বুঝতে পেরেছিলেন কি অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, যে সেই বছর ১৪ই অক্টোবরের পরে আর তাঁর জীবনে কিছু পড়ে নেই? না’হলে তাঁর সেই খাতা, যাতে লেখা থাকত অন্তত মাসখানেকের আগাম কর্মসূচির ‘অ্যাপয়েন্টমেন্ট’, আর কিছু লেখেননি কেন সেখানে ১৪ই অক্টোবরের পর! ১৪ই অক্টোবর, ১৯৮৩ সালে সেবার পড়েছিল দুর্গাপুজোর অষ্টমী। আর সেদিনই চলে গেছিলেন তিনি এ’পৃথিবী ছেড়ে, ভোররাতে। এক নিদারুণ হার্ট অ্যাটাকে। মাত্রই দু’সপ্তাহ পার হয়েছিল তখন, তাঁর ৫০ বছরের জন্মদিন পূর্ণ হবার। খবর পেয়ে পাড়ার পুজো প্যান্ডেলের ছেলেরা সাত–আটজন ডাক্তারে ভরিয়ে দিয়েছিল তাঁর ঘর। কিন্তু ততক্ষণে পাখি খাঁচা ছেড়ে উড়ে গিয়েছিল। উড়ে যাবার বা পৃথিবী ছেড়ে যাবার আগে এই মহানটের শেষ বলা কথাটি ছিল, ‘‘আমি বোধহয় মরে যাচ্ছি, তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না।’’ কথাগুলি ডাক্তার আসার আগে যাঁর হাতের মুঠি ধরে অজিতেশ বলে গিয়েছিলেন, তিনি রত্না বন্দ্যোপাধ্যায়। অজিতেশের জীবনের শেষ এক যুগের জীবন–সঙ্গিনী। সমাজের অনুশাসন ‘তোয়াক্কা’ না করে যাঁর সঙ্গে অজিতেশের ঘর বাঁধা ও সহবাস। বেলেঘাটার সিআইটি রোডের দু–কামরার এক ফ্ল্যাটে। বাগবাজার–এর বাড়ি (যে বাড়িতে প্রতিবেশী ছিলেন অজিতেশ আর রত্না) ছেড়ে আসা ইস্তকই সেই বাড়িই ছিল অজিতেশের আমৃত্যু বাসভূমি। পি ৮৩এ, সিআইটি রোড, কলকাতা–১০; এটাই ছিল অজিতেশের শেষ ঠিকানা। এই শেষ ঠিকানাতেই তিনি শেষ বারের জন্য ফিরে এসেছিলেন, সন্ধেবেলায় পেশাদার মঞ্চে অভিনয় সেরে এসে, ‘এই অরণ্য’ নাটকে।
খেতে ভালবাসতেন অজিতেশ। তাঁর দীর্ঘদিনের মঞ্চ সহকর্মী, সঙ্গী ও বন্ধু রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত সাম্প্রতিক অতীতে সংবাদপত্রে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন – ‘‘আমাদের দলেরই এক জনের বিয়ের নেমন্তন্ন ছিল। সে বার জ্বর হয়েছিল বলে মাত্র এক থালা রসগোল্লা খেয়েছিল অজিত! কখনও কখনও বেশ অমিতাচারী ছিল ও। আবার কখনও প্রচণ্ড খুঁতখুঁতে একটা মানুষ! আমাকে এক বার বলেছিল, বাসের পিছন দিকে বসলে নাকি প্রেশার বাড়ে! তখন শ্যামপুকুরের মোড়ে একটা খাবারের দোকান ছিল। সেখানে চপ-কাটলেট-শিঙাড়া-কচুরি পাওয়া যেত। ওই দোকানে আমি বলে রেখেছিলাম, অজিতেশ এলে যা মনে করবে খাবে, আর তার দাম যেন ওরা আমার নামে খাতায় লিখে রাখে।’’ তরুণ বন্ধুটির প্রতি সেই অনাবিল মায়া এখনও জমিয়ে রেখেছেন প্রবীণ রুদ্রপ্রসাদ। এখনও ক্ষোভের রং ফুটে ওঠে তাঁর কণ্ঠে, যখন আজও তিনি ফিরে দেখেন অজিতেশের সেই চলে যাওয়ার কাহিনী, ‘‘একটা শো ছিল ওর (‘সেই অরণ্য’)। সেখান থেকে ফিরে এসে ১২টা রুটি খেয়েছিল। সঙ্গে মাংস। কেউ গরম করে দেওয়ার ছিল না বলে ঠান্ডাই খেয়েছিল। তার পর বুকে ব্যথা ওঠে মাঝ রাতে, তখন ওর মনে হয়েছিল বুঝি হজমের গোলমাল! এ দিকে হার্ট ফেল করছে, ওরা কেউই ধরতে পারল না। সারা রাত তাই পেটে একটা তামার পয়সা বুলিয়ে গেল। অথচ সময়ের মধ্যে একটা হাসপাতালে চলে গেলে চিকিৎসা করে হয়তো ওকে বাঁচানো যেত!’’ (যদিও রত্না বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর রুটি দিয়ে ঠান্ডা মাংস খাবার ঘটনাটি অস্বীকার করেছিলেন।) এখানেও দুর্ভাগ্যের হাত। যে বাংলা নাটককে সমৃদ্ধ করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন অজিতেশ, অসময়ে চলে গিয়ে সেই বাংলা নাটককেই রিক্ত করে গিয়েছিলেন দুর্ভাগা দর্শকের সামনে … এই নিরেট উপলব্ধির মাঝে এখনও বিষণ্ণ নন কি রুদ্রপ্রসাদ? তিনি জানিয়েছেন, ‘‘আসলে আমরা সকলেই কিলার। আমরা সকলেই সকলকে খুন করি। কিন্তু এটুকুই বলার, যে হি ওয়াজ আ জায়ান্ট অ্যামং আস!’’
ঝাঁকড়া চুলের এক রোগা ছেলে, মায়াভরা দুটো চোখ নিয়ে এ’শহরে এসে দারিদ্রকে হারিয়ে হয়ে উঠেছিলেন মঞ্চের সম্রাট। ব্যক্তিজীবনেও নিয়মকানুন চুরমার করে দিয়েছিলেন। এরকমই এক শারদ অবকাশে চলেও গিয়েছিলেন হঠাৎ।
বেশ কয়েক বছর আগে আগে ‘অজিতেশের শেষ ঠিকানা’ নামে একটা স্মৃতিকথা প্রকাশ পেয়েছিল – লিখেছিলেন তাঁর স্ত্রী রত্না বন্দ্যোপাধ্যায়। যার অনেকটাই প্রকৃত–প্রস্তাবে এক দিনলিপি। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় নামক এক ‘জীবন্ত–আগুনের–স্বরলিপি’র সঙ্গে দিনযাপনের দিনলিপি, যা রত্না লিখেছিলেন ডায়েরিতে, সেই সময়েই, একান্তই নিজস্ব স্মৃতিধারণের উপায় হিসাবে, সময় কাটাতেও কিছুটা। মাঝপথে সেই ডাইরি থেমে গিয়েছিল। পরে অবশ্য মাঝপথে থেমে যাওয়া ডায়েরিকে পরে লিখে আবার সম্পূর্ণ করেছিলেন রত্না বন্দ্যোপাধ্যায়। আর সেই বই জুড়ে আছে কত যে না–জানা কথা। তার ভেতর প্রেম–দাম্পত্য–অভাব–মৃত্যু – এসবেরও অতি–ব্যক্তিগত আখ্যান যেমন, তেমনই উঠে এসেছে অজিতেশের প্রথম জীবনে দারিদ্র–কণ্টকিত লড়াই নিজেকে প্রতিষ্ঠা দেবার জন্য। নিজের রাজনৈতিক মতাদর্শকে প্রতিষ্ঠা দেবার জন্য। আবার আছে তাঁর নানা নাটকের তৈরি হয়ে ওঠার রোমাঞ্চকর নেপথ্য–বৃত্তান্তও। যেসব নাটক ভেবেও করা হয়নি নানা–সময়ে, আছে তার হদিশও। মৃত্যু যে কতকিছু কেড়ে নিয়ে যায়!
নাটক করতে কলকাতা শহরে আসেননি অজিতেশ। তখন তাঁর নাম ‘অজিত’, শুধু ‘অজিত’, ‘অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়’। তিনি কলকাতা শহরে এসেছিলেন কলেজে পড়াশুনা করতে। শ্যামবাজারের মণীন্দ্রচন্দ্র কলেজে ইংরেজি অনার্স–এর ছাত্র ছিলেন অজিত। নিজের বাইরের জগতের বই পড়া দিয়ে ছাত্রাবস্থাতেই তিনি চমকে দিতে পারেছিলেন কলেজের ডাকসাইটে অধ্যাপকদের। প্রিয়ও হয়ে উঠতে পারেছিলেন শিক্ষক তথা সহপাঠীদের কাছে। কালো, বেশ রোগা, ঈষৎ গ্রাম্য চেহারা, মাথাভরা ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, পরনে ঈষৎ মলিন ধুতি–জামা, কিন্তু চোখ দুটোর দিকে কারোর নজর গেলেই তাঁকে স্তব্ধ হয়ে যেতে হবে – এত গভীরতা ছিল সেই দু চোখে, আর ছিল প্রাণচাঞ্চল্য। তখন তিনি প্রতিটা কথা বলতেন এক আশ্চর্য উত্তাপে। সে উত্তাপের জোগান কিন্তু শুধু নাটক থেকে আসত না। কলেজ জীবনেই অজিতেশের নাটকের সূত্রপাত হয়েছিল এটা ঠিকই, কিন্তু তাঁর ব্যক্তিত্বে, তাঁর চিন্তায় আগুন ঠেসে দিয়েছিল রাজনীতি। কলেজ তথা কলেজের বাইরে তখন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন অজিত। এতটাই সক্রিয় যে কলেজের স্টুডেন্টস ফেডারেশন ছেড়ে তিনি একসময় হয়ে উঠেছিলেন দমদমে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির লোকাল কমিটির সম্পাদক। শুধু গণনাট্য সংঘ নয়, করতেন শ্রমিক সংগঠনও। ইউনিট গড়তে পাড়ি দিতেন নতুন নতুন কারখানায়। আর থাকতেন – একেবারেই ‘শ্রেণিচ্যুত’ হবার মতো এক পরিবেশে। থাকতেন রাজাবাজারের ভেতরে এক বস্তিতে। যে খোলার চালের ঘরে অজিতের বাস ছিল, তার দেওয়ালের সবদিকেই ছিল স্পঞ্জের মতো ছ্যাঁদা, ছাদ দিয়ে জল পড়ত, চারপাশে ছিল ঝাঁঝালো দুর্গন্ধ, তাঁর বাসার পাশেই ছিল এক টিবি রোগীর বাস, এজমালি পায়খানা। ইলেক্ট্রিসিটির কথা ভাবাও সেখানে ছিল স্বপ্ন! আর খাওয়া? কোনওদিন অর্থাভাবে এমনও হয়েছিল, ‘‘পনেরো পয়সা দিয়ে রাজাবাজারের ফুটপাথ থেকে দুটো রুটি আর রুটির সঙ্গে ফ্রি হিসাবে মেলা গরুর নাড়িভুঁড়ির ছেঁচকি।’’ তারপর পেটের জ্বলুনি কমাতে পাঁচ পয়সা দিয়ে পাতিলেবু কিনে রাস্তার জলে ধুয়ে খাওয়া। এক সময় তাঁর কলেরা হয়েছিল। বস্তির লোকেরাই তাঁকে আইডি হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে এসেছিলেন। সেই সময়ে অজিতের সম্বল বলতে ছিল কয়েকটা টিউশনি; আর গল্প লিখে একটি পত্রিকা থেকে কিছু পয়সা পেতেন। গল্প বলতে – সেই পত্রিকার সঙ্গে তাঁর চুক্তি অনুযায়ী সংস্কৃত গল্পের অনুবাদ করতে হত। বোঝাই যাচ্ছে ইংরেজি অনার্সের ছাত্র অজিতেশ ভালরকম সংস্কৃতও জানতেন। রত্না বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা থেকে জানা যায়, সেই গল্পগুলোর একসঙ্গে করা ‘ফাইল’ তাঁর কাছে আছে, যা কখনও গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। পরেও অজিতেশ কিছু কিছু গল্প লিখেছিলেন। সেগুলো ছিল তাঁর মৌলিক গল্প।এছাড়া লিখেছিলেন একটি উপন্যাসও, নাম দিয়েছিলেন ‘ভালো লেগেছিল’। কলেজে পড়ার সময়ে তাঁর পাশ পেপার ছিল বাংলা আর ইকোনমিক্স। কলেজের ফাইনাল ইয়ারে ইকোনমিক্স পরীক্ষার দিন তাঁর হাতে একটাও পয়সা ছিল না যা দিয়ে তিনি খাবার কিনে খেতে পারেন। তাই, রাতে না ঘুমিয়ে, ভোর থেকে বেলা এগারোটা অবধি পড়ে, অর্থনীতির বইটা পুরনো বইয়ের দোকানে বেচে দিয়েছিলেন অজিত। তারপর সেই পয়সার খানিকটায় পাইস হোটেলে ভাত খেয়ে পরীক্ষা দিতে ঢুকে পরেছিলেন পরীক্ষার হলে। তবে এসবের মাঝেই – মাঝে মাঝে তাঁকে ‘পলাতক’ হতেও হত। কখনও বিপক্ষ দলের গুন্ডাদের হাত থেকে বাঁচতে। কখনও আবার পুলিশের হাতে পড়া থেকে বাঁচতে। এই সময়েই পার্টির একটা মিটিং–এ উত্তর কলকাতায় কমল বসুর বাড়িতে তাঁর আলাপ হয়েছিল জ্যোতি বসুর সঙ্গে। সেই আলাপের অনেক বছর পরে – যখন সক্রিয় রাজনীতি থেকে বহু দূরের বাসিন্দা হয়ে গিয়েছিলেন অজিতেশ, অভিনয়ই ছিল তাঁর একমাত্র কাজ, সিনেমা করছিলেন, পরিচিতি বেড়েছিল তাঁর – তখন আবার জ্যোতি বসুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল তাঁর। উপলক্ষ ছিল বোম্বে আর বাংলার অভিনেতাদের প্রদর্শনী এক ক্রিকেট ম্যাচ। উদ্বোধন করতে এসেছিলেন জ্যোতি বসু – সময়ের সরণী ধরে এগিয়ে তিনি তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। মাঠে উপস্থিত শিল্পীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার সময় জ্যোতিবাবু অজিতেশের হাতটা শক্ত করে ধরে বলেছিলেন, ‘‘আমরা তো পূর্ব–পরিচিত, তাই না?’’
অথচ অজিতেশের সাধের সেই পার্টির সাংস্কৃতিক সেলের সঙ্গেই একসময় তাঁর বিরোধ তৈরি হয়েছিল! ‘নান্দীকার’ তখনও কোনও নিবন্ধীকৃত গ্রুপ থিয়েটার ছিল না, বরং ছিল ‘ভারতীয় গণনাট্য সংঘ’–এর ‘নান্দীকার’ শাখা। নাটক বাছা হয়েছিল ইতালীয় নাট্যকার পিরানদেল্লোর ‘সিক্স ক্যারেক্টার্স ইন দ্য সার্চ অফ অ্যান অথর’। অজিতেশের বন্ধু রুদ্রপ্রসাদের অনুবাদে যা দাঁড়িয়েছিল ‘নাট্যকারের সন্ধানে ছ’টি চরিত্র’। প্রযোজনা প্রায় তৈরি। মঞ্চস্থ হবে। কিন্তু গণনাট্য নেতৃত্বের একাংশ আপত্তি তুলেছিলেন মূল নাট্যকার সূত্রে। তাঁদের যুক্তি ছিল – লিইউজি পিরানদেল্লো ছিলেন মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট পার্টির প্রকাশ্য সমর্থক, ফলে তাঁর লেখা নাটক কোনওভাবেই সমাজতান্ত্রিক শিবির সংলগ্ন কোনও দল করতে পারে না, করা উচিত নয়। পাল্টা যুক্তি দিয়েছিলেন অজিতেশ ও ‘নান্দীকার’, যে এ নাটকে বঞ্চিত মানুষদের ভাঙাচোরা জীবনেরই কথা। তবুও নেতৃত্ব অনড় ছিলেন নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে। অপর দিকে নিজের অবস্থানে অনড় ছিলেন অজিতেশও। ফলে নাটক রইল। ‘নান্দীকারও থাকল। শুধু গণনাট্যের শাখা হিসাবে আর থাকল না। আর এই এক নাটক সূত্রেই বোঝা গিয়েছিল – এসে গেছেন বাংলা মঞ্চে উত্তর–উৎপল–শম্ভু যুগের আধুনিকতার নতুন ভগীরথ, যিনি একের পর এক বিদেশি নাটকের (চেকভ–পিন্টার–ইউনেস্কো–ব্রেখট মায় তলস্তয়) স্থানীকরণে ভরিয়ে দেবেন বাংলা নাটকের মঞ্চ। ইংরেজি অনার্সের ছাত্রটি অধ্যাপনায় নয় মঞ্চের মাধ্যমে ইয়োরোপীয় আধুনিক নাটকের দীক্ষা দিতে চেয়েছিলেন বাঙালিকে। কিন্তু সেখানেও তৈরি হয়েছিল বিতর্ক। ১৯৬৪ সালের ৫ই নভেম্বর কলকাতায় তৈরি হয়েছিল ‘ব্রেখট সোসাইটি অব ইন্ডিয়া’। এর প্রথম সভাপতি ছিলেন সত্যজিৎ রায়। আর এর মুখপত্র ‘এপিক থিয়েটার’–এর তৃতীয় সংখ্যায় এই সোসাইটির সভ্যবৃন্দের বয়ানে একটি বার্তা বেরিয়েছিল, যাতে লেখা ছিল, ‘‘... ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ পৃথিবীর বুকে দুষ্টব্রণ। সমাজতন্ত্রেই সামাজিক সমস্ত শক্তির পূর্ণ বিকাশ। সংগ্রামী মানুষে বিশ্বাসী সমস্ত বিদেশি নাট্যকার আমাদের নাট্য আন্দোলনের দোস্ত। পিরানদেল্লো, ইয়োনেস্কো, বেকেট, পিন্টার অসবর্ণ এই বিচারে আমাদের নাট্য আন্দোলনের দুশমন।’’ অর্থাৎ এই বিচারে কলমের এক খোঁচায় অজিতেশ চলে গিয়েছিলেন শত্রুশিবিরে! অনেকেরই ধারণা এই তীব্র বয়ানটি তৈরি করেছিলেন এই সোসাইটির প্রাণপুরুষ উৎপল দত্ত। এর কয়েক বছর পরে অজিতেশও ব্রেখটের একটা নাটক করেছিলেন। বাংলায় নাম দিয়েছিলেন ‘তিন পয়সার পালা’। কিন্তু সেই নাটক উৎপল দত্তের ভাল লাগেনি, তাঁর ‘অব্রেখটীয়’ লেগেছিল সে প্রযোজনা। এরপর অজিতেশ তৈরি করেছিলেন ‘ভালোমানুষ’। এবং পুনরায় অজিতেশ সমালোচনাবিদ্ধ হয়েছিলেন ওই শিবির থেকে। অবশ্য এসবের পাল্টা উদাহরণও আছে, উৎপল–নাট্যের সমালোচনা অজিতেশই আগে করেছিলেন। সে নাটক ছিল ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। এর বাইরেও কথা আছে। পার্টি নির্বাচনের সময় অজিতেশকে বলেছিল পথনাটক করতে। পার্টির এরূপ নির্দেশে তিনি পাল্টা জবাব দিয়েছিলেন, ‘‘পেটে বালিশ বেঁধে অতুল্য ঘোষ সাজা তাঁর কাজ নয়।’’ এমন মন্তব্য নিঃসন্দেহে উৎপল দত্তের মতো পথনাটক করা ‘প্রোপাগান্ডিস্ট’দের ক্ষুব্ধ করেছিল। কিন্তু সামনাসামনি কেমন ছিল উৎপল-অজিতেশ সম্পর্ক? রত্না বন্দ্যোপাধ্যায় লিখিত বইতে তার একটা মজাদার মুহূর্ত পাওয়া যায়। এই সব সমালোচনা, পার্টির সাথে বাদ-বিবাদের পরে একবার দু’জনের দেখা হয়েছিল রবীন্দ্রসদনে এক অনুষ্ঠানে। অজিতেশের সঙ্গে ছিলেন রত্না। রত্নাকে অজিতেশ বলেছিলেন উৎপল দত্তকে প্রণাম করতে। রত্না তাঁকে বলেছিলেন, ‘উনি তো প্রণাম নিতে পছন্দ করেন না।’ তবু অজিতেশের কথায় রত্না উৎপল দত্ত’কে প্রণাম করেছিলেন। ব্যাপারটায় উৎপল দত্ত অস্বস্তি বোধ করলেও বাধা দেননি। ছোট্ট একটা ঘটনায় অজিতেশ কিন্তু বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনি উৎপলবাবুকে কতটা শ্রদ্ধা করেন।
অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে অদ্ভুত অনেক অভিজ্ঞতার কথা জানা যায় তাঁরই সতীর্থ শ্রী রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের স্মৃতিচারণ থেকে। রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন জায়গায় স্বীকার করে নিয়েছেন, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর জীবনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সাম্প্রতিক অতীতে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন – “লোকে বলে, আমাদের নাকি খুব ঝগড়া! তাঁরা জানে না, আমাদের বন্ধুত্বের শিকড় কতটা গভীরে পৌঁছেছিল …” ১৯৫৪-৫৫ সাল। তখন জীবনের খোঁজ করতে কলকাতা ছাড়ার কথা ভাবছিলেন তরুণ রুদ্রপ্রসাদ। আর অজিতেশ আসানসোলে, কলকাতায় আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। দু’জনেই জীবনের ঘটনাক্রমে এসে পৌঁছেছিলেন শ্যামবাজারের মণীন্দ্র কলেজে। তখন কলেজের কমন রুমে তাঁদের দু’জনের ভাললাগার বিষয়গুলোও কমন ছিল – ফুটবল, রাজনীতি এবং থিয়েটার। রুদ্রপ্রসাদ জানিয়েছিলেন, “তখন ও অজিতেশ ছিল না। অজিত ছিল। মণীন্দ্র কলেজের ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দিয়েছিল। ওর সঙ্গে ছিল পরবর্তী সময়ে ‘নান্দীকার’-এর সেক্রেটারি অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়। খুবই ইম্পর্ট্যান্ট লোক। কিন্তু ওদের দলটা মাইনরিটিতে থাকায়, ওরা কখনও জিততে পারত না। আর আমার তখন একটাই কাজ ছিল। কলেজের টিটি রুমে টেবিল টেনিস খেলা! ভালই খেলতাম। আমার তো খেলোয়াড় হওয়ারই কথা ছিল … দূর থেকে ওদের দু’জনের সঙ্গে আমার একটা বন্ধুত্ব ছিল।” তখনও বন্ধুত্বের শিকড় গাঢ়ত্ব বোঝেনি। কিন্তু মাটির আশ্রয়টাকে ঠিক চিনে নিয়েছিল। “এক বার ওদেরকে বিরোধী দলের কারা যেন ভোটে দাঁড়াতে দিচ্ছিল না। কাঁদো কাঁদো হয়ে আমার কাছে এসে বলেছিল সে গল্প। তখন শ্যামপুকুরের পাড়াটা আমার পাড়া। আমি তখন সে পাড়ার মস্তান! ডাকনাম খোকন। সঙ্গের ছাতাটাকেই লাঠি হিসেবে বাগিয়ে কলেজে গিয়েছিলাম, কারা ওদের দাঁড়াতে দিচ্ছে না, তার খবর নিতে। তার পর থেকে ছাত্র ফেডারেশনের লোকেরা আমাকে গুন্ডা মনে করত। আর অজিত বলত, ‘খোকন আসলে গুন্ডা নয়, আমি ওকে গুন্ডা বানাচ্ছি’ …।” দুই বন্ধুর পরিচয়ের সেই শুরু হয়েছিল। কলকাতার পাতিপুকুরে তখন অজিতেশের বাস ছিল। গণনাট্য সঙ্ঘের পাতিপুকুর শাখায় তখন অজিতেশ রীতিমতো চেনাশোনা নাম ছিলেন। রুদ্রপ্রসাদকে পেলেই বলতেন, ‘থিয়েটার করো।’ রুদ্রপ্রসাদ নিজের স্মৃতিচারণে জানিয়েছিলেন – “আমাকে বলত, আমার চেহারাটা নাকি কৃষ্ণের মতো। আমি কী সুন্দর গান গাই! শ্যামপুকুর মাঠের এ প্রান্তে ও দাঁড়িয়ে আমাকে বলত, ও প্রান্ত থেকে চড়ায় গান ধরতে, আমার গলাটা কত দূর যায় ও দেখবে বলে! আসলে ওর চেহারাটা যেমন বিরাট ছিল, নিজের ভাল লাগাটাকেও তেমন বিরাট করে ফেলতে পারত।” এ দিকে অজিতেশের ছিল আট জন ভাইবোন, সংসারের দায়দায়িত্বও ছিল তাঁর ঘাড়ে। কিন্তু অজিত বাঁচতে চেয়েছিলেন মূলতঃ থিয়েটারকে আঁকড়ে। বেঁধে থাকবেন বলে রুদ্রপ্রসাদও ঘর ছেড়ে অজিতেশের সঙ্গেই দিবারাত্রির কাব্যে মন দিয়েছিলেন। তাঁর ভাষ্যে – “স্টার থিয়েটারের পিছনে স্টার লেনের উপরে একটা বাড়ি নিয়েছিলাম একসঙ্গে থাকব বলে। ভাড়া শেয়ার করে। ঘরটায় একটা চৌকি পাতলে আর কিছুর জায়গা থাকত না … অজিত আসলে খুব বড় করে টানত আমায়। ও ছিল সেই বন্ধু, যার জন্য নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে দিয়ে একসঙ্গে থাকা যায়। তার পর আইএ পরীক্ষায় মণীন্দ্র কলেজ থেকে দু’জন ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করল … এক জন আমি, আর এক জন অরুণ সেন। অজিত চেয়েছিল, আমি মণীন্দ্র কলেজেই থার্ড ইয়ারে ভর্তি হই। কিন্তু আমার তখন ইচ্ছে, সিরিয়াসলি পড়াশোনাটা করার। তাই স্কটিশে ভর্তি হলাম। তখন আমি একটু সরেই গিয়েছিলাম ওর জীবন থেকে।” এই সরে যাওয়া মানে অবশ্য যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন দুই দ্বীপের গল্প নয়, দুজনের দুই আলাদা কক্ষপথে বিচরণ করা। অথচ দিশারী সূর্যটি দু’জনের জীবনেই এক লক্ষ্য ছিল – থিয়েটার। রুদ্রপ্রসাদ বলেছেন, “ইউনিভার্সিটিতে যখন পড়ি, তখন ‘সিক্স ক্যারেক্টার্স ইন সার্চ অফ অ্যান অথর’কে অ্যাডাপ্ট করেছিলাম আমি এবং আমার এক বন্ধু। কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে সেটা করা গেল না। কে করবে ওই মেয়ের পার্ট, ও রকম বাবার পার্টই বা কে করবে, এ সব প্রশ্ন উঠতে লাগল।” তখন ‘নান্দীকার’ সদ্য শুরু করেছিলেন অজিতেশ। এক দিন গিয়েছিলেন রুদ্রপ্রসাদের বাড়ি, এ কথা সে কথার পর রুদ্র বন্ধুকে পড়তে দিয়েছিলেন তাঁর বঙ্গীয়কৃত নাটক ‘নাট্যকারের সন্ধানে ছ’টি চরিত্র’, তারপরে রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের ভাষ্যে – “একটু উল্টেপাল্টে দেখে বলল, ‘আমি চললাম।’ তখন অনেক রাত হয়েছে। ওকে বললুম, ‘বাস পাবে না!’ শুনল না। বাড়ি চলে গেল এবং সারা রাত ধরে ওই অ্যা়ডাপ্টেশন পড়ে এক দিন আমাকে এসে বলল, নাটকটা করবে।” নাট্যকারের মতো একটা মঞ্চও পেয়ে গিয়েছিল এ গল্পের চরিত্ররা। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিল ‘নান্দীকার’। এক বছরে হয়েছিল ১৩১টা শো! অথচ সেই নাটক দেখেই নাট্যকার জলধর চট্টোপাধ্যায় উঠতি নক্ষত্রদের বলেছিলেন, ‘‘বাড়িতে মা-বোন নেই তোমাদের?’’ আবার সেই নাটক দেখেই তরুণদের ডেকে পাঠিয়েছিলেন বাংলা নাটকের মসিহা শম্ভু মিত্র। রুদ্রপ্রসাদ জানিয়েছিলেন – ‘‘শম্ভুদা ‘মঞ্জরী আমের মঞ্জরী’ দেখে অজিতকে একটা বই দিয়েছিলেন। তার উপর লেখা ‘আগামী যুগের শ্রেষ্ঠ নট অজিতকে …’ শম্ভুদা কিন্তু এ রকম কথা চট করে বলার লোক নন,’’ বন্ধুর মঞ্চ-ব্যক্তিত্বে আজও অভিভূত থাকেন রুদ্রপ্রসাদ, জানিয়েছিলেন – ‘‘ওর সঙ্গে অভিনয় করতে করতে মাঝে মাঝে আমি ভুলে যেতাম যে, আমিও অভিনেতা। তখন হয়তো হাঁ করে ওর অভিনয় দেখছি! দর্শক হয়ে গিয়েছি আর ভাবছি, করছে কী এই বিরাট চেহারার লোকটা!’’ বরাবরই আটপৌরে চরিত্রদের মঞ্চরূপ দিতেন অজিতেশ। এবং শোনা যায়, সেই চরিত্রদের মধ্যে এমন করে নিমজ্জিত হয়ে পড়তেন যে, কে চরিত্র এবং কে অজিতেশ আলাদা করা মুশকিল হয়ে পড়ত। আঞ্চলিক ভাষার অভিনয়ে তাঁর ধারেকাছে কেউ ছিল না ওই সময়ের প্রেক্ষিতে। রুদ্রপ্রসাদ আরও জানিয়েছেন – ‘‘ওই ‘মঞ্জরী আমের মঞ্জরী’তেই একটা পর্যায়ের পর অজিত কেমন হাউইয়ের মতো উড়ে চলে যেত … তখন ও আর লালমোহন নয়, নাটকটা আর ‘চেরি অর্চার্ড’ নয়, তখন আর মঞ্চটাও মুক্তাঙ্গন নয়। তখন একটা মানুষ নিজ মর্ত্যসীমা ছাড়িয়ে উড়ছে …।’’ ‘নান্দীকার’ শুরুর আগে গণনাট্য সঙ্ঘে একটা ধাক্কা খেয়েছিলেন অজিতেশ। রাজনৈতিক মতাদর্শের ধাক্কা। তাতে মন ভাঙলেও থিয়েটারের বোধ এতটুকু টাল খায়নি। রুদ্রপ্রসাদ সেই অস্থির সময় প্রসঙ্গে বলেছিলেন – ‘‘১৯৫৮ সাল নাগাদ গণনাট্য সঙ্ঘে অজিতেশ ‘চার অধ্যায়’ করতে চেয়েছিল। আর ওখানে তখন সেই পুরনো কমিউনিস্ট ট্যাবু বিরাজ করছে, যে রবীন্দ্রনাথ রিঅ্যাকশনারি। আর ‘চার অধ্যায়’তে টেররিজম সংক্রান্ত যে সব কথা রয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ওখানে বলছেন, মরাল শক্তি না থাকলে শুধু বন্দুকের শক্তি দিয়ে হয় না … এই সব নিয়ে অজিতের সঙ্গে ওঁদের খুব গন্ডগোল চলছিল। নতুনরা ওকে পছন্দ করছিল, আর যাঁরা কনজারভেটিভ তাঁরা কিছুতেই ওকে ‘চার অধ্যায়’ করতে দিচ্ছিল না …।’’ বহির্দ্বন্দ্বের সঙ্গে বন্ধুর অন্তর্দ্বন্দ্বও তখন উপলব্ধি করেছিলেন রুদ্রপ্রসাদ, ‘‘খুবই টালমাটাল চলছিল ওই সময়টায়। ও ঠিক ভাবে গৃহীত হচ্ছিল না সেখানে।’’ পরবর্তী কালে দু’জনের রাজনৈতিক চিন্তার ব্যবচ্ছেদ করা হয়নি কি কখনও? তাঁর বক্তব্যে – ‘‘আমাদের দলে একটা ঠাট্টা চলত দু’জনের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। লোকে আমাকে বলত, আমি একটু সিপিআই-ঘেঁষা আর ও একটু সিপিএম-ঘেঁষা! কিন্তু আমরা দু’জনেই মনে করতাম, পার্টি ইজ নট আওয়ার কনসার্ন। আমাদের পুরো সময়টাই থিয়েটারের জন্য, থিয়েটারের স্বার্থে। আর কোথাও একটা এই বোধটাও কাজ করত যে, আমরা যদি কট্টর পার্টিপন্থী হয়ে যাই, তা হলে আমাদের থিয়েটারও প্রোপাগান্ডা থিয়েটার হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা তো এমন থিয়েটার করতে চেয়েছিলাম যেখানে সকলের স্থান আছে।’’ রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের এই মন্তব্যে যুগপৎ সিদ্ধান্তের গল্পে ফুটে ওঠে একটা সময়ের মানচিত্র। ‘নান্দীকার’ যখন সেই সময়ের রঙ্গমঞ্চে সোনার খনি হয়ে উঠেছিল। কিন্তু বিপর্যয় তো খনিজ আহরণে অহরহ ঘটনা। ১৯৬৬ সালে বিভাস চক্রবর্তী, অশোক মুখোপাধ্যায়রা চলে গিয়েছিলেন ‘নান্দীকার’ ছেড়ে, বিভিন্ন সাংগঠনিক কারণে। রুদ্রপ্রসাদ জানিয়েছেন – ‘‘আমি আর অজিতেশ তখন এক দিকে, বাকিরা অন্য দিকে। ওরাই কিন্তু মেজরিটিতে ছিল। ইচ্ছে করলে দলটা দখল করে ফেলতে পারত। কিন্তু বিভাস তো খুব ভদ্রলোক … অজিতেশের তৈরি করা দলটাকে ও নষ্ট করতে চায়নি। ওরা নিজেরা সরে গেল, ইনস্পাইট অব দেয়ার মেজরিটি। ওই সময়টা সকলে থরথর করে ভিতরে কাঁপতাম। তখন অনেকে বলত বটে মরাল গ্রাউন্ডের কথা। কিন্তু মরালিটির তো দুটো দিক রয়েছে, একটা প্রথাগত আর একটা সত্যনির্ভর। যত দূর সম্ভব সত্যটাকেই স্বীকার করে নেওয়া ভাল। কিন্তু তার পর অজিতেশ নিজে যখন চলে গেল, তখন আবার আর একটা টালমাটাল … তবে ‘নান্দীকার’ চলছিল।’’ তবে অজিতেশের দল ছাড়ার আগেও ঘটে গিয়েছিল একরাশ স্তূপীকৃত ঘটনা! গণনাট্য সঙ্ঘে পারেননি, কিন্তু পরে ‘নান্দীকার’-এর সঙ্গে ‘চার অধ্যায়’ করেছিলেন অজিতেশ। তখন কেয়া চক্রবর্তী তাঁর হৃদয়খোঁড়া অভিনয় দিয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন বাঙালি দর্শকের মনে, এবং অন্যত্রও। অজিতেশের ‘চার অধ্যায়’-এ তিনি ছিলেন এলা। আর অজিতেশ হয়েছিলেন অতীন্দ্র। রুদ্রপ্রসাদ জানিয়েছেন – ‘‘কেয়া থিয়েটারের গুরু মানত অজিতকে। আর আমি ছিলাম ওর প্রেমিক, ওর স্বামী।’’ কত ধুলোবালি জমেছে আপাত নিরুচ্চার সেই প্রেমজ বয়ানের উপর! অথচ অজিতেশ, কেয়া, রুদ্রপ্রসাদ তখন থিয়েটারি জগতের ‘ডায়নামিক ট্রায়ো’ হয়ে গিয়েছিলেন। রুদ্রপ্রসাদ জানিয়েছেন – ‘‘একটা খুব ভাল কম্বিনেশন তৈরি হয়েছিল তখন। কেয়া, অসিত, অজিতেশ, আমি. .. আসলে থিয়েটারে সাংগঠনিক দক্ষতা আর শৈল্পিক প্রতিভা দুটোরই প্রয়োজন। কোনওটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু গোলমালটা হয়, যখন শিল্পী মনে করেন তিনিই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। সে রকম একটা টেনশন আমাদের মধ্যেও শুরু হয়েছিল।’’ সম্ভবতঃ ১৯৭৭ সাল। তখন ‘নান্দীকার’-এ সবে সরকারি অনুদান আসা শুরু হয়েছিল। কিন্তু সরকারের ‘ছেলেমানুষি’ নির্দেশে, দল থেকে এক বছরে তিনটে প্রযোজনা নামানোর নিয়মও জারি হয়েছিল। এ দিকে ভাল নাটক করার ইস্তেহারও সকলের মনে মনে গেঁথে ছিল। দলের সিদ্ধান্তে রুদ্রপ্রসাদের সে বারের নির্দেশনা ‘ফুটবল’ মঞ্চস্থ হয়েছিল। এটি ছিল সফলতম নাটকগুলোর মধ্যে একটি। রুদ্রপ্রসাদের ভাষ্যে – ‘‘তখন দলের মধ্যে একটা চাপা গুঞ্জন চলত, ‘ফুটবল’ করে রুদ্রর বেশ নাম হয়েছে, এ বার রুদ্র বোধহয় দলটা দখল করে নেবে! অজিতও একটা দোলাচলে থাকত বলে লক্ষ্য করেছিলাম আমি আর কেয়া। তার পর কেয়ার কথাতেই এক বার মাঝ রাতে আমরা দু’জন অজিতেশের বাড়িতে কড়া নেড়েছিলাম। ওকে বলতে যে, সব ঠিক আছে। আমরা ওর সঙ্গেই আছি। কারণ আমাদের সম্পর্কটায় ওই ভালবাসাটা ছিল।’’ কিন্তু ঘটনাচক্রে ’৭৭ সালেই দল ছেড়েছিলেন অজিতেশ। নিজের দল ‘নান্দীমুখ’ গড়ে নিয়েছিলেন ভাঙনের টুকরোগুলো জড়ো করে। অজিতেশের শিল্পীসত্তার বিস্তার ছিল বটবৃক্ষের মতো। ফলে কোনও একটা শিল্পমাধ্যমে তিনি নিজের প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটাবেন, এমনটা কিছুতেই সম্ভব হত না। ষাটের দশক নাগাদই সিনেমায় কাজ করা শুরু করে দিয়েছিলেন অজিতেশ। প্রায় পঞ্চাশটা ছবিতে কাজ করে ফেলেছিলেন তিনি, যার মধ্যে হিন্দি ছবির সংখ্যাও নেহাত কম ছিলনা। ‘কুহেলী’র সত্যভূষণ বা ‘হাটে বাজারে’র লছমনলালকে কে ভুলতে পারে? তরুণ মজুমদার যখন তারাশঙ্করের উপন্যাস থেকে পর্দার জন্য ‘গণদেবতা’ করেছিলেন, অজিতেশ তো সেখানেও ছিলেন! আবার থিয়েটারের চ্যালেঞ্জ এবং সিনেমার গ্ল্যামারের মাঝে মুখ লুকনো যাত্রাতেও অবাধ বিচরণ করেছিলেন তিনি। কিন্তু বন্ধুর ছবি করা বা যাত্রা করা নিয়ে রুদ্রপ্রসাদ কী ভাবতেন? রুদ্রপ্রসাদ জানিয়েছেন – ‘‘অজিতেশ তখন সদ্য দ্বিতীয় সংসার শুরু করেছে, নানা কারণে ওর টাকার দরকার। ফলে সিনেমা করছে, যাত্রা করছে, থিয়েটারটাও করছে। অস্থির হয়ে আছে ও। আমার সঙ্গে নাটকের পেশাদারিত্ব নিয়ে তর্কও বাধছে, প্রকাশ্যে কিংবা ব্যক্তিগত বৃত্তে। অথচ আমার তুলনায় থিয়েটারি মাপে তো অনেক বড় অজিত!’’ এ দিকে বার্নার্দো বার্তোলুচ্চির ‘লিটল বুদ্ধ’য় অভিনয় করেছিলেন রুদ্রপ্রসাদ, রোলাঁ জফের ‘সিটি অব জয়’ কিংবা ‘গল্প হলেও সত্যি’তে অভিনয় করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে রুদ্রপ্রসাদ জানিয়েছেন – ‘‘টুকটাক ছবি করেছি ঠিকই। লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগারও করেছি। কিন্তু নিজেকে ওই জায়গায় সেটল করতে পারিনি কখনও। অজিতেশ যে ভাবে পেরেছিল। এক বার একটা সভায় অজিতেশ আমার সম্পর্কে বলল, ‘খোকন যদি শুধু থিয়েটারে পুরোপুরি প্রফেশনাল হত, তা হলে ‘নান্দীকার’-এর অনেক উপকার হত।’ আমি পাল্টা ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এমনটা কোন দিন হয়েছে যে ‘নান্দীকার’-এর কোনও দরকারে আমি ‘না’ বলেছি? কলেজ থেকে দরকার হলে তিন মাস, ছ’মাস, ন’মাস ছুটি নিয়েছি। আবার ছাত্রদের যাতে ক্ষতি না হয়, তার জন্য গরমের ছুটিতে তাঁদের স্পেশ্যাল ক্লাসও করিয়েছি! এবং সে কারণে আমি ছাত্রদের মধ্যে বেশ পপুলার ছিলাম। অজিতেশকে এটাও বলেছিলাম যে, ওর দশটা ‘বাবু’ … ওর ওই প্রোডিউসাররা! আমার একটাই, গভর্নমেন্ট। যাকে চোখেও দেখাও যায় না!’’ এর কোনওটাই ঝগড়া নয়। আলোচনার মতো করেই একসময় এগোত দু’জনের তর্কবিতর্ক। রুদ্রপ্রসাদ আক্ষেপ করেন – ‘‘এত কাজ করল, অথচ হৃদ্রোগে ভুগে মোটে ৫০ বছর বয়সে চলে গেল। আর দেখুন, আমি কিন্তু সেই থিয়েটারটাই করে চলেছি …।’’
রত্না কিন্তু ছিলেন অজিতেশের এক সহপাঠী তথা ‘নান্দীকার’ সঙ্গীর স্ত্রী। দলের ভাঙনের সময়েও সেই নাট্যকার–অভিনেতা বন্ধু অজিতের দিকেই ছিলেন। পরে তাঁদের দুই বন্ধুর সংসারেই ভাঙন ধরেছিল যখন ১৯৭২ সালের ২২শে মার্চ রাতের বেলায় অজিতেশ আর রত্না নিজেদের সংসার ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন পথে। শুধুমাত্র ভালবাসার টানে। শুরু করেছিলেন একসঙ্গে থাকা – সেই বেলেঘাটার বাড়িতে। যেখানে অজিতেশ একবার রত্নাকে বলেছিলেন, ‘‘প্লিজ, জানলা দরজায় পেলমেট লাগিয়ে লম্বা লম্বা পর্দা ঝুলিয়ে আকাশটাকে ঢেকে দিও না। ... যেন ঘরের মাঝখানটাতে দাঁড়িয়েও দেখতে পাই বাইরের পৃথিবীটাকে।’’ আর সেই পর্দাহীন ঘরটা থেকেই ১৪ই অক্টোবর ১৯৮৩ সালে অজিতেশের প্রাণহীন দেহ বেরিয়ে গিয়েছিল শেষ যাত্রায়। একদিন যে অজিতেশ অন্যভাবে বাঁচতে চেয়ে কোলিয়ারি ছেড়ে এসেছিলেন কলকাতা শহরে। রত্নার তখন মনে পড়েছিল একসময় দীর্ঘদিন পয়সার অভাবে সেই বাড়িতে তাঁরা কোনও চেয়ার কিনতে পারেননি। কোনও অতিথি এলে তাঁদের চেয়ার ধার করে আনতে হত প্রতিবেশীদের ঘর থেকে। রত্না বিচ্ছেদ পেয়েছিলেন স্বামীর কাছ থেকে। অজিতেশ পাননি। অজিতেশের মা আর বোনেদের বিচারপতিকে উদ্দেশ্য করে লেখা চিঠি তাঁর বিপক্ষে গিয়েছিল। আর সেদিন দুপুরে রত্না দেখেছিলেন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তাঁকে কাঁদতে। অবিকল যেভাবে মঞ্চে তখন কাঁদতেন ‘পাপপুণ্য’ করতে গিয়ে। বিবাহবিচ্ছেদের মামলা উচ্চতর আদালতে গিয়েছিল। আর এর কিছুদিনের মধ্যেই তো চলে গিয়েছিলেন অজিতেশ।
অজিতেশ ভেবেছিলেন পেশাদার মঞ্চেই আবার ফিরিয়ে আনবেন একটি বড় মাপের নাটক তৃপ্তি মিত্রকে সঙ্গে নিয়ে। সেটা আর হয়নি। ভেবেছিলেন দ্রোণাচার্য আর শকুন্তলার গল্পের আধুনিক ব্যাখ্যায় নাটক লিখবেন। সেটাও আর হয়নি। হঠাৎই সব ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন সেই মানুষটি, যিনি একই সঙ্গে ছিলেন সম্রাট ও সন্ন্যাসী।
মূলতঃ কংগ্রেস মনোভাবাপন্ন পরিবারের সদস্য হয়েও তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েছিলেন। সেখান থেকেই তাঁর নাটকের সঙ্গে রাজনৈতিক চেতনার সম্মিলন ঘটেছিল। যদিও তিনি কোনও দিনই সে ভাবে মিটিং, মিছিলে অংশ নিয়ে পার্টির আদর্শ প্রচার করেননি তবে মনে প্রাণে তিনি ছিলেন আদ্যন্ত এক ‘কমিউনিস্ট’। এই নাটকের মধ্যে ডুবে থাকা অনেকের মতে তাঁর নিবিষ্ট সাংস্কৃতি চেতনারই প্রতিফলন। তবে খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায়, অজিতেশ রাজনীতি আর সংস্কৃতিকে কোনও দিনই একাসনে বসাতে পারেননি। বা ইচ্ছা করেই এ দুয়ের মধ্যে সচেতন একটি দূরত্ব রেখে চলতে চেয়েছিলেন। তিনি থিয়েটারে রাজনৈতিক উপাদান প্রয়োগ করেছিলেন খুবই সচেতন ভাবে। উচ্চকিত রাজনৈতিক স্লোগান দিয়ে তাই অজিতেশের নাটকের পরিসমাপ্তি কোনদিনই ঘটেনি। বরং তাঁর নাটক এক স্থিরতর রাজনৈতিক এবং মানবিক মূল্যবোধের সামনে দর্শককে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। এই কারণেই গণনাট্য সম্পর্কে অজিতেশে অনুৎসাহিত হয়েছিলেন। গণনাট্যের প্রতিটি ধ্যান ধারণাকে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা তাঁর মতো সৃষ্টিশীল মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল না। আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা থাকা সত্ত্বেও সব বিষয়ে সহমত হতে না পারার জেরে অনেকে তাঁকে ‘দক্ষিণপন্থী’ ধ্যান ধারণার মানুষ বলে ভাবতে শুরু করেছিলেন। এর জেরে এমন এক অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল যে অজিতেশকে বাধ্য হয়ে চলে যেতে হয়েছিল। ‘বহুরূপী’ পত্রিকায় ‘ব্রেখটের সঙ্গে পরিচয়ের আদিপর্ব’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, ‘‘আমি লক্ষ করেছি যাঁরা পার্টির সদস্যপদ নেন তাঁরা পার্টির সুবিধাগুলো ভোগ করেন, কষ্টগুলো নয়।’’ এর থেকে বোঝা যায় কিছুটা আক্ষেপ তাঁর মধ্যে কাজ করেছিল। অজিতেশ মনে করতেন পার্টিকে ভালবাসলে তার সমালোচনা করতে হবে। প্রয়োজনে নির্ভীক হয়ে সমালোচনা করতে হবে। কিন্তু সমালোচনা করলেই একাংশের কাছে সুবিধাবাদী, বুর্জোয়া ইত্যাদি অভিধা পেতে হয়। পার্টির শৃঙ্খল ছেড়ে অজিতেশ স্বতন্ত্র ভাবে নাট্যচর্চা করলেও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পার্টিকে অন্তর থেকে ভালবেসেছিলেন। শম্ভু মিত্রের মতোই অজিতেশেরও বিশ্বাস ছিল বিশ্বের সব জ্ঞান ও শিক্ষণীয় বিষয়ের মেলবন্ধনেই সৃষ্টি হয় থিয়েটার নামক মহৎ শিল্প। তাই তিনি এক দিকে, যেমন বিভিন্ন বিদেশি নাটকের অনুবাদ করেছিলেন অন্য দিকে, ঠিক তেমনই সেই অনুবাদের মধ্যে নিয়ে এসেছিলেন বাংলার মাটির গন্ধ। তাই চেকভের ‘দ্য সওয়ান সং’ অবলম্বনে ‘নানা রঙের দিন’ নাটককে তিনি উপস্থাপিত করেছিলেন ভারতীয় প্রেক্ষিতে। চেকভের তৈরি ‘চেরি অর্চার্ড’ অবলম্বনে অজিতেশ যখন লিখেছিলেন ‘মঞ্জরী আমের মঞ্জরী’ তখন সেখানে যে মধ্যবিত্ত সমাজের কথা শোনা যায়, তাঁরা কেউই রাশিয়ান নন, বরং ভারতীয় জীবন থেকে তুলে আনা জীবন্ত চরিত্র। এই নাটকে ঝাড়খণ্ডী উপভাষাকে ব্যবহার করে বাঙালি সামন্ততান্ত্রিক জীবনব্যবস্থাকে তুলে ধরতে চাওয়া হয়েছিল। ১৯৭০-এ ব্রেখট-এর ‘থ্রি পেনি অপেরা’ অবলম্বনে তিনি যখন ‘তিন পয়সার পালা’ রচনা করেছিলেন তখন বিদেশি কাহিনীতে উঠে এসেছিল আমাদের সমাজের অতীতের বাবু কালচার। ‘সওদাগরের নৌকা’-তে প্রসন্নরূপী অজিতেশ তিন দেওয়ালের একটা ঘর তৈরি করতে চেয়েছিলেন। এ ভাবেই কাজ এগিয়ে চলছিল। কিন্তু অনেক কাজ বাকি থাকা সত্ত্বেও মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে তাঁকে চলে যেতে হয়। বাংলা নাটক, যাত্রা ও সিনেমায় তিনি যে অবদান রেখে গিয়েছেন তার সম্পূর্ণ মূল্যায়ন করতে এখনও বহু দূর যেতে হবে আমাদের।
(তথ্যসূত্র:
১- অজিতেশের শেষ ঠিকানা, রত্না বন্দ্যোপাধ্যায়, থীমা (২০১৯)।
২- ১৯শে মে ২০১৮ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় শ্রী অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় স্মরণে নাট্যব্যক্তিত্ব শ্রী রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের সাক্ষাৎকার।
৩- যাত্রাপথে অজিতেশ, প্রভাতকুমার দাস, ঋত প্রকাশন।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত