“বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা
বাংলাভাষী শ্রীহট্ট জেলা ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে অসম প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় এক বিতর্কিত গণভোটে শ্রীহট্ট জেলাকে অসম থেকে বিছিন্ন করে পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, কিন্তু বৃহত্তর শ্রীহট্টের অনেকটাই নিয়ে বরাক উপত্যকা অসমের একটি জেলা হিসেবে ভারতে থেকে যায়। স্বাধীনতার আগে সরকারি লোকগণনার হিসেবে বাঙালি ছিল অসমের একক সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষাভাষী। দেশভাগের পরেও অসমে বাঙালি ছিল মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ, অসমিয়াও তাই, বাকি এক তৃতীয়াংশ পাহাড় কিংবা সমতলের নানা জাতি উপজাতি। স্বাভাবিক কারণেই সেই সময় অসমিয়া প্রধান সরকারি ভাষা ঘোষিত হলেও সমগ্র অসমে বাংলা চালু ছিল সরকারি স্তরে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে। কিন্তু তারপরেই শুরু হয় ঠান্ডা মাথায় ছক কষার কাজ। অসমের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ ঘোষণা করেন ‘Undoubtedly Assam is for Assamese’। তারই সুর ধরে অসম ট্রিবিউন পত্রিকা লেখে ‘Culturally, racially and linguistically every non-Assamese is a foreigner in Assam’.
এই পরিবেশে ১৯৫১ সালের লোকগণনায় ঘটানো হয় বিরাট কারচুপি, অসমিয়ার সংখ্যা বেড়ে হয় শতকরা ৫৫ ভাগ আর বাঙালি শতকরা ১৭ জন। এই ব্যাপক সংখ্যক অসমীয়া ভাষাভাষী মানুষের বৃদ্ধি ও বাংলাভাষী মানুষের হ্রাসকে তৎকালীন লোকগণনার অধীক্ষক আর বি ভাগাইওয়ালা চিহ্নিত করেন ‘Biological Miracle’ হিসেবে। এই সব কাগুজে মির্যাকলকে বাস্তবে রূপ দিতে ১৯৫১ সালের শেষ দিকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় সংঘটিত হয় ব্যাপক ‘বঙাল খেদা আন্দোলন’, ভাষা বিদ্বেষ পৌঁছয় চূড়ান্ত পর্যায়ে। প্রাণ বাঁচাতে বাঙালি পালায় শিলং, উত্তরবঙ্গ, কলকাতা। ভাষার প্রশ্নে স্থিতাবস্থা রক্ষার জন্য অসমের বিভিন্ন ভাষাভাষী অনসমিয়া জনগণ সম্মিলিতভাবে আবেদন জানান কেন্দ্রের কাছে, প্রতিবাদ হয় অসম বিধানসভায়। কিন্তু তাঁদের প্রবল আপত্তিকে উপেক্ষা করে অসম বিধানসভায় ১৯৬০ এর ১০ই অক্টোবর পাস হয় রাজ্যভাষা বিল – অসমের একমাত্র সরকারি ভাষা হয় অসমিয়া ।
এই ঘোষণার বিরুদ্ধে বাংলা ও অন্যান্য স্থানীয় ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে কাছাড়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে এক প্রবল ভাষা আন্দোলন। বাহান্নর চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে প্রথমে বাংলা ভাষাভাষীরা ১৯৬১-র ৫ই ফেব্রুয়ারি ‘গণসংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করেন। তারপর নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে দাবি আদায়ের জন্য ১৪ই এপ্রিল শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে পালিত হয় ‘সংকল্প দিবস’। সব শেষে ভাষা-আন্দোলনকারীরা ১৯৬১-র ১৯শে মে থেকে জেলাব্যাপী অহিংস সত্যাগ্রহের ডাক দেন। ভোর ছ’টায় শিলচর রেলস্টেশনে অহিংস সত্যাগ্রহীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সেনাবাহিনী, আরম্ভ হয় লাগাতার লাঠিচার্জ ও অবর্ণনীয় অত্যাচার। বেলা আড়াইটেয় অতর্কিতে, বিনা প্ররোচনায়, একটি তুচ্ছ ঘটনার সূত্র ধরে শিলচর স্টেশনে অহিংস সত্যাগ্রহীদের উপর এলোপাথাড়ি গুলি চালায় অসম রাইফেলস-এর একটি ব্যাটেলিয়ন। ঘটনাস্থলে প্রাণ হারান ভাষা-আন্দোলনের প্রথম নারী শহিদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ভাষাবিপ্লবী।
রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ ও বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য জওহরলাল নেহরু সেদিন অসমেই ছিলেন। পরিহাস এই যে সেদিনের সভায় নেহরু রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বহু কথা বললেও বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষার জন্য যাঁরা প্রাণ দিলেন তাঁদের নিমিত্তে একটি শব্দও ব্যয় করেননি।
বাংলা ভাষার জন্য শিলচরের বাঙালিদের এই অপরিসীম আত্মত্যাগ তার প্রাপ্য মর্যাদা আজও পায়নি। বনফুল এবং মনীশ ঘটক ছাড়া বাংলা সাহিত্যের আর কোনও নামজাদা লেখকের লেখায় এ ঘটনার উল্লেখ পর্যন্ত মেলেনি। পশ্চিমবঙ্গের আবেগজর্জর বাঙালি একুশে ফেব্রুয়ারির স্মরণে সভা সমিতি করেছে, রবীন্দ্র সদনের সামনে ঢাকার শহিদদের স্মরণে ফলকও বসিয়েছে অথচ শিলচরের শহিদদের নামোচ্চারণ করার প্রয়োজনটুকুও বোধ করেনি!
মাথা করো নত । / এ আমার এ তোমার পাপ ।”
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)