এখন প্রেসিডেন্ট পুটিনের আবাস, তার ঠিক সামনে বিশ্বকাপের কাউন্ট ডাউন ঘড়িটা সেকেন্ড সেকেন্ডে জানান দিচ্ছে বিশ্বকাপ শুরুর ঘণ্টা বাজতে আর দেরি নেই। সেই ঘড়ির সামনে ছবি তোলার হিড়িক।
পেছনে বিশাল এক চত্বর। সেখানে শুধুই মানুষের মাথা। সকলেই হাঁটছেন সামনের দিকে কাজান ক্যাথিড্রালের পাশ ধরে। অন্যদিন সামনের লম্বা রাস্তাটা বিনা বাধায় পেরিয়ে পৌঁছে যাওয়ার সুযোগ পান সকলে মস্কোর ম্যাজিক সৌধ সেন্ট বাসিলের দরজায়। এখন সেটা সম্ভব হচ্ছে না মঙ্গলবারের রাশিয়া দিবসের জমকালো প্রস্তুতির জন্য। জায়গাটা অনেকটা ঘিরে ফেলা হয়েছে বিশিষ্ট অতিথিদের বিশেষ অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য। তৈরি হয়েছে অস্থায়ী গ্যালারি। তাতে কী, বেড়া আর ফুটপাথজুড়ে থাকা কাফে শপগুলোর পাশ দিয়ে পৌঁছে গেলাম সেন্ট বাসিলের সামনে। এই চার্চের বিশেষত্ব হল এর গম্বুজগুলো। যেন সত্যি রূপকথার রাজপ্রাসাদের গম্বুজের আদলে বানানো। উল্টো করে পেঁয়াজ যেন কেউ বসিয়ে দিয়েছে। শিশুদের লোভনীয় প্যাঁচালো ক্যান্ডির সঙ্গেও মিল আছে। সেখানে নানা দেশের মানুষের নানা অভিব্যক্তি। সেলফি তোলার ফাঁকে কেউ কেউ আবার নেচেও নিচ্ছেন। ওখানেই দেখলাম সৌদি আরব, মরক্কোর একদল সমর্থককে গলা জড়াজড়ি করে ছবি তুলছেন। নাচছেন, গাইছেন। লাফাচ্ছেন, নানারকম পোজ দিচ্ছেন মুহূর্তটাকে ঐতিহাসিক করে রাখবেন বলে।
ঢালু রাস্তা ধরে নিচের দিকে এগোতে চোখে পড়ল বিশ্বকাপের বল টেলস্টারের এক বিশাল সংস্করণ। তার সঙ্গে লাগানো স্লিপ। বড়রা সামনে দঁাড়িয়ে ছবি তুলছেন, আর ছোটরা স্লিপে গড়িয়ে মজা লুটছে। তবে বেশি অবাক হলাম সাইকেলে পাড়ি দেওয়া ইংল্যান্ডের দুই সমর্থককে দেখে। জ্যামি ম্যারিয়ট ও মিচেল জোনস। ২৪০০ মাইল পাড়ি দিয়ে এঁরা এসে পৌঁছেছেন মস্কো। এখানে কটা দিন কাটিয়ে সাইকেল নিয়ে পৌঁছে যাবেন ভলগোগ্রাদে প্রিয় দেশ-দল ইংল্যান্ডের খেলা দেখতে। তবে শুধু খেলা দেখেই থামবেন না তাঁরা। তাঁদের যাত্রা থামবে গিয়ে সাইবেরিয়ায়। এক মহৎ উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে এই যাত্রায়।
কীভাবে এমন একটা ভাবনা মাথায় এল? ম্যারিয়ট জানালেন, ‘বান্ধবীর সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজের টেবিলে মজার ছলে রাশিয়া যাওয়ার কথা বলেছিলাম। বান্ধবী চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল। সাইকেলে যেতে হবে বলেছিল ইংল্যান্ড থেকে রাশিয়া পুরো পথটাই। আমি তখনই বন্ধু মিচেলকে ফোন করি। কারণ এর আগে এমন দূরপাল্লার কঠিন রাস্তায় সাইকেলে ভ্রমণের অভ্যেস মিচেলের ছিল। ও প্রস্তাবটা সঙ্গে সঙ্গে লুফে নেয়। শুরু করে দি প্রস্তুতি। আমার বাড়ি হ্যাম্পশায়ারের এমসওয়ার্থ থেকে যাত্রা শুরু করে ফ্রান্স, জার্মানি, পোল্যান্ড, ইউক্রেন পেরিয়ে রাশিয়া ঢুকে পড়ার পরিকল্পনা নিয়ে ফেলি। সেইমতো মস্কো পৌঁছে গেছি। এবার গন্তব্য হবে ভলগোগ্রাদ। টিউনিশিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচে ইংল্যান্ডের জয় দেখতে চাই। একইসঙ্গে হ্যারি কেনের হাতে বিশ্বকাপ ট্রফিটা। নিঝনি নভগরোদ ও কালিনিনগ্রাদের বাকি দুটো ম্যাচেও যাব। সাইবেরিয়া ঘুরে ইংল্যান্ড ফেরার আগে সেন্ট পিটার্সবার্গটাও ঘুরে নিতে চাই। দেশটা বড় ভাল লাগছে। সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছি রাশিয়া ভিসার বদলে ফ্যান আইডি নিয়ে এদেশে ঢোকার ব্যবস্থা করায়। তবে টিকিটের দামটা বেশ বেশি। অনেকের সাধ্যের বাইরে।’
ম্যারিয়টের এই সাইকেলযাত্রার আর একটা মহৎ উদ্দেশ্য আছে। ববি মুর মেমোরিয়াল ফান্ডের জন্য অর্থসংগ্রহ করা। আসলে ম্যারিয়টের বন্ধু মিচেলের ফুটবল কোচ অকালে মারা গেছেন ক্যান্সারে। তাঁর দাদুও। ববি মুরের মৃত্যু হয়েছিল ওই মারণ রোগেই। এঁরাই তো বিশ্বকাপের আসল হিরো। ফুটবলের প্রাণ। মেসির মস্তানি, ক্রিশ্চিয়ানোর কেরামতি, নেইমারের নেতাগিরি তো এই সমর্থকদের পাগলামিকে কুর্নিশ জানাতেই।