১৩ই অক্টোবর, ১৯৮৭ সাল। দিল্লী দূরদর্শনে রিনি সাইমনের (পরবর্তীকালে খান্না) রাত নটার খবরে ঘোষণা – “The noted singer Kishore kumar is no more” … ওদিকে বাংলা দূরদর্শন তাঁর মৃত্যুকে একপ্রকার অবহেলা করে সেদিন কোন ঘোষণাই করেনি। যদিও পরের দিন সমস্ত বাংলা সংবাদপত্রের প্রথম পাতাজুড়ে ছিল কেবলমাত্র তাঁরই মৃত্যু সংবাদ।
১৪ই অক্টোবর ১৯৮৭ সালের (২২শে আশ্বিন ১৯০৯ শকাব্দ, বুধবার, ২৭শে আশ্বিন ১৩৯৪ বঙ্গাব্দ) আজকাল পত্রিকার শহর সংস্করণের প্রথম পাতার বাঁদিকে অনেক বড় করে লেখা লেখা হয়েছিল – “কিশোরকুমারের জীবনাবসান। গান শেষ। বোম্বাই বিনিদ্র। কলকাতা স্তব্ধ।” তখন ভারতে চলছিল বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আসর। তাই পাতার ডানদিক জুড়ে ছিল ক্রিকেট খেলার খবর। বিশ্বকাপ ক্রিকেট না চললে এই খবরটাই পুরো পাতা জুড়ে থাকত।
কিশোরকুমার এবং কিশোরকুমারের গান নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। তাঁর গান ভাষার গন্ডী ছাড়িয়ে মানুষের হৃদয়ে প্রবেশ করেছে – তাঁর গান আট থেকে আশি সবাইকে ছুঁয়েছে। কিশোরকুমার সম্বন্ধে অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বের লেখা এবং স্মৃতিচারণ পাওয়া যায়। কিন্তু তাঁকে নিয়ে কাননদেবীর স্মৃতিচারণ ছিল একেবারেই আলাদা ধরনের। ১৬ই অক্টোবার ১৯৮৭ সালে বর্তমান পত্রিকার অষ্টম পৃষ্ঠার প্রথম কলমে শ্রীমতী কাননদেবীর বয়ানে প্রয়াত কিশোরকুমারের স্মৃতিচারণে লেখা হয়েছিল –
“অতীত দিনের খ্যাতনামা অভিনেত্রী, গায়িকা কাননদেবী কিশোর কুমারের মৃত্যুতে অত্যন্ত শোকাহত। ‘আমার বৌমা যখন আমাকে খবরটা দিল তখন আমি হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলি কিশোরের আয়ু বেড়ে গেল। তখন বৌমা বল্লে, না মা খবরে আমরা দেখলাম। বিশেষ খবরগুলো আবার বলে, তাই তাড়াতাড়ি TV-র সামনে বসে পড়লাম। শুনে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমি তো এখনো ভাবতে পারছি না যে কিশোর নেই। কিবা বয়স হয়েছিল ওর – মাত্র ৫৮ বছর বয়েসে ও চলে গেল।’ কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে গেলেন কাননদেবী। ‘ছোটদের মৃত্যু সমন্ধে বলতে কিরকম যেন লাগে। এই যে আজ ওর মরদেহ খাণ্ডোয়াতে নিয়ে যাওয়া হলো খবরে শুনলাম, আমার কিন্তু এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। কিশোর, অশোকবাবু ওদের সঙ্গে আমাদের একটা পারিবারিক সম্পর্ক। একসঙ্গে কত বেড়িয়েছি সবাই কিশোরের সঙ্গে দেখা হয়েছে, কত গল্প গুজব গান বাজনা হয়েছে – সেসবই আজ স্মৃতি। আমি বরাবরই কিশোরের গানের ভক্ত, তবে ওর সব গানের নয়। যেগুলো সিরিয়াস গান সেগুলো অপূর্ব। আমার বাড়িতে প্রায় পঞ্চাশখানা কিশোরের গানের ক্যাসেট আছে। সব থেকে বড় ব্যাপার হ’ল একেবারে চ্যাংড়ামোর গান থেকে শুরু করে দারুণ সিরিয়াস গান ও অত্যন্ত দক্ষতার গাইতে পারত যা আর অন্য কেউ পারেন না। ওর গলা ছিল ভগবানদত্ত, ওতো কারুর কাছে শেখেওনি। এছাড়া ওর ছবিও দেখেছি কয়েকটা। অভিনেতা হিসাবেও কিশোর অনেক বড় ছিলো। আজ আমার অশোকবাবুর কথা ভেবে খারাপ লাগছে। পরপর স্ত্রী ও ভাইয়ের শোক পেলেন তিনি। সব থেকে বড় কথা হলো ভারতীয় সঙ্গীত জগতে কিশোরের অভাব কোনদিনই পূর্ণ হবে না।’ …’’
‘আভাস কুমার গঙ্গোপাধ্যায়’ থেকে ‘কিশোর কুমার। যাত্রাপথ খুব সহজ ছিল না। কিন্তু ওই যে বলে না অবলীলায় সবকিছুকে উড়িয়ে দেওয়া, যে কোনও প্রতিকূল অবস্থাকে শুধু হাসি মজায় উড়িয়ে ভারতীয় সঙ্গীতের কিংবদন্তী হয়ে উঠেছিলেন এই মানুষটি।
‘আরাধানা’ চলচ্চিত্রের ‘কোরা কাগাজ হে মন মেরা’ গানটি শুরু হবার আগে ‘এহে … আহা …’ বলে যে আলাপ ছিল, তার কথা কি কেউ ভুলতে পারে? এখনো ওরকম সুর করে কেউ গান শুরু করলে সবার মনে একজনের নামই আসে – কিশোর কুমার, সবার কিশোর দা। বাংলা এবং হিন্দি- দুই ভাষার চলচ্চিত্রেই সমানভাবে দাপট নিয়ে চলেছেন তিনি। মৃত্যুও তাঁকে থামাতে পারেনি। আজও তাঁর গান সমান জনপ্রিয়। ছোট থেকে বড় সবাই তাঁর গানে মুগ্ধ। কিছু যেন একটা ছিল তার কণ্ঠে, যা সকল শ্রোতাকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে। সবাইকে বাধ্য করে তাঁর গান শুনতে।
কী কোমল, মিষ্টি-মধুর ছিল তাঁর কণ্ঠ, অথচ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গায়ক ছিলেন না তিনি। প্রকৃতির উপহার হিসেবে গলায় সুর নিয়েই যেন জন্মেছিলেন। জীবনের নির্দিষ্ট একটি সময় বাদ দিলে তাঁর পুরো জীবনটাই সাফল্যে ভরপুর। একজন সফল অভিনেতা, গায়ক, প্রযোজক, গীতিকার এবং সঙ্গীত পরিচালক। তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্রগুলোর বেশিরভাগই ছিল কমেডি ধাঁচের। লোক হাসানোয় তাঁর অন্ত ছিল না – সেটি পর্দার ভিতরে হোক বা বাইরে। বিভিন্ন ধাঁচের গান গেয়ে তিনি প্রমাণ করে গেছেন, তাঁর মতো কেউ নেই, কিশোর কুমার শুধু একজনই হতে পারে।
’৭০ এর দশকে, মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় ও পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় মিলে মান্না দে’র পুজোর গান তৈরি করলেন। ‘‘তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে আমার মরণযাত্রা যে দিন যাবে।’’ গান শুনে মান্না দে আঁতকে উঠে বললেন, ‘‘কী করেছেন মশাই! আমার মরণযাত্রা করিয়ে দিয়েছেন! এই গান আপনাদের বৌদি গাইতে দেবে না!” দু’জনেই খুব ভেঙে পড়লেন! কিন্তু মান্না দে-কে কিছুতেই রাজি করানো গেল না! কিছু দিন বাদে পরিচালক মনোজ ঘোষ তৈরি করলেন, ‘তুমি কত সুন্দর’ নামের একটি চলচ্চিত্র। ছবিটিতে মৃণাল বন্দোপাধ্যায় ও পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় গান তৈরি করলেন। ‘তোমার বাড়ি …’ গানটা শুনে পরিচালকের পছন্দ হয়ে গেল। বললেন, এই ছবির জন্য গানটা তাঁর চাই। কিন্তু মান্না দে’র জন্য তৈরি গান কে গাইবে? সকলেই একমত, এই গান গাওয়ার মতো এক জনই আছেন, তিনি কিশোর কুমার।
মনোজ ঘোষ ও মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় রওনা দিলেন মুম্বই। গান কিশোরকুমারের খুব পছন্দ হল। কিন্তু সমস্যা হল অন্য জায়গায়। মুখরাতে একটা লাইন ছিল, ‘তুমি বারান্দাতে দাঁড়িয়ে থাকো …।’ কিশোর কুমার বেঁকে বসলেন। গানের মধ্যে বারান্দা শব্দটি চলবে না। “পুলকবাবুকে বলে ওটাকে ‘আঙিনা’ করে দাও।” দু’জন পড়লেন মহা বিপদে। তখন তো মোবাইল ফোন ছিল না। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় কে কিছুতেই ফোনে ধরা গেল না। আর তাঁকে জিজ্ঞাসা না করে শব্দ বদল করার সাহস কারও নেই! এ দিকে আবার কথা না বদলালে কিশোর কুমার গাইবেন না! শাঁখের করাত! রেকর্ডিংয়ের দিন কিশোর কুমার এলেন। সিরিয়াস গান। কিশোর মামার ডুবে গেলেন গানের মধ্যে। গান শুরুর আগে ডাকলেন মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় কে। মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় তো নিশ্চিত, এ বার কিশোর কুমার নির্ঘাত বলবেন, “কথা চেঞ্জ হল?” আর তার পরই রেকর্ডিং বন্ধ! কিন্তু কী কাণ্ড! কিশোর কুমার বললেন, “বড় ভাল সুর করেছ মৃণাল।” তারপর ‘বারান্দা’ শব্দ সমেত গাইলেন গানটা। আর ওই প্রসঙ্গে গেলেন না। তৈরি হল কালজয়ী এক বাংলা গান।
এই হলেন কিশোর কুমার। তিনি চলে গেছেন আজ থেকে প্রায় ৩৪ বছর আগে। এখনও সমান চুম্বক কিশোর কুমারের গানে। এখনও আগের মতো সমান জনপ্রিয় তিনি। তাঁর নামে ভারতবর্ষের যে কোনও প্রান্তে অনুষ্ঠান হোক না কেন, সিট ফাঁকা পড়ে থাকে না! যত মাধ্যম আছে সব জায়গায় তাঁর গান হিট।
বিনাকা/সিবাকা গীতমালা খ্যাত আমিন সায়ানির সাথে ব্যাঙ্গালোরে একটি অনুষ্ঠানে ৮৯ বছরের মান্না দে একবার কিশোরকুমারকে নিয়ে একটা অদ্ভুত ঘটনার স্মৃতিচারণ করেছিলেন। মান্না দে হিন্দী এবং বাংলায়, তাঁর সময়ের প্রায় সব নায়কের গলায় গান গেয়েছিলেন। এমনকি কিশোরকুমারের জন্যও প্লেব্যাক করেছিলেন। মান্না দে তাঁকে নিয়ে ছিলেন প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বহুবার বহু সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন – “এমন সুরেলা গায়ক আমি কখনও দেখিনি। আমরা নিজের অজান্তে একটু-আধটু বেসুরো ফেলেছি, কিশোর কখনও নয়।” এই মান্না দে একদিন হঠাৎ গভীর রাত্রে কিশোরের ফোন পেয়েছিলেন। অত গভীর রাত্রে কিশোরের ফোন পেয়ে তিনি বেশ অবাকই হয়েছিলেন – কারণ কিশোরকুমার রাতে কাউকে বিশেষ ফোন করতেনও না আর ফোন ধরতেনও না। ফোনে গম্ভীর গলায় ফিসফিস করে (যাতে কেউ না শুনে ফেলে!) কিশোর তাঁর মান্নাদাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে মান্না দে যদি পরের দিন কিশোরের জন্য গান রেকর্ডিং না করেন, তা হলে ভাল হয়। মান্না দে’র খুব কৌতুহল হয়েছিল। কোথা থেকে কিশোর ফোন করছেন? প্রশ্নটা তিনি করেওছিলেন কিশোরকে। কিশোর জানিয়েছিলেন তিনি তখন মহাবালেশ্বরে! প্রডিউসার নাকি কিশোরকে পুরো পারিশ্রমিক দেন নি, তাই কিশোর প্রডিউসারকে ফাঁকি দিয়ে সিনেমা তৈরির মাঝপথেই মুম্বাই থেকে মহাবালেশ্বরে গা ঢাকা দিয়েছিলেন। গানটা নাকি আদতে কিশোরের গাওয়ার কথা ছিল। সিনেমার নামটা মান্না দে বলেন নি।
কিশোরের সমগ্র চরিত্রকে ঠিক কি বলা যায়? ‘এনসেকট্রিক জিনিয়াস’। কারও মতে তিনি ‘মূর্তিমান পাগল’। আর পাগলামিই তো জিনিয়াসের লক্ষণ। এই জন্যই তাঁর সম্পর্কের অমোঘ উক্তিটি করা যায়,
‘‘ইন এভরি লুনাটিক, দেয়ার ইজ মিসআন্ডারস্টুড জিনিয়াস।’’ …
‘প্রতিভা’, এমনকি তার চেয়েও বড় কোনো শব্দ দিয়ে যদি ব্যাখ্যা করা যায়, তবে কিশোর কুমার তা-ই। এ কথা আবেগের। যুক্তিরও। কি বাংলা, কি হিন্দি – দুই ভাষার চলচ্চিত্রেই সমানভাবে দাপট নিয়ে গেয়ে চলেছেন কিশোর কুমার। অভিনয় করেছেন। এমন নয় যে শখের বশে। পেশাদার শিল্পীর মতোই, দাপটের সঙ্গে। কী ছিল তাঁর কণ্ঠে? কী যেন একটা ছিল, যা শুনলেই মনে হয় কণ্ঠটা চুম্বকের মতো টানে। কোমল, মধুর, কখনো দরাজ ছিল তাঁর কণ্ঠ। গায়কিও কী অসাধারণ! অথচ শুরুতে গানের তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বা আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছিল না তাঁর। জীবনকালে খুব একটা সাক্ষাৎকার না দিলেও আড্ডা-আলাপচারিতায় তিনি এমনটাই বলেছেন, জানিয়েছিলেন। কিশোর কুমার বরাবরই স্বীকার করে এসেছেন, তিনি সঙ্গীত বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন। মন থেকেই তাঁর গান গাইতে ভালো লাগত। পরিণত কিশোর কুমারও হারমোনিয়াম ভালো বাজাতে পারতেন না। বাজাতে গিয়ে ভুল হলে হাল ছেড়ে দিয়ে খালি গলায় গেয়ে দিতেন। এমনও শোনা গেছে, ‘সিঙ্কোপেইটেড নোটস’ থাকলে নাকি তাঁর যেন দম আটকে আসত!
আধুনিক বাংলা গানের বিখ্যাত গীতিকার পুলক বন্দোপাধ্যায় তাঁর ‘কথায় কথায় রাত হয়ে যায়’ গ্রন্থে তিনি বাংলা গানের অনেক বিখ্যাত গায়ক এবং গায়িকাদের কথা উনি লিখেছেন – তাঁদের মধ্যে রয়েছেন কিশোরকুমারও। যাঁরা বর্তমানে কিশোরকুমারকে নিয়ে অল্পবিস্তর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় পড়েছেন, তাঁরা সকলেই জানেন যে কিশোরকুমার গানের স্বরলিপি লিখতে অথবা পড়তে পারতেন না। ‘কথায় কথায় রাত হয়ে যায়’ বইটির ১৬২-১৬৩ পৃষ্ঠা থেকে জানা যায় যে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ও সেটাই জানতেন। কিশোরকুমার একদিন তাঁকে নিজেই বলেছিলেন, “গান শুধু গাইতে জানি। গানের ও-সব গ্রামার ট্রামার, ওই সব সারে গামা টামা আমি কিছুই জানি না।” বইটির ১৬২-১৬৩ পৃষ্ঠায় আরো অনেক তথ্য আছে এই বিষয়ে। ‘পারাবত প্রিয়া’র ছবির ‘অনেক জমানো ব্যথা বেদনা’ গানের রেকর্ডিং চলছিল। সুরকার ছিলেন অজয় দাস। কিন্তু কিশোর কুমার ভুল করে বারবার ‘অনেক’-এর পর ছেদ দিচ্ছিলেন। অজয় দাস এবং পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় এটা নিয়ে আপত্তি জানাতে রেকর্ডিং বুথে ঢুকে পড়েছিলেন। কিশোরকুমার তাঁদের আপত্তি মেনে নিয়েছিলেন। সামনে ঝোলানো গানের কাগজে একটা আঁচর কেটেছিলেন। তারপরে আবার গেয়েছিলেন গানটা। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় তখনও কিন্তু রেকর্ডিং বুথের ভিতর দাঁড়িয়ে ছিলেন। পুনরায় সুরের একটা ভুল হতে অজয় দাস রেকর্ডিং মেশিনের কাছ থেকে মাইক্রোফোনে সেটা গেয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন কিশোরকুমারকে। কিশোরকুমার দেখেছিলেন বার বার তাঁর একটা জায়গায় ভুল হচ্ছে। তাই পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে কলম চেয়ে নিয়ে গানের কথার ওপর সেটা লিখে নিয়েছিলেন। এবং এখানেই চরম বিষ্ময়কর ব্যাপারটা প্রত্যক্ষ করেছিলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। গীতিকার পুলক বন্দোপাধ্যায় স্বচক্ষে দেখেছিলেন কিশোর কুমার হুবহু মান্না দে’র মত গানের কথার ওপর শর্টহ্যান্ড স্বরলিপি লিখে রাখলেন। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় তখন রীতিমতো অবাক। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন কিশোরের দিকে। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হতবাক চেহারা কিশোরেরও নজর এড়ায় নি। তিনি একমুখ হেসে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলে উঠেছিলেন, “না না আমি ওইসব শর্ট হ্যাণ্ড নোটেশন ফোটেশন জানি না। ওসব মান্নদা জানেন। আমি শুধু লিখে নিলাম। আপনার এই ব্যাথা বেদনার শেষ লাইনটাতে ‘বুঝেও কেন বুঝল না সে/কী আমার শুভ কামনা।’ এই ‘শুভ কামনা’-য় আমার গলাটা কেমন ঘুরবে, এই দেখুন নোটেশন আমি লিখিনি, শুধু ‘শুভ কামনা’ শব্দটার নীচে একটা গোল দাগ টেনে দিয়েছি।” ওদিকে পুলক বন্দোপাধ্যায় দেখেছিলেন গানের কাগজে মান্না দে যেমনভাবে স্বরলিপির আঁচড় দিতেন, কিশোরদা তেমনি আঁচড় দিয়েছিলেন। তবে সেগুলো ছিল কিশোরকুমারের নিজস্ব আঁকিবুঁকি। এই হলেন গানের রাজা কিশোরকুমার। তিনি বাংলা লিখতে এবং পড়তে জানতেন না। তাই বাংলা গান হিন্দীতে লিখে নিতেন।
আরও একটি অবাক করা তথ্য হল, হিন্দী এবং বাংলা মিলিয়ে সলিল চৌধুরীর পরিচালনায় কিশোরকুমারের খুব বেশী গান নেই। তবে এই দুজনের যৌথ উদ্যোগে যে কয়টি গান তৈরি হয়েছিল, সেগুলোর প্রায় সব গানই কিন্তু ভাল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তবে সলিল চৌধুরীর সুরে কিশোরকুমারের কণ্ঠে কোন আধুনিক বাংলা গান নেই। কেন এরকম হয়েছিল? কোনদিন স্পষ্ট করে জানা যাবে না। কিশোরকুমারের মৃত্যুর পর সলিল চৌধুরী নানা পত্রিকায় কিশোরকুমারের স্মৃতিচারণ করেছিলেন। সেগুলো পড়লে মনে হয় যে কোন কারণে সলিল চৌধুরীর সঙ্গে কিশোরকুমারের হয়তো মানসিক দূরত্ব তৈরী হয়েছিল। সম্ভবতঃ সলিল চৌধুরী কিশোরকুমারের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রথাগত শিক্ষার অভাব অনুভব করতেন। আনন্দলোকের ১৯৮৭ সালের ৩১শে অক্টোবরের সংখ্যায় (পৃষ্ঠা ৮২-৮৩) সলিল চৌধুরী লিখেছিলেন –
‘‘হ্যাঁ, অসাধরণ কন্ঠ ছিল কিশোরের, এ বিষয় কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু কন্ঠ থাকলেই তো আর সব কিছু হয় না। তবে এ কথা বলবো – কিশোরের যদি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শিক্ষাটা থাকতো, তাহলে কিশোর এক অন্য কিশোর হয়ে উঠতেন। জনপ্রিয়তা দিয়ে বিচার নয়, সাংগীতিক গুণগত সৌকর্যে কিশোর তাহলে সহজেই মহম্মদ রফির স্থানে পৌঁছোতে পারতেন। তবে সংগীতশিল্পী হিসেবে যদি কিশোরের মূল্যায়ন করতে হয়, তাহলে এটাই হয়তো সঙ্গত হবে যদি বলি কিশোর একটা নতুন স্টাইলের উদ্ভাবন করেছেন – যেটা পপ-স্টাইলের খুব কাছাকাছি। এক্ষেত্রে ওঁর ধারেকাছে পৌঁছোবার মতো কেউ ছিল না। এ কথা আমি জোরের সঙ্গে বলতে পারি।’’
এক সময় কিশোরকুমারের মনে হয়েছিল যে সলিল চৌধুরী যেশু দাসকেই বেশী পছন্দ করেন। আনন্দলোকের ওই একই প্রবন্ধে সলিল চৌধুরী লিখেছিলেন –
‘‘মান অভিমানের পালাও চলতো মাঝে মাঝে। মাঝে মাঝে ভুল বোঝাবুঝিও হয়েছে। যেমন – সত্তর সালের প্রথম দিকের একটা ঘটনা। বাসু ভট্টাচার্যের ‘অন্দর মহল’ নামে একটা ছবির সংগীত পরিচালনার কাজ করছি। ওই ছবিতে যেশু দাসকে দিয়ে আমি একটা গান করাই। এর আগে একটা ছবির গানের জন্য কিশোরকে বলেছিলাম। যে কোন কারণে হোক, সেই ছবিতে কিশোর গাইতে পারেননি। কিশোর ধরে নিয়েছিলেন বাসুবাবুর ছবিতে যেশুকে দিয়ে গান গাইয়ে আমি প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করেছি। ব্যাপারটা অবশ্য আদৌ তা ছিল না। অনেকদিন এই ভুল বোঝাবুঝি বা মান অভিমানের পালা চলে। এবং এক সময় কিশোরের সেক্রেটারি আব্দুল সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়। ওই ব্যাপারটা যে আদৌ প্রতিশোধমূলক নয় সেটা আব্দুলকে বুঝিয়ে বলি। আব্দুলের মুখে সব কথা শুনে কিশোরকুমার তো জল। সব মান অভিমানের পালা আর ভুল বোঝাবুঝির পালা শেষ হয়ে যায় সেই মুহূর্তেই।’’
কিন্তু এর ফলে সবচেয়ে বঞ্চিত হয়েছেন শ্রোতারা।
ওদিকে কিশোরকুমারের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্ষেত্রে সলিল চৌধুরীর বক্তব্য ছিল (আনন্দলোক ৩১শে অক্টোবর ১৯৮৭, পৃষ্ঠা ৮৩) –
‘‘রবীন্দ্রসঙ্গীত ওঁর কণ্ঠে একটা অন্য ডায়মেনশন এসেছে – এ বিষয় কোন সন্দেহ নেই। কিশোর ছিলেন উদাত্ত কণ্ঠের অধিকারী। হেমন্তদা (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়) এবং সমরেশ রায়ের কাছে এ বিষয় তাঁর শিক্ষার আগ্রহ লক্ষ্য করেছি। যেটা খুবই পশংসনীয়। তবে, পঙ্কজ মল্লিক, দেবব্রত বিশ্বাস এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে, রবীন্দ্রসংগীত যে রূপ পেয়েছে, তার সঙ্গে কিশোরের রবীন্দ্রসংগীতের কোন তুলনা চলে না। যদিও তাঁর কন্ঠের গুণে গানগুলো উৎরে গেছে চমৎকার ভাবে।’’
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে সলিল চৌধুরীর চোখে কিশোরকুমার খুব ভাল গায়ক হলেও, সেই অর্থে পরিপূর্ন শিল্পী ছিলেন না। সব শিল্পীর মধ্যে সীমাবদ্ধতা থাকে। কিশোরকুমার নিজেও তাঁর সীমাবদ্ধতা নিয়ে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। তবুও কিশোরকুমারের গানের গলার রেঞ্জ নিয়ে সলিল চৌধুরী খুব নিশ্চিন্ত ছিলেন। ১৬ই অক্টোবর ১৯৮৭ সালের বর্তমান পত্রিকার অষ্টম পৃষ্ঠায় কিশোরকুমার স্মরণে সলিল চৌধুরীর স্মৃতিচারণ ছিল এই রকম –
‘‘কিশোর ছিলেন অসাধরণ শিল্পী। ওর গানের সুর করবার সময় কখনো ভাবতে হ’ত না, যেমনটি হ’ত মুকেশের গানে সুর দেওয়ার সময়। লতার গানের সুর দিতেও ভাবতে হয় না। লতা কিশোরের গলার রেঞ্জ এমন যে, সে নিয়ে উদ্বেগের কোন কারণ থাকে না।’’
তবে, আর যাই হোক, অন্য সকল সঙ্গীত পরিচালকের মত সলিল চৌধুরীও কিশোরকুমারের গানের প্রতি নিষ্ঠা নিয়ে খুব শ্রদ্ধাবান ছিলেন। ১৬ই অক্টোবর ১৯৮৭ সালের বর্তমান পত্রিকার অষ্টম পৃষ্ঠায় সলিল চৌধুরীর সাক্ষাৎকার থেকে জানতে পারা যায় যে কিশোরকুমারের অকাল প্রয়াণ না হলে শ্রোতারা কিশোরকুমারের কন্ঠে নজরুলগীতি শুনতে পেতেন। সলিল চৌধুরী লিখেছিলেন –
‘‘কিশোর ছিল গানের ব্যাপারে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান। এই নিষ্ঠাই ওকে কিশোরকুমার করে তুলেছিল। ও যখন রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করলো হেমন্তদা আর সমরেশ রায়ের তত্ত্বাবধানে, আমি শুনেছি প্রতিটি নোট যাতে যথাযথভাবে লাগে, তার অভ্যাসের জন্য ১০/১২টি গানের রেকর্ডিং ও ক্যানসেল করেছিল। অনেকগুলো টাকার ব্যাপার, সে ক্ষতিও ও স্বীকার করেছিল। মেগাফোনের কমলেশ ঘোষের কাছে শুনেছি ওর নাকি এ বছরেই বারোটা নজরুলগীতি রেকর্ড করার কথা ছিল। সম্প্রতি রবীন্দ্রসঙ্গীতের ডিস্কটা বেড়োবার পরই কিশোর ঠিক করেছিল আগামী বছরে নজরুলগীতি রেকর্ড করবে। ইচ্ছেটা পূর্ণ হ’ল না।’’
শুধু কি কিশোরকুমারের ইচ্ছে অপূর্ণ থেকে গেছে? না। তাঁর মৃত্যুতে আমাদের মত শ্রোতাদের অনেক ইচ্ছে অপূর্ণ রয়ে গেছে। হয়তো সলিল চৌধুরীর সুরে কিশোরকুমার আরও কিছু গান গাইতেন। হয়তো পঞ্চম-কিশোরের মত সলিল-কিশোরও ভারতীয় লঘু সঙ্গীতের জগতে একটা বিশেষ অধ্যায় হতে পারত। হয়ত …
(তথ্যসূত্র:
১- Kishore Kumar: An Authorised Biography by Kishore Valicha, Viking (১৯৯৮)।
২- Composer Kishore Kumar by Kamal Dhiman, Nikita Publications (২০১৭)।
৩- Kishore Kumar: Method in Madness, Derek Bose, Rupa Publications India (২০০৪)।
৪- বর্তমান পত্রিকা, ১৬ই অক্টোবর ১৯৮৭ সাল।
৫- কথায় কথায় রাত হয়ে যায়, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়।
৬- আনন্দলোক পত্রিকা, ৩১শে অক্টোবর ১৯৮৭ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত