বাংলাদেশে গতকাল মৌলবাদীদের হাতে খুন হয়েছেন মুক্তমনা প্রকাশক শাহজাহান বাচ্চু।
এই খুনের প্রতিবাদে এখন খবরের জন্যে বিশেষ কলাম লিখলেন বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীর সাবেক সভাপতি ও শাহবাগ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক বাপ্পাদিত্য বসু।
আবার টার্গেট কিলিং। এবার শাহজাহান বাচ্চু। বিচার চাই। আবার সুযোগ পেলে প্রতিশোধও চাই। সুযোগের
অপেক্ষায় থাকলাম। ওরা যেমন হত্যা করে, প্রতিশোধের ইতিহাসটাও কম নয়। এসব কোনো হত্যা প্রতিশোধ বিনে হারাবে না। আজ হোক বা কাল বা পাঁচ বছর পর। এইসব কালো অক্ষরে শোধের আগুন মাখা আছে।
এ প্রসঙ্গে দুটো কথা বলি। একেকটা হত্যাকাণ্ডের পর আপনারা যারা ‘দেশটা বাংলাস্তান হয়ে গেলো’, ‘এই দেশটা আমার না’ ইত্যাদি হতাশাব্যঞ্জক কথা বলছেন বা লিখছেন, তাদের সাথে আমি অন্তত একমত না। এসব বলার বা লেখার অর্থ হলো ওদের উদ্দেশ্য পূরণে প্রণোদনা দেওয়া। ওরা তো ‘বাংলাস্তান’ আর ‘দেশটা আমার না’ই দেখতে চায়। আমি বাপু, এসব বলে বলে দেশটাকে ওদের হাতে তুলে দেবার পক্ষে না। আমি লড়াই করার পক্ষে। জানি, জীবন যাবে, আরো যাবে, হয়তো আমারও যাবে। এতোটুকু জীবনের মধ্যে বারো বছর তো পার করলাম ওদের হুমকি সঙ্গী করে। কী আর হবে, বড়জোর খুন হবো। তবু শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত দেশটাকে ওদের হাতে তুলে দেবো না। লড়ে যাবো, মার খাবো, মারবোও। তবু প্রিয় বাংলাদেশকে কখনো ‘বাংলাস্তান’ বলে স্বীকার করবো না, কখনো বলবো না যে ‘দেশটা আর আমার নেই।’ ভেবে দেখুন তো একাত্তরে তো ত্রিশ লাখ জীবন গেছে, তখন যদি ‘দেশটা আমার না’ বলে আমাদের পূর্বপুরুষ হাল ছেড়ে দিতেন, দুই লাইন ক্ষোভ প্রকাশ করে গুটিয়ে যেতেন, তাহলে কিন্তু পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ হতো না। অনেক সঙ্কট আছে, অনেক পরাজয় আছে, অনেক জীবন গেছে ও যাবে, তবু হাল ছাড়বেন না, জোর গলায় বলুন, ‘ওরে শুয়োরের বাচ্চারা, আছি জেগে, তোদের মেরে তবে মরবো। এদেশ তোদের না, আমার এবং আমাদের।’
এখন কথা হচ্ছে, লড়াইয়ের রূপ কী হবে? রূপ হতে পারে বহুমুখী। সুযোগ এলে সামনাসামনি যুদ্ধও হবে। হেফাজতের সাথে তো সামনাসামনি মারামারিও হয়েছিলো। সেদিন আমি ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি ছিলাম। আমার স্বল্পসংখ্যক কর্মিদের নির্দেশ দিয়ে বলেছিলাম, ‘যদি এক বাপের জন্ম হোস আর ছাত্র মৈত্রী করিস তো যা, মেরে আয়। মারবি নয়তো মরবি।’ সেদিন লড়াই করেছিলেন আরো অনেক বীর সেনা। আবার যুদ্ধে যাবার ভয়ে শাহবাগের নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে ট্রাকমঞ্চে উঠে দাঁড়িয়ে খামাখা স্লোগান দিয়ে আত্মরক্ষা করতেও দেখেছি অনেককে। তারও বেশ আগে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর কেবলমাত্র লগি-বৈঠা হাতে জামাতের অস্ত্র-গুলি-বোমার সামনেও বুক চিতিয়ে লড়াই করেছি। সেদিনও পলায়নপর ছিলেন অনেকেই। সে রকম পরিস্থিতির সুযোগ এলে মুখোমুখি যুদ্ধ হবে। অন্যদিকে হাতের কলম চলবে, কি-বোর্ড চলবে। লিখুন, ওদের বিরুদ্ধে জোর সাহসে লিখে যান। ক’জনকে মারবে? একাত্তরের নয় মাসে যদি ত্রিশ লাখ মরতে পারে, তবে এবারের দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে নাহয় বড়জোর ত্রিশ হাজার মরবো। আমি, আপনি, আমাদের পাশের জন। তবু বাংলাদেশ কখনো ‘বাংলাস্তান’ হবে না। হবে না। হবে না।
আর লড়াই করুন নিজের সাথে নিজের। মনের কোণে লুকিয়ে থাকা অল্প একটু ভীরুতার বিরুদ্ধে, সুপ্ত পলায়নপর মনোবৃত্তির বিরুদ্ধে লড়াই করুন। সাহস আনুন। এ দেশ আমার, আমাদের। দুনিয়াজোড়া উগ্র ধর্মান্ধ সশস্ত্র সাম্প্রদায়িকতার যুগে আমরাও এ বিপদ থেকে মুক্ত নই। কিন্তু তাবৎ দুনিয়ার অন্য সব জাতির চেয়ে আমরা লড়াইয়ের হিম্মত রাখি বেশি। তাই আমাদের ভূমির মালিক কখনো জঙ্গিবাদীরা হবে না। হবে না। হবে না।
জীবন গেলে যাক, লড়াইটা চলুক। নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আপনি ইউরোপে পাড়ি দিলে বাংলাদেশের হয়ে যুদ্ধ করবে কে? ওখানে গিয়ে বা যাবার পরিকল্পনা ব্যাগের মধ্যে গুছিয়ে নিয়ে দুটো বড় কথা বলা যাবে, কাজের কাজ কিছু হবে না। তাই, এখানে থেকে, এ মাটিকে ধারণ করে লড়াই চলুক। আমরা হারবো না, আমরা হারতে শিখিনি।
জয় বাংলা।
শহিদ শাহজাহান বাচ্চু অমর হোন I
আমাদের লড়াইয়ের প্রেরণা হোন।