তিনি বলেছিলেন – ‘‘তুমি যদি সূর্যের মতো আলো ছড়াতে চাও, তাহলে আগে সূর্যের মতো পুড়তে শেখো।’’ তিনি আধুনিক ভারতের এক উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক, এক মহা মানব; যিনি ছিলেন একাধিক গুনের অধিকারী। তিনি ছিলেন একাধারে বিজ্ঞানী, লেখক ও সমাজচিন্তক, ছিলেন ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের একাদশতম রাষ্ট্রপতি (২০০২ – ২০০৭)। তাঁর উন্নত চিন্তাধারা আমদের চলার পথকে পাথেয় করে তোলে। তিনি আধুনিক যুগের নবীন প্রজন্মের প্রতীক, ক্ষেপণাস্ত্র বিজ্ঞানীদের অনুপ্রেরণা। অনাথ শিশুদের ভগবান। অসহায়ের শেষ সম্বল। সমগ্র ভারতের পরম প্রিয় অধ্যাপক, একজন বিজ্ঞানী এবং পরিশেষে একজন সফল রাষ্ট্রপতি। তিনি স্বপ্ন দেখতেন এবং সেই স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করতেন।
তাঁর বাকি সাত ভাইবোনের জন্য তাঁর মা শুধু ভাত রাঁধতেন। কিন্তু ছোট ছেলেটার জন্য করতেন বাড়তি কয়েকটা রুটি। কারণ, ভোর চারটেয় উঠে পড়তে বসবে ছেলেটা। তখন খিদে পাবে তো। শুধু তা-ই নয়। দিন-আনি-দিন-খাইয়ের সংসারে নামমাত্র পুঁজি থেকে কিনতেন বাড়তি কেরোসিন। কত রাত পর্যন্ত ছেলে পড়াশোনা করবে কে জানে! লেখাপড়া শিখেই যে এই ছেলে অনেক দূর যাবে, ঠিক জানতেন মা। স্বপ্ন দেখতেন, তাঁদের বাড়ির খুব কাছেই যে বঙ্গোপসাগর, সেই বিশাল সমুদ্রও ছাড়িয়ে যাবে তাঁর ছেলের নামডাক।
মায়ের সেই স্বপ্ন সত্যি করেছিলেন আব্দুল। তবে রাস্তাটা নেহাত সোজা ছিল না।
১৯৩১ সালের ১৫ই অক্টোবর। তামিলনাড়ুর রামেশ্বরমে এক অতি দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আবুল পকির জয়নুলআবদিন আব্দুল কালাম। বাবা জয়নুলআবদিন ছিলেন এক সাধারণ মৎস্যজীবী। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই রোজগারের তাগিদে খবরের কাগজ বিক্রি করতে হতো আব্দুলকে।
রামনাথপুরম স্কোয়ার্টজ ম্যাট্রিকুলেশন স্কুল থেকেই তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। স্কুলে, তিনি ছিলেন একজন খুবই সাধারণ মানের ছাত্র, কিন্তু পড়াশোনার প্রতি তাঁর মনোযোগ ছিল খুবই গভীর, সেইসাথে ছিলেন কঠোর পরিশ্রমীও। জানা যায়, তিনি নাকি নিজের পড়াশোনাকে আরো উন্নত করার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে যেতেন এবং অঙ্ক কষতেন। স্কুল পাশ করে কলেজে পড়ার জন্য একটা বৃত্তি পান তিনি। ভর্তি হন তিরুচিরাপল্লির সেন্ট জোসেফ কলেজে। ১৯৫৪ সালে সেখান থেকেই পদার্থবিদ্যায় স্নাতক। তার পর ফের স্কলারশিপ নিয়ে চেন্নাইয়ে। পড়তে শুরু করেন এয়ারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং। তাঁর স্বপ্ন ছিল ভারতীয় বায়ুসেনায় বিমানচালক হবেন। তাঁর ক্লাসের প্রথম আট জনকে বায়ুসেনায় যোগ দেওয়ার জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল। কালাম হয়েছিলেন নবম। সে-যাত্রায় তাই আর যুদ্ধবিমানের চালক হয়ে ওঠা হয়নি কালামের।
তার পরিবর্তে তিনি ‘ভারতীয় প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা’য় (‘DRDO’) নিযুক্ত হন এবং সেখানে হভারক্রাফ্ট প্রকল্পের সুন্দরভাবে পরিচালনা করেন কিন্তু ‘DRDO’-তে নিজের কাজে সন্তুষ্ট না হওয়ায় তিনি পরবর্তী সময়ে সেই সংস্থাকে ছেড়ে দেন। এরপর ১৯৬২ সালে, কালাম ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান, ‘ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন’ (‘ISRO’)-তে যোগ দেন আর সেখানে অনেক বছর কাজে করে বিভিন্ন মহাকাশ সম্বন্ধীয় পরিকল্পনার সফলপূর্বক পরিচালনা করেন। তাঁর সেখানে সবচেয়ে বিখ্যাত অবদান ছিল, যখন তিনি নিজের তৈরী ভারতের সর্বপ্রথম উপগ্রহ ‘রোহিনী’ অর্থাৎ ‘SLV3’-এর সফল উৎক্ষেপন করেন এবং সেটাকে পৃথিবীর কক্ষপথে স্থাপন করতে সফল হন। এছাড়াও তিনি ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ISRO’-এর হয়ে এমন অনেক মহাকাশ বিষয়ক কাজ করেছিলেন যার দৌলতে সেইসময় ভারত, আন্তর্জাতিক স্পেস ক্লাবের সদস্য হতে পেরেছিল। ‘ISRO’-তে কাজ করার সময় তিনি দেশ-বিদেশে অনেক খ্যাতি অর্জন করেন। সেই সময় তাঁকে আমেরিকার স্পেস এজেন্সী ‘NASA’-তে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কিন্তু সেখানে তিনি কাজ করতে রাজি হননি। এছাড়া সেইসময় তিনি ভারতের অপর এক বিখ্যাত বিজ্ঞানী ‘রাজা রামান্না’র সাথে মিলে ভারতের প্রথম পারমানবিক ক্ষেপনাস্ত্র তৈরী করতে সক্ষম হন।
বায়ুসেনার বিমানচালক হয়ে ওঠা তাঁর হয়নি, তবে নিজের অদম্য চেষ্টায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন দেশের ‘মিসাইল ম্যান’। ১৯৯৮ সালে পোখরান বিস্ফোরণ পরীক্ষার অন্যতম কারিগর ছিলেন তিনি। পড়াশোনার জন্য এক বারই শুধু গিয়েছিলেন বিদেশে, ১৯৬৩-৬৪ সালে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র ‘নাসা’য়। যে বঙ্গোপসাগরের দিকে তাকিয়ে স্বপ্নের জাল বুনতেন তাঁর মা আসিম্মা, সেই সমুদ্রসৈকতেই দু’দশক ধরে একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্রের সফল উৎক্ষেপণ করে গিয়েছেন ছেলে। রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে ছিলেন ডিআরডিও, ইসরোয়। মহাকাশ ও পরমাণু গবেষণায় তাঁর অবদানের জন্য ‘পদ্মভূষণ’, ‘পদ্মবিভূষণ’ ও ‘ভারতরত্নে’ সম্মানিত হয়েছিলেন আব্দুল কালাম।
২০০২ সালে ভারতের একাদশতম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন এপিজে। রাষ্ট্রপতি ভবনে ছিলেন ২০০৭ সাল পর্যন্ত। তাঁর সময়ে রাষ্ট্রপতি ভবনের দরজা সর্বসাধারণ, বিশেষ করে বাচ্চাদের জন্যখুলে দেওয়া হয়েছিল। ছেলে-বুড়ো,বিজ্ঞানী-শিক্ষক সকলের কাছেই তিনি ছিলেন ‘সর্বসাধারণের রাষ্ট্রপতি’। রাষ্ট্রপতি কালাম বলতেন, ‘‘আমি মনে করি একটি দেশকে দুর্নীতিমুক্ত ও সুন্দর মনের তৈরি করতে সমাজে তিনজন মানুষের প্রয়োজন যারা পরিববর্তন আনতে পারেন। এই তিন জন হলেন বাবা, মা ও শিক্ষক।’’ আর রাজনীতির কুশীলবদের জন্য তাঁর বক্তব্য ছিল – ‘‘আমার কাছে একজন নেতার আদর্শ সংজ্ঞা। একজন নেতা হবেন লক্ষ্য ও আবেগের সংমিশ্রণ। সমস্যা দেখলে ভয় পাবেন না তিনি। বরং তিনি জানবেন কীভাবে সমস্যাকে পরাজিত করতে হয়। সবথেকে বড় বিষয় তিনি সততার সঙ্গে কাজ করবেন।’’
আজ সকলেই জানেন যে, এ.পি.জে. আব্দুল কালামের ব্যক্তিগত জীবন খুবই সহজ এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ ছিল। তিনি ছোট বাচ্চাদের খুবই ভালোবাসতেন এবং তাঁদেরকে সর্বদা এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করতেন যেগুলো তাঁদের ভবিষ্যতকে আরও সুন্দর বানাতে সাহায্য করতে পারে। তিনি কখনই একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি ছিলেন না, কিন্তু রাজনীতিতে থাকার মাধ্যমে তিনি সর্বদা দেশের উন্নয়নের কথাই ভাবতেন। তিনি মনে করতেন, যুবসমাজের সুন্দর উন্নতিই পারে এই দেশকে অনেক আগে এগিয়ে নিয়ে যেতে। তিনি এটাও চেয়েছিলেন যে, পারমাণবিক অস্ত্র নির্মানের ক্ষেত্রে ভারত একটা বড় শক্তি হিসাবে পরিচিতি পাক বিশ্বের বুকে। তিনি বলেছিলেন – “দু’হাজার বছরের ইতিহাসে, ভারতকে ছ’শো বছর ধরে অন্য শক্তিরাই শাসন করেছে। যদি আপনি বিকাশ চান তবে দেশে শান্তির পরিস্থিতি থাকা অবশ্যক আর শান্তি, শক্তির দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত হয়। এই কারণে ক্ষেপনাস্ত্রকে বিকশিত করা উচিত যাতে দেশ শক্তি সম্পন্ন হয়।”
রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর তিনি আবার ফিরে যান পড়াশোনার জগতে। শিলং, ইনদৌর ও আমদাবাদের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট, তিরুঅনন্তপুরমের ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় এবং আন্না বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে নিয়মিত পড়াতেন। এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মঞ্চেই বক্তৃতা দিতে দিতে তাঁর হৃদ্রোগে আক্রান্ত হওয়া তাই এক আশ্চর্য সমাপতন!
ধর্মের গোঁড়ামি এড়িয়ে চলতেন বাবা-মা। ছোটবেলা থেকে মুক্তমনা ছিলেন আব্দুলও। গড়গড় করে মুখস্থ বলতে পারতেন ভগবদ্গীতা। কোরান শরিফও। তবে শুধু বইয়েই ডুবে থাকতেন না তিনি। তাঁর ঘনিষ্ঠরা জানাচ্ছেন, কোথাও যাওয়ার আগেই পকেট থেকে বার করে ফেলতেন ছোট্ট চিরুনি। নামাজাদা হেয়ার স্টাইলিস্টের কল্যাণে তৈরি হয়েছিল তাঁর নিজস্ব চুলের ছাঁট। আর সব সময় বলতেন, লেখাপড়ার কোনও বিকল্প হয় না। স্কুলপড়ুয়াদেরও বারবার অনুপ্রাণিত করে বলেছেন, নিজের ভবিষ্যতের কারিগর হতে গেলে মন দিয়ে পড়াশোনা করতে হবে। আর কখনও কাজে ফাঁকি দেবে না। নিজের জীবনেও এ কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গিয়েছেন। কর্মজীবনে ঠিক দু’দিন ছুটি নিয়েছিলেন, মায়ের আর বাবার মৃত্যুদিনে।
বলে গিয়েছিলেন, ‘‘আমার মৃত্যুতে ছুটি ঘোষণা কোরো না। আমায় যদি ভালবাসো, মন দিয়ে কাজ করো সে দিন।’’
এ.পি.জে আব্দুল কালাম সারা জীবন ধরে যা আয় করেছিলেন তার কিছুই তিনি নিজের জন্য সঞ্চিত রাখেননি, সব কিছুই তিনি দান করে গিয়েছিলেন। মানবতাই ছিলো তাঁর জীবনের শেষ কথা। তাইতো, সবাইকে তিনি মিলে মিশে থাকার পরামর্শ দিয়ে গিয়েছিলেন বার বার। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত শিক্ষামূলক কাজের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন তিনি। তাঁর অবদান, কোনো ভারতবাসী কোনোদিনই ভুলতে পারবেনা। তিনি আজও আমাদের প্রত্যেকের মনের গভীরে, অমর হয়ে আছেন এবং ভবিষ্যতেও থাকবেন।
(তথ্যসূত্র:
১- Illustrated Biography Of Dr Apj Abdul Kalam, Maanu Graphics Publishers (২০১৪)।
২- এপিজে আবদুল কালাম: শ্রদ্ধাঞ্জলি, তপন কুমার দে, মেরিট ফেয়ার প্রকাশন (২০১৬)।
৩- এপিজে আবদুল কালাম আত্মজীবনী: জীবনী, স্মৃতিচারণ ও সাক্ষাৎকার; সৈয়দ হোসেন ফারুক, গ্রন্থরাজ্য।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত