যে সময় বাঙালি ধনীরা বিদেশে তাদের ছেলেমেয়েদের ডাক্তারি কিংবা ওকালতি করতে পাঠাচ্ছেন ঠিক সে সময়ই রবীন্দ্রনাথ তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথকে বিদেশে পাঠাচ্ছেন কৃষিবিজ্ঞান পড়তে। শুধু পড়তে পাঠানোই নয়, শান্তিনিকেতনে তাকে কৃষি ও উদ্যানচর্চার সরঞ্জাম পাঠাতে চিঠি লিখছেন। এতটাই প্রথা ভাঙ্গা ছিল তাঁর ভাবনা। অথচ তাঁরই সৃষ্ট বিশ্বভারতীতে এখন তা অনুপস্থিত। এবারের বিশ্বভারতীর সমাবর্তন উৎসবে গিয়ে সেকথাই বারবার মনে পড়ছিল। তখন মঞ্চে দুজন প্রধানমন্ত্রী ও একজন মুখ্যমন্ত্রী উপস্থিত। কিন্তু দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ছাড়া বাকি দুজন অর্থাৎ বাংলা দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বক্তব্য রাখার কোন সুযোগ দেওয়া হল না। খোঁজ নিয়ে জানলাম, এটা নাকি বিশ্বভারতীর প্রথা।
অথচ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, এবং যে রাজ্যে বিশ্বভারতী সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী যদি এ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতেন তাহলে ছাত্রছাত্রীরা এদের শিক্ষাভাবনা সম্পর্কে জানতে পারতেন। এ সুযোগ কিন্তু বারবার আসে না। প্রথার গুঁতোতে তারা সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলেন। এর পাশাপাশি আমি আরও একটা স্ববিরোধ লক্ষ্য করলাম, বিশ্বভারতীর আচার্য নরেন্দ্র মোদী ছাড়া সেখানে বক্তব্য রাখার সুযোগ পেলেন বেলুড় মঠের মহারাজ স্বামী আত্মপ্রীতানন্দ। একাজটা কিন্তু ঘটল প্রথা ভেঙেই। তিনি রবীন্দ্রনাথ বাদ দিয়ে রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দের আদর্শ নিয়েই কথা বলেছেন। শিক্ষাকে বাদ দিয়ে হয়ে উঠল প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ হয়ে উঠল বস্তুত একটি রাজনৈতিক ভাষণ।
স্বাধীনতার পর থেকেই নেহরু- গান্ধী পরিবার যেন বিশ্বভারতীর দখল নিয়ে নিলেন। এখন সে কাজটাই করছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ১৯৫১তে বিশ্বভারতীতে আচার্য পদটি চালু করার বিলটি পাশ হয়। প্রথম আচার্য হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। থাকলেন ৫৩ পর্যন্ত। এরপর জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী এবং মনমোহন সিং আর ২০১৫ থেকে রয়েছেন আমাদের নরেন ভাই। মাঝখানে একমাত্র ব্যতিক্রম শুধু মোরারজি দেশাই, তিনি আচার্য হতে চান নি। শুধু প্রধানমন্ত্রীরাই একটা প্রথাভাঙা এবং ধরাবাঁধা পঠনপাঠনের বাইরে থাকা এমন একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আচার্য কেন হবেন তা আমার মত মুখ্যুসুখ্যু মানুষের মাথায় ঢোকে না। চিন্তা ভাবনার দিক থেকে বিশ্বভারতীতে প্রধানমন্ত্রীদের অবদান কি তা আমার বড়ই জানতে ইচ্ছা করে।
দিদি কিন্তু রাজ্যের শিক্ষা ক্ষেত্রেও তার উদ্ভাবনী ভাবনা নিয়ে আসার ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছেন। কন্যাশ্রী যোজনা, পড়ুয়াদের স্কুলে যাওয়ার জন্য সাইকেল, স্কুলে যাওয়ার পোশাক প্রদানের মধ্যে দিয়ে তা ইতিমধ্যেই আমরা দেখতে পেয়েছি। স্কুল শিক্ষা থেকে শুরু করে এখন তা উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রেও প্রসারিত হচ্ছে। শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর পাশেই বিশ্ব বাংলা বিশ্ববিদ্যালয় নামে তিনি যে বিশ্ববিদ্যালয়টি গড়ে তুলতে চলেছেন তাতে রবীন্দ্র ভাবনারই একটি আধুনিক রূপ ফুটে উঠবে। আমার সৌভাগ্য দিদির সঙ্গে ৩৫ বছর থাকার সুবাদে আমি দেখেছি, শিক্ষাসহ যে কোন বিষয় নিয়ে, বিশেষ করে সমাজের গরীব ও অনগ্রসর সম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ে নিজস্ব ভাবনা আছে। আমার বিশ্বাস, এই ভাবনার জোরেই প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়টি হয়ে উঠবে প্রকৃত অর্থেই একটা সেন্টার অফ এক্সসেলেন্স। যেখানে শিক্ষা শুধু পুঁথিগত পঠনপাঠন হয়ে থাকবে না বরং তা হয়ে উঠবে একটা কর্মের দর্শন, যা এগিয়ে নিয়ে যাবে বাংলার শিল্প ও প্রযুক্তিকে। গড়ে তুলবে জ্ঞানচর্চার একটা আবহাওয়া।
মুখ্যমন্ত্রী আচার্য হতে চান বা না চান সেটা সম্পূর্ণ নিজস্ব ব্যাপার। এ ব্যাপারে আমার কোন বক্তব্য নেই। তবে দিদির শিক্ষাভাবনায় যে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি সমৃদ্ধ হবে তা নিয়ে আমার মত মূর্খ মানুষেরও কোন সন্দেহ নেই। আমি স্পষ্টভাবে জানাতে চাই স্রেফ পদাধিকার বলে শিক্ষার জন্য কোন কাজ না করা দেশের প্রধানমন্ত্রী যদি বিশ্বভারতীর আচার্য হতে পারেন তাহলে রাজ্যসরকারের উদ্যোগে গড়ে ওঠা বিশ্ব বাংলা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হতে দিদির বাধা কোথায়? তিনিই তো এ পদের সবচেয়ে উপযুক্ত লোক। এভাবেই তো তার কাজ ও শিক্ষা ভাবনাকে সন্মান জানাতে পারি আমরা। এটা শুধু তাকেই সন্মান জানানো নয় তিনি শিক্ষায় যাদের এগিয়ে আনতে চাইছেন তাদের আকাঙ্ক্ষাকেও সন্মান জানানো। রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান বলেই এখানে উচ্চশিক্ষার সম্ভাবনা ও সমস্যা এবং ছাত্রছাত্রীদের চাহিদা সম্পর্কে তিনি সবচেয়ে বেশি ওয়াকিবহাল। অ্যাসেম্বলিতে বিল এনে একাজটা সহজেই করা যেতে পারে। অবশ্য এটা আমার ব্যাক্তিগত অভিমত। বিশ্ববাংলা বিশ্ববিদ্যালয় পশ্চিমবঙ্গের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যকে আবার ফিরিয়ে আনবে বলেই আমার বিশ্বাস। আমলাদের নিয়ে জেলায় জেলায় ঘুরে প্রশাসনের খোলনলচে বদলে দিয়েছেন দিদি। ঠিক সেভাবেই নতুন নতুন পাঠক্রম ও পঠন পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে শিক্ষার চলতি নিয়ম ভাঙার দুঃসাহস দেখাবে এই বিশ্ববিদ্যালয়। দিদি ছাড়া এই প্রতিষ্ঠানের আচার্য আর কেই বা হতে পারেন?
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )