একাত্তরের ভারত পাকিস্তান সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে লেখা হারিন্দর সিক্কার “কলিং সেহমত”,এর গল্প নিয়ে তৈরী “রাজি”| এক সাধারণ কাশ্মীরি পরিবারের মেয়ে, বাবার ইচ্ছে পূরণ করতে পাকিস্তানি আর্মি অফিসার কে বিয়ে করতে রাজি হলো, যার আসল কারণ পাকিস্তানী আর্মির ইনফরমেশন সঙ্গোপনে ইন্ডিয়ান আর্মির কাছে পৌঁছে দেওয়া| এক অতি সাধারণ মেয়ের স্পাই ট্রেনিং নেওয়া, বিয়ে করে একদিকে সামাজিক দায়বদ্ধতা আবার অন্য দিকে নিজের দেশ রক্ষার কর্তব্য পালন এই দুইয়ের মাঝখানে সেহমত খান – এক অতি সাধারণ মেয়ের ধীরে ধীরে অসাধারণ হয়ে ওঠার গল্প “রাজি”|
ধর্মা প্রোডাকসন্স, তলওয়ার এর পর মেঘনা গুলজার, ডিয়ার জিন্দেগীর পর আলিয়া, এবং হিন্দি সিনেমার স্পাই থ্রিলার – যার কেন্দ্রীয় চরিত্র একজন মহিলা, সব মিলিয়ে ট্রেইলার দেখার পর থেকেই রাজি নিয়ে বেশ আগ্রহ তৈরী হয়েছে, এবং দেখার সময় একেবারেই হতাশ হতে হয়না|
স্পাই ট্রেনিং এর দৃশ্য গুলো ভীষণ ভাবে বিশ্বাস যোগ্য করে তুলেছেন আলিয়া এবং খালিদ মীরের চরিত্রে, জয়দীপ আহলাওয়াত| বিয়ের পর সেহমতের, তার নতুন পরিবারের সবার মনে জায়গা করে নেওয়া, তাদের বিশ্বাস ভাজন হয়ে ওঠার আড়ালে ঠিক সময়ে জরুরি ইনফরমেশন ইন্ডিয়ান আর্মির কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি, সময় বিশেষে হিন্দুস্তানী আদব কায়দা গুলোও বার বার বেরিয়ে এসেছে সেহমতের দৈনন্দিন সাংসারিক জীবনে একপ্রকার অজান্তেই| এমন সিকোএন্স গুলিতে আলিয়া তার অনবদ্য এবং সাবলীল অভিনয় দক্ষতায় সিনেমাটিকে এক অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন| প্রসঙ্গতঃ ছবির ডিরেক্টর মেঘনা গুলজার এই সিনেমার মধ্যে কখনই ভারত পাকিস্তান মধ্যেকার দেশগত, সামাজিক রীতিনীতির পার্থক্যের বিষয় গুলিকে অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপনা করেননি| যেই কারণে ছবিটা আরও বেশি বাস্তব কেন্দ্রিক হয়ে উঠতে পেরেছে|
সেহমতের স্বামীর চরিত্রে ভিকি কৌশল, এই ছবির অন্যতম প্রাপ্তি| ভিকির আগের অভিনীত ছবির নিরিখে ,ইকবাল সম্পূর্ণ রূপে এক অন্য ব্যক্তিত্ব| যা নিজের অভিনয় দক্ষতার উপর ভিত্তি করে সম্পূর্ণ ভাবে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে সামান্যতম কার্পন্য করেননি ভিকি|
সেহমত এবং ইকবালের দৃশ্য গুলোতে আলিয়া আর ভিকির অভিনয় টাইমিং, শরীরী ভাষার মাধ্যমে এত সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন যে মাঝে মাঝে সংলাপ ও প্রয়োজনীয়তা হারিয়েছে|
এই ছবির অন্যতম বড় পাওনা ছবির চরিত্র অভিনেতারা| রজিত কাপুর, সোনি রাজদান, শিশির শর্মা, আব্দুল জাকারিয়া, অমরুতা খানভিল্কার, নিজেদের চরিত্র গুলিতে খুবই যথাযথ|
মেঘনার ডাইরেকশনে মুন্সিয়ানার পরিচয় মেলে, যখন সেহমত আব্দুলের কাছে প্রায় ধরা পরে যাচ্ছে যে, সে আসলে একজন ভারতীয় গুপ্তচর – সেই দৃশ্যে যে সিনেম্যাটিক টেনশন তিনি তৈরী করেছেন তা দর্শককে বসে থাকতে একপ্রকার বাধ্য করেছে|
তবে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল – ১৯৭১ এর প্রায় কুড়ি বছর আগের গান “শোলা জো ভড়কে” অনুকরণে গান গেয়ে একজন ছাতা বিক্রেতা (আসলে ইনফর্মার)কেন ফেরি করছেন?
ছবির মিউজিকের কথা না বললে অনেক কিছুই বাকি থেকে যায়, শঙ্কর-এহসান-লয় এবং টাবির সুর, বিজিএমই হলো ছবির ভীত| খুব ফাস্ট এডিট, প্রচুর কাট শট, না রেখে প্রয়োজনে কিছু দৃশ্যে শুধু মাত্র ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মাধ্যমেই ছবির টেনশন ধরে রাখা হয়েছে| সুনিধি এবং অরিজিতের গাওয়া ” আয়ে ওয়াতন” গানটিতে সত্তরের দশকের দেশাত্মবোধক গান গুলির মতই সুন্দর| হর্ষদীপ কৌর এর “দিলবরো” গানটি শুনলে মনে হয় এ যেন সত্যিই কোনো কাশ্মীরি গান| ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে রবাব এবং সাজের ব্যবহার মন ছুঁয়ে যায়|
সব শেষে আলিয়া এই ছবির প্রাণ, মস্তিস্ক, হৃদয়, মেরুদন্ড এবং আরও অনেক কিছু| বাকি চরিত্র শিল্পীদের সহযোগিতায় এই ছবিতে তার পারফরমেন্স একে বারেই সুউচ্চ পর্যায়ের| আবার বলতেই হচ্ছে, ছবিটা দেখতে গিয়ে কখনো কোনো ভাবেই মনে হয়না সেহমত খান সইদ আর আলিয়া দুটি আলাদা ব্যাক্তিত্ব, বরং নিজের অসাধারণ অভিনয় ক্ষমতা এবং দক্ষতা দিয়ে আলিয়া যেন অজান্তেই হয়ে উঠেছেন এক অতিসাধারণ, কাশ্মিরী যুবতী, পাকিস্তানী গৃহবধূ, ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইনফর্মার যার নাম সেহমত| প্রতিটি ছবিতে আলিয়া নিজের অভিনয় প্রতিভাকে যেভাবে দুমড়ে, মুচড়ে, ভেঙ্গে, চুরে তার থেকে এক নতুন অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটাচ্ছেন তাকে কুর্নিশ করতে বার বার বাধ্য হতে হয়| সব মিলিয়ে রাজি এমন একটা ছবি যা একাধিক বার দেখাযায় শুধু মাত্র আলিয়ার অসাধারণ অভিনয় ক্ষমতার জন্য| সেই কারণে যদি বলা হয় এই ছবিটি ২০১৮ সালের অন্যতম সেরা ছবি, তাহলে একেবারেই অত্যুক্তি করা হবে না|