তুতুকরিতে এক ভারতীয় বহুজাতিক শিল্প গোষ্ঠীর স্বার্থে রাষ্ট্রীয় হত্যা এ দেশের গণতন্ত্রের মুখোশটা আর একটু ছিঁড়ে দিয়েছে। তবে রাষ্ট্রের কুৎসিত মুখটা এখনও অনেকটাই ঢাকা।
মাত্র একমাস আগেই মহারাষ্ট্রের বনভূমিতে খান তিনেক শিল্প গোষ্ঠীকে সম্পুর্ন বেআইনি ভাবে বনবাসীদের জমি আকরিক লোহা খননের জন্যে তুলে দেওয়ার প্রতিবাদে গ্রামবাসীরা বিক্ষোভ দেখালে অন্তত তিরিশ জনকে রাষ্ট্রের বিশেষ বাহিনী গুলি মেরে পাশের নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে। সেখানে কোন টিভি ছিল না, কোন খবরের কাগজের সাংবাদিক ছিলেন না। রাষ্ট্রের জানানো খবরে আমরা জেনেছি ‘সুরক্ষা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে কয়েকজন মাওবাদীর” মৃত্যু হয়েছে।
নকশাল বা মাওবাদী বলে দেগে দিতে পারলে রাষ্ট্র যেকোন নাগরিককে মেরে ফেলার নৈতিক সমর্থন পায় আম নাগরিকদের থেকে। তুতুকরির মৃত্যু আলাদা কারণ এই বন্দর শহরটি ঝাড়ঘন্ড, মহারাষ্ট্র, ছত্তিসগড়, মধ্যপ্রদেশ বা ওড়িশার বনভূমি নয় যে রাতের অন্ধকারে হত্যালীলা সাঙ্গ করে লাশ গুম করে দেবে প্রশাসন। পেড মিডিয়ারও চোখের চামড়া আছে। তাই তুতুকরির বেদান্ত সংস্থার বিরুদ্ধে নাগরিকদের আন্দোলনের কথা আমরা জানতে পারি, হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভে সামিল হতে পারি। রাষ্ট্র এখানে নাগরিকদের “মাওবাদী” বলে দেগে দিতে পারেনি যেভাবে মুলবাসীদের জল জঙ্গল জমির লড়াইকে হামেশাই করে থাকে গণতন্ত্রের মুখোশ ধারী ভারত রাষ্ট্র।
বেদান্ত সংস্থার বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ নতুন নয়। কিন্তু সংস্থার কর্ণধার ও দক্ষ প্রশাসকরা জানেন কিকরে জনমতকে নিজেদের পক্ষে রাখতে হয়। আর দশটা দূষণকারী মাইনিং কোম্পানি সাধারণত যা করে ওরা সেটাই করেছে। শাসক দলকে দুহাতে টাকা জুগিয়েছে, মিডিয়া, বুদ্ধিজীবীদের নানা ভাবে সাহায্য করেছে।’শিল্প সংস্থার সামাজিক দায়িত্বের” ঢাক পিটিয়েছে। জয়পুর সাহিত্য সম্মেলনের মত আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। সমালচিতও হয়েছে ! কিন্তু নাগরিকদের জল জঙ্গল জমির অধিকার কেড়ে নেবার পর তাদের শ্বাস নেবার বাতাসও দূষিত করে ছেড়েছে ওরা। শ্বাস কষ্টে ধুঁকতে ধুঁকতে অঞ্চলের কুড়ি হাজার মানুষ প্রতিবাদী মিছিলে সামিল হলে বরপুঁজির বন্ধু রাষ্ট্র তাদের গুলি করে মেরেছে। রাষ্ট্র তাই করে। আমরা খবর পাই না। খবর রাখিও না।
তুতুকরির কারখানা খোলার জন্যে চাপ শুরু হয়েছে। এটা নীলকণ্ঠের দেশ। বিষ আমাদের রক্তে। তাই পেটের তাগিদে কারখানা খোলার আবেদন করেছে তুতুকরি পোর্টের স্টিভেদরদের (যারা জাহাজের মাল খালাস করে) সংগঠন। তাদের যুক্তি খুব পরিষ্কার। কারখানার খনিজ দ্রব্য আসে অস্ট্রেলিয়া থেকে। টন টন সেই খনিজ পদার্থ জাহাজ থেকে যারা খালাস করেন তারা এখন বেকার। কারখানার বিষে সে অঞ্চলে সমুদ্রে ম্যাছও পড়েনা জালে! গোটা অঞ্চলটাই এখন নির্ভরশীল এই কারখানাটির উপর, তা যতই দুষণ ছড়াক! দ্বিতীয় যে গোষ্ঠীটি কারখানা খোলার দাবি করছে তারা হলো তামা ভিত্তিক বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম প্রস্তুত করার সংস্থাগুলো। তামার যোগান বন্ধ হয়ে গেলে তাদেরও উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে! সঙ্গে অনিশ্চিত হবে হাজারো মানুষের রুটি রুজি!
রাষ্ট্র ও ব্হুজাতিক বড় পুঁজির মালিকরা আম নাগরিকের এই দুর্দশা ও অসহায়তার কথা জানে। তাই উন্নয়নের নামে এতো বেপরোয়া হতে পারে রাষ্ট্র। তবু আমরা বড় পুঁজি ভিত্তিক উন্নয়নের নেশা ছাড়তে পারি না !
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )