রবীন্দ্রনাথ ‘সাধারণ মেয়ে’র আখ্যান লিখতে বলেছিলেন শরৎবাবুকে। দুঃখী সাধারণ মেয়ে, নিতান্ত তুচ্ছ মেয়ে, যদি কোনো অসাধারণত্ব থাকেও, তার অন্বেষণ করার জন্য, কেউ হয়তো থাকে না। ‘কাঁচা বয়সের জাদু’তে তারা বিকিয়ে যায় ‘মরীচিকার দামে’। এখানেই অবশ্য রবীন্দ্রনাথের কলম থেমে যায়নি; তিনি চেয়েছিলেন এই সাধারণ মেয়েটি অসাধারণ হয়ে উঠুক কলমের এক আঁচড়ে। বড়ো-বড়ো নামজাদার সভার মাঝখানে যেন সে অনায়াসে আপন অহঙ্কারে হয়ে থাকতে পারে উন্নতশির, এগিয়ে যেতে পারে চারদিকের হাততালিকে উপেক্ষা করে। এই স্বপ্ন পূরণ করতে পারেন শরৎবাবুই। করেছেনও বটে! পঁচিশ বছর একটানা মেয়েদের গল্পই লিখে গেছেন শরৎচন্দ্র। ১৯১৩ থেকে ১৯৩৮ – তাঁর কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। সাধারণ মেয়ের আখ্যান, আটপৌরে রোম্যান্টিক ঠাসবুনোট গপ্পো, নিপাট সহজ ভাববিভোর ভাষা – এই হলো তাঁর পুঁজি। অবিরত লিখে গেছেন প্রেমাকুল মেয়েদের গল্প। পতিতা, বিধবা, বৈষ্ণবী, সতী, অরক্ষণীয়া অথবা বিয়ে-বহির্ভূত প্রেম – তা সে যেমনটাই হোক না কেন, শরৎচন্দ্র অভিভূত হয়ে থাকতেন তাঁদের প্রেমে। শরৎচন্দ্র, শ্রী দিলীপকুমার রায়কে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘‘জীবনে যে ভালোবাসলে না, কলঙ্ক কিনলে না, দুঃখের ভার বইলে না, সত্যিকার অনুভূতির অভিজ্ঞতা আহরণ করলে না, তার পরের মুখের ঝাল খাওয়া কল্পনা সত্যিকার সাহিত্য কতদিন জোগাবে?…সবচেয়ে জ্যান্ত লেখা সেই, যা পড়লে মনে হবে গ্রন্থকার নিজের অন্তর থেকে সবকিছু ফুলের মতো বাইরে ফুটিয়ে তুলেছে। দেখোনি বাংলাদেশে আমার সব বইগুলোর নায়ক নায়িকাকেই ভাবে এই বুঝি গ্রন্থকারের নিজের জীবন, নিজের কথা। তাই সজ্জন সমাজে আমি অপাংক্তেয়।’’ শ্রীকান্ত সম্পর্কেও এই একই অভিমান ছিল শ্রীকান্ত স্রষ্টার। আত্মীয়-অনাত্মীয় সকলের একটানা ছি-ছি বর্ষণে তাঁর মন হতাশ হয়ে পড়েছিল, জন্মেছিল আত্মধিক্কার। জীবনের শুরুতে যে ছিছিক্কার তাড়না করেছিল শ্রীকান্তকে, জীবনের অন্তিমে পৌঁছে সেই ধিক্কারকে মেনে নিতে মন সায় দেয়নি তাঁর। তাঁর ‘ভবঘুরে জীবনের অপরাহ্ণে’ পৌঁছে বিগত স্মৃতি রোমন্থন করতে-করতে শ্রীকান্ত বিচিত্র সৃষ্টিকে উপভোগ করেছিল, অন্বেষণ করেছিল নিজের কাছের যৌক্তিকতা। এই বৃত্তে মগ্ন হতে-হতে বারবার শরৎচন্দ্রের জীবনযাপনই মনে আসে। মানুষের অন্তরের অনন্ত রহস্যে ডুব দিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র; উপন্যাসের শ্রীকান্ত। তাই শ্রীকান্ত বলে, জগতের অনেক বাস্তব ঘটনা কল্পনাকে অতিক্রম করে কোথায় যে চলে যায়, তা বলে বোঝানো দায়। রেঙ্গুন-ভ্রমণের প্রায় শেষে লিখলেন এই শ্রীকান্ত প্রথম পর্ব। পেলাম আমরা ইন্দ্রনাথকে, পেলাম রাজলক্ষ্মীকে। রাজলক্ষ্মীর পিয়ারীবেশ হয়তো কল্পনা, কিন্তু রাজলক্ষ্মী শরৎচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ বাল্যসঙ্গিনী, দেবানন্দপুরে যে-কিশোরীটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল, শরৎচন্দ্রের, সে তাঁর ‘উৎপাত ও উপদ্রবেরও পরম সহিষ্ণু পাত্রী ছিল’। অবশ্য লেখক একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘‘রাজলক্ষ্মীকে কোথায় পাবে? ওসব বানানো মিছে গল্প। শ্রীকান্ত একটা উপন্যাস বই ত নয়; ও-সব মিছে জনরবে কান দিতে নেই। কাহিনীটি কি সত্যি?’’
শ্রীকান্তের পড়াশোনার বিবরণও কিন্তু শরৎচন্দ্রের বাল্যজীবনের সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। অথবা ইন্দ্রনাথ? ভাগলপুরের বন্ধু রাজু তথা রাজেন্দ্রনাথ মজুমদারের অবিকল গপ্পো। সন্ন্যাসী শ্রীকান্ত যেভাবে জীবনকে প্রত্যক্ষ করে, তার সঙ্গেও প্রত্যক্ষ সাদৃশ্য আছে সন্ন্যাসীবেশী ভ্রামণিক লেখকের। শ্রীকান্ত ভ্রমণ করেছিল, শরৎচন্দ্র সেই ভ্রমণকে প্রকাশ করেছিলেন। শ্রীকান্ত দাবি করেছে, সে নাকি যা দেখে, অবিকল লেখে, ‘কবিত্ব’ সৃষ্টিতে সে অপারগ। শরৎচন্দ্রের জয় সেখানেই, তিনি সত্য কথা সোজা করে বলতে গিয়ে কবিত্ব করতে পারেন – বাস্তব এবং কল্পনা একাকার হয়ে যায়। এই উপন্যাসে তাই স্পষ্টতই দুটি সত্তার, আত্মকাহিনি এবং আত্ম-সমালোচনা। বস্তুতঃ এটা বোধহয় তাঁর আরো অনেক লেখাতেই প্রকট। ‘শ্রীকান্তের শরৎচন্দ্র’তে মোহিত লালের বিশ্লেষণ, ‘ইহার নায়ক একাধারে আত্মীয় বটে, পরও বটে। লেখক যেন আপনাকেই বাহিরে একটু তফাতে ধরিয়া দেখিতেছেন।’ চন্দ্রনাথ পড়েও মনে হয়, এ তো শরৎচন্দ্রের শান্তিদেবীকে বিয়ে করার কাহিনি। রেঙ্গুনে থাকাকালীন লেখক যে-বাড়িতে থাকতেন, তার নিচের তলায় থাকতেন এক বাঙালি ব্রাহ্মণ, পেশায় সে মিস্ত্রি। মাতাল চক্রবর্তীর সংসারে ছিল একমাত্র কন্যা শান্তি, যাঁকে মাতাল বাবার অনেক অন্যায়-অত্যাচার সহ্য করতে হতো। এরকমই একদিন শান্তি শরণাপন্ন হয়েছিলেন লেখকের। চক্রবর্তীকে অনেক বুঝিয়েও যখন কাজ হলো না, তখন শরৎচন্দ্র নিজেই শান্তিকে বিয়ে করেন এবং সুখেই চলেছিল দিনযাপন। চন্দ্রনাথ উপন্যাসে চন্দ্রনাথ-সরযুবালার বিয়েও অনেকটা এমনভাবেই ঘটেছিল। প্লেগে আক্রান্ত হয়ে শান্তিদেবীর মৃত্যু হলে শরৎচন্দ্র বিয়ে করেন হিরণ্ময়ী দেবীকে (আসল নাম ছিল ‘মোক্ষদা’, ১৪ বৎসর বর্ষীয় কন্যাকে বিবাহের পরে নাম পরিবর্তন করে শরৎচন্দ্র তাঁর নাম রাখেন ‘হিরণ্ময়ী’) বিতর্ক ঘনিয়েছিল এই বিয়ে নিয়েও। বিয়ে কোথায় কীভাবে হয়েছিল, তা নির্দিষ্ট করে বলাও মুশকিল। তবে রাধারানী দেবীর লেখা থেকে জানা যায়, এই বিয়ের কোনো অনুষ্ঠান হয়নি। এই সম্পর্কটিকে আইনগত বৈধতাও দেওয়া হয়নি। তবে শরৎচন্দ্র তাঁকে চিরকাল স্ত্রীর সম্মান দিয়েছেন এবং তাঁর উইলে সম্পত্তির উত্তরাধিকার দিয়েছিলেন তিনি হিরন্ময়ীকেই। স্বামী-অনুরাগিণী এই স্ত্রীর সাহচর্যে থাকার ফলে উচ্ছৃঙ্খল লেখক তাঁর সাহিত্যচর্চা অব্যাহত রাখতে পেরেছিলেন। শেষ প্রশ্ন উপন্যাসেও তাঁর কমল মানতে চায়নি বিয়ের বন্ধনকে! এই বন্ধন তাঁর কাছে প্রেমের সমার্থক নয়। শিবনাথের সঙ্গে বিয়ের বন্ধনকে সে স্বীকার করে নিতে চায়নি, আবার অজিতের সঙ্গে বিয়ের বন্ধনেও সে নিজেকে আবদ্ধ করেনি। তার মতে আসল বন্ধন থাকে মনে। এমনকি কমলের অভিমত, ‘চাটুবাক্যের নানা অলঙ্কার গায়ে আমাদের জড়িয়ে দিয়ে যারা প্রচার করেছিল মাতৃত্বেই নারীর চরম সার্থকতা, সমস্ত নারীজাতিকে তারা বঞ্চনা করেছিল।’ এমন কোনো আচার-অনুষ্ঠানে কমলের ভারি অবজ্ঞা, যে আচার-বিচার-বুদ্ধির ওপর একটা পর্দা ঝুলিয়ে দেয়। হয়তো এসব ভাবনারই উৎস তাঁর নিজের জীবনযাপন। বিয়ে নিয়ে শিবনাথ-হরেন্দ্রর-অবিনাশের চাপান উতোরেও প্রতিফলিত হয়েছে শরৎচন্দ্রের নিজের জীবনযাপন। শিবনাথ তার দ্বিতীয় বিয়েটি করেছিল শৈব মতে। এতে ক্রুদ্ধ অবিনাশের মন্তব্য, ‘অর্থাৎ, ফাঁকির রাস্তাটুকু যেন দশদিক দিয়েই খোলা থাকে, না শিবনাথ?’ বিচলিত হয় না শিবনাথ, পাল্টা তার জবাব, ‘এটা ক্রোধের কথা অবিনাশবাবু। নইলে বাবা দাঁড়িয়ে থেকে যে বিবাহ দিয়ে গিয়েছিলেন, তার মধ্যে তো ফাঁকি ছিল না, অথচ ফাঁক যথেষ্টই ছিল।’
এই বিয়েগুলোর আগে শরৎচন্দ্র একবার উন্মত্ত হয়েছিলেন একটি মেয়েকে নিয়ে, তাঁর নাম ‘গায়ত্রী দেবী’। প্রতিবেশী যুবকের প্ররোচনায় গায়ত্রী গৃহত্যাগ করেছিল এবং বহু অপমানও তাঁকে সহ্য করতে হয়েছিল এ-সময়। শরৎচন্দ্র গায়ত্রীর দুঃখে কাতর হয়ে বলেছিলেন, সমাজের চোখে গায়ত্রী পতিতা; অতএব আত্মীয়-স্বজনের ঘরে ঠাঁই পাবে না সে। অথচ এই মেয়েটির চোখের জলের হিসাব কোনোদিন নেবে না সমাজ। এই সমবেদনাই রূপান্তরিত হয়েছিল প্রেমে। তবে গায়ত্রী শরৎচন্দ্রের প্রস্তাবে সায় দেয়নি। এ ধরনের ঘটনাও তাঁর উপন্যাস রচনায় পরোক্ষভাবে প্রভাব ফেলেছিল। রেঙ্গুনে ও পেগুতে থাকাকালীন শরৎচন্দ্র যে-উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করতেন, সেই অভিজ্ঞতাও বোধহয় তাঁকে উপন্যাসের কাহিনি-রচনায় প্রণোদিত করেছিল। মদ্যাসক্তি এবং বেশ্যাসক্তি ছিল তাঁর। তিনি যে এজন্য আত্মীয়-পরিজনের কাছে ধিকৃত এবং নিন্দিত হতেন, তাও জানা ছিল তাঁর। সপ্তাহের কোনো কোনো দিন তিনি অফিসেও যেতেন না। এরকম বর্ণনাও পাওয়া যায়, ‘মাসের মাহিনা হাতে পেলেই বন্ধুদের সঙ্গে পাড়ি দিতেন একটু আনন্দলাভের আশায়। নির্দিষ্ট স্থানের কোন স্থিরতা ছিল না – যখন যেখানে খুশী, দল বেঁধে যেতেন, হৈ-চৈ করে রাত কাটিয়ে আসতেন বাসায়।’ শরৎচন্দ্রের নামের সঙ্গে জড়িয়েছিল অনেক পতিতার নামই, তবে তার সত্যতা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত নন। এরকম কাহিনিও লিখিত হয়েছে। বাসন্তী নামে এক পতিতার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা এতটাই বেশি ছিল যে, এই মেয়েটির প্লেগ আক্রান্ত হলে শরৎচন্দ্র তাঁর সেবা করেছিলেন এবং মৃত্যুর পর শেষকৃত্যও করেছিলেন। বাসন্তী ও গায়ত্রীর সঙ্গে লেখকের ঘনিষ্ঠতার গল্প ‘চরিত্রহীনে’র সতীশ-সাবিত্রীর প্রসঙ্গ স্মরণ করায়। শরৎচন্দ্র যে-ভালোবাসায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকতেন, সেই ভালোবাসায় মগ্ন হয়েছিল সতীশ-সাবিত্রী। প্রসঙ্গ ভিন্ন, প্রেক্ষাপটও আলাদা, কিন্তু ভালোবাসার গল্পটা এক। ওই বাসন্তীর গল্পটির আঁচে কি তৈরি হয়েছে দেবদাসের চন্দ্রমুখী-দেবদাস কাহিনি? অথচ শরৎচন্দ্র দেবদাস রচনার জন্য লজ্জিত হয়েছেন; একবার একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘‘ওটা immoral, বেশ্যা চরিত্র তো আছেই, তাছাড়া আরও কি কি আছে বলে মনে হয়।’’ যেজন্য তিনি দেবদাসকে প্রত্যাখ্যান করছেন, সেই জীবনযাপনেই তো অভ্যস্ত ছিলেন শরৎচন্দ্র। অথচ শরৎচন্দ্র যখন নারীর মূল্য লেখেন, তাঁর সাহিত্যজীবনের প্রারম্ভে, তখন নারীর যে-মূল্য নির্ধারণ করেছিলেন, তাঁর সঙ্গে সঙ্গতি নেই তাঁর কালযাপনের। এই লেখাগুলি যমুনা পত্রিকায় যখন ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়, তখন সেখানে ছিল ছদ্মনাম – ‘অনিলা দেবী’। এটি লেখকের দিদির নাম। কেন? কোন সংকোচে এমন ছদ্মনামের ব্যবহার? নাকি নারীর পক্ষে সওয়াল করার জন্য তিনি আড়াল খুঁজেছিলেন একজন নারীর? অথবা নিজের উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনই এর অন্তর্নিহিত কারণ? শরৎচন্দ্রের মনে হয়েছিল নারীসুলভ বলে তার যথার্থ মূল্য নির্ধারণ আদৌ সম্ভব নয়। যেদিন নারী হয়ে যাবে দুর্লভ, সেদিনই সমাজ অনুধাবন করতে পারবে নারীর যথার্থ মূল্য। সমাজ নারীর মূল্য নির্ধারণ করে তাঁর সেবাপরায়ণায়, সহনশীলতায়, সতীত্বে এবং সহনশীলতায়। নারী কতটা সুবিধা দিতে পারে – সেই মানদ–ই যাচাই হয় নারীর মূল্য। অথবা ‘তিনি কতটা রূপসী – অর্থাৎ পুরম্নষের লালসা ও প্রবৃত্তিকে কতটা পরিমাণে তিনি নিবদ্ধ ও তৃপ্ত রাখিতে পারিবেন।’ নারীর মূল্য উপলব্ধির এই একমাত্র পথ। লেখকের স্পষ্ট দৃঢ় সিদ্ধান্ত, ‘‘যে ধর্ম বনিয়াদ গড়িয়াছে আদিম জননী ইভের পাপের উপর, যে ধর্ম সংসারের সমস্ত অধঃপতনের মূলে নারীকে বসাইয়া দিয়াছে, সে ধর্ম সত্য বলিয়া যে-কেহ অন্তরের মধ্যে বিশ্বাস করিয়াছে, তাহার সাধ্য নয় নারীজাতিকে শ্রদ্ধার চোখে দ্যাখে।’’
লেখক মনে করেন না যে পুত্রপ্রসবার্থেই নারীর সার্থকতা। নারীর অবমাননার প্রকৃতি নির্ধারণ করতে গিয়ে শরৎচন্দ্র পিতা-ভ্রাতা-স্বামী – সব পুরুষেরই হীনতার দিকটি লক্ষ করেছেন। পুরুষ যে তাঁর নিয়মে সমাজকে গ্রাস করে, আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে চালায়, তার বিরুদ্ধেও লেখকের জেহাদ। এই পিতা-ভ্রাতা-স্বামী সকলেরই তখন একটাই পরিচয়; কী? না, তাঁরা পুরুষ। আর নারীও তাঁদের আত্মীয় নয়, তাঁরা শুধুই নারী। যাবতীয় ধর্ম, যাবতীয় শাস্ত্র এ-বিষয়ে একই সুরে গলা মেলায়। লেখক প্রসঙ্গত বিধবাবিবাহ নিয়ে ব্যক্ত করেছেন তাঁর বিরূপতা। বিধবামাত্রই কি কুলত্যাগিনী? অথবা বিধবারা কি কুলত্যাগিনী হওয়ার জন্য আকুল? তাঁর কথা, ‘বিধবাদের জোর করিয়া ব্রহ্মচর্যের গীতে আবদ্ধ রাখা আমার অসহ্য মনে হয়। জোর করিয়া বিধবাদের বিবাহ দেওয়া যেমন অন্যায়, জোর করিয়া তাঁহাদের বিবাহ না দেওয়াও তেমনি অন্যায়।’ এর পরের বাক্যটিতে আছে গায়ত্রীকে কেউ ধর্মমতে বিয়ে করতে চাইলে তাতে কোনো দোষ থাকতে পারে না। অথচ ঠিক আগের বাক্যটিতে নিজের বিয়ের ব্যাপারে একজন বিধবার সম্মতি-অসম্মতিকে গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন শরৎচন্দ্র। তাহলে গায়ত্রীকে বিয়ের ব্যাপারে কি তাঁর মতই একমাত্র বিবেচ্য নয়? তখন কি আসলে শরৎচন্দ্র আচ্ছন্ন হয়েছেন নিজের ভালোবাসার মোহে? এই মোহেই বিভ্রান্ত তিনি অনেক সময়। পতিতার আখ্যান যখন বিবৃত হয় শরৎসাহিত্যে, তখন তাঁর গস্নানি-ক্লেদ-তিক্ত-অসম্মানিত জীবনের কোনো রূঢ়তার বর্ণনায় লেখক আগ্রহী নন। ওই পঙ্কিলতার কোনো ছবি আঁকতে আগ্রহী হন না শরৎচন্দ্র, সবার ওপরে সত্য হয়ে থাকে তাঁর প্রেম – প্রেমের একনিষ্ঠতা – প্রেমের রোম্যান্টিকতা। পতিতাটি তখন একমনে ভালোবাসে – সেই ভালোবাসায় সে মহান হয়ে যায়। পিয়ারী বাইজি বাল্যপ্রণয়ের টানে আজীবন শ্রীকান্তনিষ্ঠ হয়ে থাকে, সাবিত্রী-সতীশের মধ্যে চলে প্রেমের আকর্ষণ-বিকর্ষণের খেলা, চন্দ্রমুখী অনুরক্ত হয়ে রইল দেবদাসের প্রতি, বিজলী সত্যেন্দ্রের প্রেমে বাইজি পেশা ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘যে রোগে আলো জ্বাললে আঁধার মরে, সূর্যি উঠলে রাত্রি মরে – আজ সেই রোগেই তোমাদের বাইজী চিরদিনের জন্য মরে গেল।’ কিন্তু বাস্তব এত সাদাসিধে নয়। এই পতিতারা ব্যক্তিবিশেষের আস্থাভাজন হয়, কিন্তু সামাজিক সম্মান অর্জন করে না – সমাজের সঙ্গে তাঁদের কোনো টানাপড়েন তৈরি হয় না আদৌ। তাঁদের স্বাতন্ত্র্য-ব্যক্তিত্ব-অস্তিত্বের লড়াই বিলীন হয়ে যায় কোনো এক পুরুষের মধ্যে। প্রেমের সামাজিক স্বীকৃতি হয়তো সম্ভব নয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের একটাই কথা, ‘‘বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না – ইহা দূরেও ঠেলিয়া ফেলে। ছোটখাটো প্রেমের সাধ্যও ছিল না – এই সুখৈশ্বর্য-পরিপূর্ণ স্নেহ-স্বর্গ হইতে মঙ্গলের জন্য কল্যাণের জন্য আমাকে আজ একপদও নড়াইতে পারিত।’’
বৈধব্য জীবনের রূঢ়তার বর্ণনার ক্ষেত্রেও এই একই অনাগ্রহ লেখকের। সমাজের যে-দায় বহন করতে হয় বিধবাকে, শরৎচন্দ্র সে-বিষয়ে মনোযোগী নন! তাঁর সমস্ত অভিনিবেশ বিধবার প্রেমে। প্রেমই তাঁর উত্তরণের একমাত্র পথ। অবশ্য পল্লীসমাজে নিছক প্রেম আচ্ছন্ন করেনি রমাকে – প্রেমের বাইরেও রয়েছে তাঁর স্বতন্ত্র অভিব্যক্তি। পল্লীসমাজ দেওয়াল হয়ে ব্যবধান তৈরি করেছে রমা-রমেশের। পরিণতিতে রমাকে কাশীবাসী হতে হয়েছে। কিন্তু বড়দিদির মাধবী, চরিত্রহীনের কিরণময়ী বা পথনির্দেশের হেমনলিনীর জীবনে শুধু সত্য হয়ে থাকে প্রেম, কিরণময়ীর মতো বুদ্ধিমতী, আত্মনির্ভরশীল নারীর জীবনে যে ভয়ানক বিপর্যয় দেখানো হয়েছে, তা তো আসলে সামাজিক অধঃপতন। কিরণময়ীর উন্মত্ততা অনেকটা যেন চোখের বালির বিনোদিনীর আদলে ভাবা হয়েছে। বৈধব্যের অতৃপ্তি কিরণময়ী বা বিনোদিনীকে উদ্দেশ্যহীন করে তুলেছে। অথচ সতী নারীর ইমেজ তৈরিতে লেখক কোনো কার্পণ্য করেননি। শত লাঞ্ছনা ও বঞ্চনা সত্ত্বেও স্বামীর প্রতি একনিষ্ঠ প্রেম – এই হলো সতীত্বের ধারণা। এই সতীত্বের সবচেয়ে বড় উদাহরণ অন্নদাদিদি। অন্নদাদিদির বর্ণনায় শরৎচন্দ্র লেখেন, ‘‘যেন ভস্মাচ্ছাদিত বহ্নি! যেন যুগযুগান্তরব্যাপী কঠোর তপস্যা সাঙ্গ করিয়া তিনি এইমাত্র আসন হইতে উঠিয়া আসিলেন।’’ স্বামীর প্রতি অন্নদা এতটাই একনিষ্ঠ যে, সেই স্বামীর জন্যই সে কুলত্যাগিনী হয় এবং সেই কলঙ্ক বয়ে নিয়ে চলে। অন্নদাদিদিকে দেখেছিল বলেই শ্রীকান্ত নারীর কলঙ্কে সহজে বিশ্বাস করত না। গৃহদাহের অচলার ঘর ভেঙেছিল ঠিকই, অচলা সম্পর্কেও অনেক ভ্রামিত্ম তৈরি হওয়ার অবকাশ ছিল, কিন্তু অচলা শেষ পর্যন্ত স্বামী মহিমের প্রতিই ছিল অবিচলিত। অনেক প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে অচলা ছিল সতী। বিরাজ বৌ উপন্যাসেও বিরাজকেও ভয়ানক যাতনা সইতে হয়েছে স্বামীর কাছ থেকে। পাকেচক্রে বিরাজ গৃহত্যাগ করেছিল ঠিকই, কিন্তু তার সতীত্বের অবমাননা ঘটেনি। অথচ তাকে জীবন পণ রেখে সতীত্বের পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। পন্ডিতমশাই উপন্যাসের শুরুতেই কুসুম স্বামীর অবিচারের প্রতিবাদ করেছিল। স্বামী বৃন্দাবন তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর মৃত্যুর পরে পরিত্যক্ত প্রথম স্ত্রী কুসুমকে আবার গ্রহণ করতে চাইলে কুসুম বলেছিল, ‘‘আমি বিধবা। কেন? একি কুকুর-বেড়াল পেয়েছ যে, যা-ইচ্ছে হবে, তাই করবে?… আমার স্বামী মরেছে, আমি বিধবা।’’ কারণ স্বামীর পরিত্যাগের পরে কুসুমের মা তাঁর সঙ্গে এক বৈরাগীর হয়তো বা কণ্ঠীবদল করিয়েছিল এবং তারপর বৈরাগীটি মারা যায়। ফলে কুসুম নিজেকে বিধবা হিসেবে প্রতিপন্ন করে গভীর আত্মসম্মানে। উপন্যাসের শেষে সেই কুসুম বৃন্দাবনের কাছে আত্মনিবেদন করে। এভাবেই সতীত্বের একটা ধারণা করে দেন শরৎচন্দ্র।
১৯২০ থেকে ১৯৩০-এর মধ্যে যা লিখেছিলেন শরৎচন্দ্র, সেগুলির মধ্যে সক্রিয় হয়ে আছে তাঁর রাজনীতিবোধ। ‘পথের দাবি’ উপন্যাসে তাঁর প্রকাশ সর্বাধিক, তবে ‘দেনা পাওনা’ উপন্যাসেও তার প্রমাণ মেলে। কংগ্রেস আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকার সুবাদে জন-আন্দোলন সম্পর্কে তিনি সবটাই সচেতন ছিলেন। চাষির ওপর জমিদারের অত্যাচারের সংবেদনশীল বর্ণনার মধ্য দিয়ে তাঁর সমাজতান্ত্রিক ভাবনার আভাস মেলে। বস্তুত শচীনন্দন চট্টোপাধ্যায়ের শরৎচন্দ্রের রাজনৈতিক জীবন বইতে আছে, জমিদারি-লোপ ও পুঁজিবাদের বিরম্নদ্ধে নতুন নতুন যেসব ভাবনার স্ফুরণ দেখা গেল, তা নিয়ে যেসব বৈঠক হলো, তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল শরৎচন্দ্রের। বাংলায় একটি সোশ্যালিস্ট পার্টি গঠনের পরিকল্পনা ঠিক করে দেন তিনিই। ফলত দেনাপাওনা উপন্যাসে জমিদার-চাষির সংঘাতে চাষিদের ঐক্যবদ্ধ শক্তির কথা বলেছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ-সমস্যার চেয়ে অনেক মুখ্য হয়ে যায় অলকা তথা ষোড়শী-জীবানন্দের সম্পর্ক। ষোড়শীকে মর্মামিত্মকভাবে পরীক্ষা দিতে হয় সতীত্বের। অত্যাচার-জর্জর অলকা অক্লান্ত সেবায় সুস্থ করে তোলে স্বামী জীবানন্দকে। এতে চীর ভৈরবী অলকার কুলটার কলঙ্ক জুটল, তবু সে নিরম্নপায়। স্বামীর প্রতি একাগ্রতা যে-কোনো নারীরই কর্তব্য – এমনই ভাবনায় দেনাপাওনা তৈরি হয়।ঠিক এতটা না হলেও পথের দাবি উপন্যাসেও এই মানবিক সম্পর্কের টানাপড়েন একটা বড় জায়গা নিয়ে রয়েছে। ১৯২৬ সালে প্রকাশিত হয় ‘পথের দাবি’। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হওয়ার আগে এটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল বঙ্গবাণী পত্রিকায়। গ্রন্থাকারে প্রকাশের ইচ্ছা প্রকাশ করেন এম. সি. সরকার অ্যান্ড সন্সের স্বত্বাধিকারী সুধীরচন্দ্র সরকার, কিন্তু কিছু-কিছু অংশ বাদ দিতে চেয়েছিলেন তিনি। লেখক রাজি হননি। শেষ পর্যন্ত রমাপ্রসাদ এবং উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের আনুকূল্যে বইটি ছাপা হয় কটন প্রেসে। প্রকাশ পাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই বাজেয়াপ্ত হয় বইটি। এ নিয়ে যথেষ্ট তোলপাড় শুরু হয়। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, রবীন্দ্রনাথ বইটি সম্পর্কে তাঁর আপত্তি জানিয়ে চিঠি লেখেন কয়েক মাস পরেই। তাঁর মতে, বইখানি উত্তেজক। অর্থাৎ ইংরেজের শাসনের বিরুদ্ধে পাঠকের মনকে অপ্রসন্ন করে তোলে। … ‘‘আমি নানা দেশ ঘুরে এলাম – আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে এই দেখলাম – একমাত্র ইংরেজ গভর্নমেন্ট ছাড়া স্বদেশী বা বিদেশী প্রজার বাক্যে বা ব্যবহারে বিরুদ্ধতা আর কোনো গভর্নমেন্টই এতটা ধৈর্যের সঙ্গে সহ্য করে না। … শক্তিমানের দিক দিয়ে দেখলে তোমাকে কিছু না বলে তোমার বইকে চাপা দেওয়া ক্ষমা। …’’ বলা বাহুল্য, এই চিঠি খুবই আহত করেছিল শরৎচন্দ্রকে। এর উত্তরে যে-চিঠিটি লিখেছিলেন শরৎচন্দ্র, তা অবশ্য পাঠানো হয়নি, তবে চিঠিতে তিনি তাঁর ক্ষোভ এবং অভিমান প্রকাশ করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, তিনি সত্য কথা বলায় ইংরেজরাজের এই অপ্রসন্নতা – ‘‘আমি যখন লিখি এবং ছাপাই তার সমস্ত ফলাফল জেনেই করেছিলাম। সামান্য-সামান্য অজুহাতে ভারতের সর্বত্রই যখন বিনা বিচারে, অবিচারে অথবা বিচারের ভান করে কয়েদ, নির্বাসন প্রভৃতি লেগেই আছে, তখন আমি যে অব্যাহতি পাবো, অর্থাৎ রাজপুরুষেরা আমাকেই ক্ষমা করে চলবেন, এ-দুরাশা আমার ছিল না।… যা উচিত বলে মনে করি তা বলতে পেরেছি কিনা এইটেই আসল কথা। নইলে ইংরেজ সরকারের ক্ষমাশীলতার প্রতি আমার কোন নির্ভরতা ছিল না।’’
এমন একটি সম্ভাবনাময় উপন্যাসেও প্রেমের অনেক টানাপড়েন অকারণ অনেক জায়গা জুড়ে রয়েছে। অপূর্ব, ভারতী, শশীকবি, নবতারা – এদের পারস্পরিক সম্পর্ক অনেক জায়গায় একটু বেশিই গুরুত্ব পেয়েছে। এমনকি সব্যসাচী এবং সুমিত্রার মধ্যে যে সুপ্ত নীরব বোঝাপড়া – সেটাও উপন্যাসটিকে মনোরম করেছে। এর ফলে রাজনীতি প্রসঙ্গটি সবসময় যথাযথ মূল্য পায়নি। একবার একটি সাহিত্য অধিবেশনে শরৎচন্দ্র বলেছিলেন, সাহিত্যসেবাই তাঁর পেশা। বিশেষত উপন্যাসেই তাঁর আগ্রহ। প্রসঙ্গত এটাও বলেছিলেন, ‘‘গোটা দুই শব্দ আজকাল প্রায়ই শোনা যায়, Idialstic and Realistie … আমি নাকি এই শেষ সম্প্রদায়ের লেখক। এই দুর্নামই আমার সবচেয়ে বেশি। অথচ কি করে যে এই দুটোকে ভাগ করে লেখা যায়, আমার অজ্ঞাত।’’ বাস্তবকে তিনি উপেক্ষা করতে চান না; কিন্তু বাস্তব-অবাস্তবের মেলামেশায় ‘কত ব্যথা, কত সহানুভূতি, কতখানি বুকের রক্ত দিয়ে এরা ধীরে ধীরে বড় হয়ে ফোটে’ – সে-কথা জানেন কেবল লেখকই। সুনীতি-দুর্নীতিকে গুরুত্ব দেন না লেখক, কারণ সাহিত্য কোনো নীতিগ্রন্থ নয়। এ-কারণেই বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণকান্তের উইলে রোহিণীর মর্মান্তিক পরিণতি পছন্দ হয়নি শরৎচন্দ্রের। তাঁর মনে হয়েছিল পিস্তলের গুলিতে রোহিণীর এই মারা-যাওয়াটা সাহিত্যের পক্ষে অনুপযুক্ত, হিন্দু সমাজ অবশ্য পাপীর শাস্তিতে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচল। কিন্তু ‘যেটা সবচেয়ে পুরাতন, এদের চেয়ে সনাতন – নর-নারীর হৃদয়ের গভীরতম, গূঢ়তম প্রেম?’ তার পরিণতি কী হলো? বঙ্কিমচন্দ্র নীতির কোপে সাহিত্যকে জলাঞ্জলি দিলেন। এর ফলে মৃত্যু হলো সত্য, সুন্দর আর্টের। তাঁর সিদ্ধান্ত, ‘উপন্যাসের চরিত্র শুধু উপন্যাসের আইনেই মরতে পারে, নীতির চোখরাঙানিতে তার মরা চলে না।’ শরৎচন্দ্রের পল্লীসমাজের রমা এজন্য গাল খেয়েছিল। এ-গাল তো আসলে সাহিত্যের নয়, সমাজের। শরৎচন্দ্র সমাজ-সংস্কারক হতে চাননি, সাহিত্যে সে-দায়ও নেই। তিনি এমন কথাও বলেছেন, ‘‘পুরুষের তত মুশকিল নেই, তার ফাঁকি দেবার রাস্তা খোলা আছে, কিন্তু কোথাও কোন সূত্রেই যার নিষ্কৃতির পথ নেই সে শুধু নারী। তাই সতীত্বের মহিমা-প্রচারই হয়ে উঠেছে বিশ্রদ্ধ সাহিত্য।’’ শরৎচন্দ্র চেয়েছেন শুধু একনিষ্ঠ প্রেমের মর্যাদা দিতে। বলেছেন, ‘সতীত্বের ধারণা চিরদিন এক নয়। পূর্বেও ছিল না, পরেও হয়ত একদিন থাকবে না। একনিষ্ঠ প্রেম ও সতীত্ব যে ঠিক একই বস্তু নয়, এ-কথা সাহিত্যের মধ্যেও যদি স্থান না পায়, ত এ-সত্য বেঁচে থাকবে কোথায়?’ আবার তাঁর মতে সাহিত্যের অনেক কাজের মধ্যে একটি কাজ জাতিগঠন এবং সাহিত্যের idea টি ভাষা ও জাতির কল্যাণকর কি-না সেটাও বিবেচ্য বিষয়।শরৎচন্দ্রের চরিত্রভাবনায় তাই নিছক realistic দৃষ্টিক্ষেপ অনুপস্থিত। realistic শব্দটি তাঁর কাছে যে দুর্নাম! বরং idealism-ই তাঁর বেশি অভিপ্রেত। দুয়ের মেশামেশিতে তাঁর ঝোঁক ছিল নিশ্চয়ই, কিন্তু ওই ভাববাদিতাকে তিনি প্রশ্রয় দিয়েছেন তাঁর চরিত্রায়নে। ব্যথা-ভালোবাসা-বুকের রক্ত দিয়ে নির্মাণ করেছেন যাদের, অনেক সময় উপন্যাসে তারা তাদের ভালোবাসার জোরে জিতে গেছে – যেমনটা চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সাধারণ মেয়ে’ কবিতায়। ফলে উপন্যাস এগিয়ে যায় ঝড়ো হাওয়ার গতিতে – অনেক ঘটনা তার ক্রম হারায়, যুক্তি লঙ্ঘিত হয়, কিন্তু ইচ্ছাপূরণ ঘটে যায়। শরৎবাবুর মেয়েরা জীবনের রূঢ়তায় পর্যুদস্ত হয় না, সর্বদাই প্রেমে মহীয়সী হয়ে থাকে। তাদের স্বাতন্ত্র শুধু উন্মীলিত হয় তাদের প্রেমে। শরৎচন্দ্রের বিশ্বাস ছিল যে প্রেমে, যে-প্রেমে কলঙ্কিত হতে তাঁর এতটুকুও আপত্তি ছিল না, সেই প্রেমে রঞ্জিত তাঁর মেয়েরা – প্রেমের একাগ্রতায় বা একনিষ্ঠতায় তাঁরা আসলে প্রত্যেকেই সতী। তাঁদের ব্যক্তিত্ব বা অসিত্মত্বের সংকট মিটে যায় এই একনিষ্ঠতায় বা বলা যায় ‘সতীত্বে’। ভালোবাসার কোনো অবমাননা করে না তারা। রোহিণীর মতো গুলি খেয়ে হয়ত মরে না শরৎবাবুর নায়িকারা, কিন্তু তাদের সমাজ-অননুমোদিত প্রেম কিন্তু গৃহীত হয় না সমাজে। রোহিণী গুলি খায়, কিরণময়ী আধপাগলা হয়ে মর্মান্তিক কোনো মুহূর্তে অঘোরে ঘুমোতে থাকে। বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে শরৎচন্দ্রের যে-অভিযোগ, সেই নীতিকে কিন্তু তিনি নিজেও অগ্রাহ্য করতে পারলেন না! রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘কী করে জিতিয়ে দেবে?/ উচ্চ তোমার মন, তোমার লেখনী মহীয়সী।/ তুমি হয়ত ওকে নিয়ে যাবে ত্যাগের পথে/ দুঃখের চরমে, শকুন্তলার মত।’ বস্তুত শরৎচন্দ্রের মেয়েরা এভাবেই জিতেছে – ‘আত্ম-অচেতন’ পুরুষ মানুষকে ভালোবাসার মধ্যে তাঁরা খুঁজে পেয়েছে জীবনের সার্থকতা। একাকার হয়ে গেছে সতীত্ব এবং একনিষ্ঠ প্রেম। তাই শরৎবাবুর মেয়েরা শুধুই সেবাপরায়ণ, স্নেহশীল, সহনশীল।
হুগলী জেলায় দেবানন্দপুর একটি ছোট্ট গ্রাম। গ্রামটি ইষ্টার্ন রেলওয়ের ব্যান্ডেল রেল স্টেশন থেকে মাইল-দুই উত্তর–পশ্চিমে অবস্থিত। এই গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে ১৮৭৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৫ই সেপ্টেম্বর তারিখে (বাংলা ১২৮৩ সালের ৩১শে ভাদ্র) শরৎচন্দ্রের জন্ম হয়।তাঁর পিতার নাম মতিলাল চট্টোপাধ্যায় এবং মাতার নাম ভুবনমোহিনী দেবী। প্রভাসচন্দ্র ও প্রকাশচন্দ্র নামে শরৎচন্দ্রের আরও দুই ছোটভাই এবং অনিলা দেবী ও সুশীলা দেবী নামে দুই বোনও ছিলেন। অনিলা দেবী ছিলেন ভাই-বোনদের মধ্যে সবার বড় আর সুশীলা দেবী ছিলেন সবার ছোট। শরৎচন্দ্রের পিতা মতিলাল এন্ট্রান্স পাস করে কিছুদিন এফ.এ. পড়েছিলেন। তিনি অস্থিরচিত্ত, ভবঘুরে প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তাই অল্প কিছুদিন চাকরি করা ছাড়া আর কখনও কিছুই করেন নি। গল্প-উপন্যাস লিখতেন; কিন্তু ঐ অস্থিরচিত্ততার জন্যই কোন লেখা সম্পূর্ণ করতেন না। অভাব অনটনের জন্য তিনি বেশীর ভাগ সময় স্ত্রী ও পুত্র কন্যাদের নিয়ে ভাগলপুরে শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন। তাই শরৎচন্দ্রের ছেলেবেলার অনেক গুলো বছর কেটেছিল ভাগলপুরে মামার বাড়িতে। শরৎচন্দ্রের মাতামহ কেদারনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ি ছিল ২৪-পরগনা জেলার হালিশহরে। কেদার বাবু ভাগলপুরে কালেকটারি অফিসের কেরানি ছিলেন। তিনি ভাগলপুরেই সপরিবারে বাস করতেন। কেদারবাবুর ছোট চার ভাই পরিবারসহ তাঁর কাছেই থাকতেন। শরৎচন্দ্রের বয়স যখন পাঁচ বছর সেই সময় তাঁর পিতা তাঁকে গ্রামের (দেবানন্দপুরের) প্যারী পন্ডিতের (বন্দ্যোপাধ্যায়ের) পাঠশালায় ভর্তি করে দেন।শরৎচন্দ্র এখানে দু-তিন বছর পড়েন। পাঠশালার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তিনি যেমন ছিলেন মেধাবী, তেমনি ছিলেন দুরন্ত। শরৎচন্দ্র যখন প্যারী পন্ডিতের পাঠশালায় পড়ছিলেন, সেই সময় স্থানীয় সিদ্ধেশ্বর ভট্টাচার্য দেবানন্দপুরে একটি বাংলা স্কুল স্থাপন করেন। এই স্কুল স্থাপিত হলে শরৎচন্দ্রের পিতা শরৎচন্দ্রকে প্যারী পন্ডিতের পাঠশালা থেকে এনে সিদ্ধেশ্বর মাস্টারের স্কুলে ভর্তি করে দেন। এই স্কুলেও শরৎচন্দ্র বছর তিনেক পড়েন। এই সময় শরৎচন্দ্রের পিতা বিহারের ডিহিরিতে একটা চাকরি পান। চাকরি পেয়ে তিনি ডিহিরিতে চলে যান। যাবার সময় তিনি স্ত্রী ও পুত্রকন্যাদের ভাগলপুরে শ্বশুরবাড়িতে রেখে যান। পরে তিনি পরিবার ডিহিরিতে নিয়ে গেলেও শরৎচন্দ্র কিন্তু পড়বার জন্য ভাগলপুরেই থেকে গেলেন। তবে ছুটিতে অবশ্য তিনি মাঝে মাঝে ডিহিরিতে বাবা মার কাছে যেতেন। শরৎচন্দ্র দেবানন্দপুর থেকে ভাগলপুরে এলে তাঁর মাতামহ তাঁকে ভাগলপুরের দুর্গাচরণ বালক বিদ্যালয়ে ছাত্রবৃত্তি ক্লাসে ভর্তি করে দেন।ঐ ক্লাসে শরৎচন্দ্রের মাতামহের কনিষ্ঠ ভ্রাতা অঘোরনাথের জ্যেষ্ঠপুত্র মণীন্দ্রনাথও পড়তেন। সে বছরে ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে শরৎচন্দ্র এবং মণীন্দ্রনাথ উভয়েই পাস করেছিলেন। ছাত্রবৃত্তি পাস করে শরৎচন্দ্র ১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দে ভাগলপুরের জেলা স্কুলে সেকালের সেভেন্থ্ ক্লাসে অর্থাৎ বর্তমানের ক্লাস ফোর বা চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন। ছাত্রবৃত্তিতে তখন ইংরাজী পড়ানো হত না। তবে বাংলা, অঙ্ক, ইতিহাস, ভূগোল প্রভৃতি বিষয় একটু বেশী করেই পড়ানো হত। শরৎচন্দ্র ছাত্রবৃত্তি পাস করার ফলে জেলা স্কুলের সেভেন্থ্ ক্লাসের বাংলা অঙ্ক ইত্যাদি তাঁর কাছে অতি তুচ্ছ বলে মনে হয়েছিল। তাঁকে কেবল ইংরাজীই যা পড়তে হত। ফলে সে বছরের শেষে পরীক্ষায় ইংরাজী এবং অন্যান্য বিষয়েও শরৎচন্দ্র এত বেশী নম্বর পেয়েছিলেন যে, শিক্ষকমশায়রা তাঁকে ডবল প্রমোশন দিয়েছিলেন। অর্থাৎ শরৎচন্দ্র ১৮৮৮ খ্রীষ্টাব্দে সেকালের সেভেন্থ্ ক্লাস থেকে সিকস্থ্ ক্লাস টপকে একেবারে ফিপ্থ্ ক্লাসে উঠেছিলেন। তখনকার দিনে স্কুলের নীচের দিক থেকে এইভাবে ক্লাস গণনা হত-নাইন্থ্ ক্লাস, এইট্থ্ ক্লাস, সেভেন্থ্ ক্লাস, সিকস্থ্ ক্লাস, ফিফ্থ্ ক্লাস, ফোরথ্ ক্লাস, থার্ড ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস ও ফার্স্ট ক্লাস। ফার্স্ট ক্লাস হল বর্তমানের ক্লাস টেন বা দশম শ্রেণী। ১৮৮৯ খ্রীষ্টাব্দে শরৎচন্দ্র জেলা স্কুলের ফোরথ্ ক্লাসে উঠলেন, সেই সময় তাঁর পিতার ডিহিরির চাকরিটিও চলে যায়। শরৎচন্দ্রের পিতা তখন পরিবারবর্গকে নিয়ে আবার দেবানন্দপুরে ফিরে আসেন। শরৎচন্দ্র বাবা-মা’র সঙ্গে দেবানন্দপুরে এসে ঐ বছরই অর্থাৎ ১৮৮৯ খ্রীষ্টাব্দেই জুলাই মাসে হুগলী ব্রাঞ্চ স্কুলের ফোরথ্ ক্লাসে ভর্তি হলেন। ১৮৯২ খ্রীষ্টাব্দে শরৎচন্দ্র ফার্স্ট ক্লাসে পড়ার সময় তাঁর পিতা অভাবের জন্য আর স্কুলের মাহিনা দিতে পারলেন না, ফলে শরৎচন্দ্র পড়া ছেড়ে দিয়ে ঘরে বসে রইলেন। শরৎচন্দ্র এই সময় সতের বছর বয়সে সর্বপ্রথম পাঠশালার সহপাঠী কাশীনাথের নাম নিয়ে ‘কাশীনাথ’ নামে একটি গল্প লেখেন। এছাড়া ‘ব্রহ্মদৈত্য’ নামে আরও একটি গল্প লিখেছিলেন। ব্রহ্মদৈত্য গল্পটি পাওয়া যায় না। দেবানন্দপুরে মতিলালের অভাব ক্রমশ তীব্র হয়ে ওঠায় তিনি তখন বাধ্য হয়ে আবার সপরিবারে ভাগলপুরে শ্বশুরবাড়িতে গেলেন। সেটা তখন ১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দের প্রথম দিক। শরৎচন্দ্র ভাগলপুরে গিয়েই আবার স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রবল আগ্রহান্বিত হলেন। কিন্তু শরৎচন্দ্রের আগ্রহ হলে কি হবে! হুগলী ব্রাঞ্চ স্কুলের বকেয়া মাহিনা মিটিয়ে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট আনার টাকা কোথায়? ১৮৯২ খ্রীষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে তাঁর মাতামহের মৃত্যু হওয়ায় মামার বাড়ির একান্নবর্তী সংসার ভেঙ্গে যায়। শরৎচন্দ্রের নিজের দুই মামার মধ্যে বড়মামা ঠাকুর দাসের তখন চাকরি ছিল না। ছোটমামা বিপ্রদাস সামান্য বেতনে সেই সবে একটা চাকরিতে ঢুকেছেন। তাঁকে একাই তাঁর নিজের, তাঁর দাদা ঠাকুরদাসের এবং ভগ্নীপতি মতিলালের সংসার চালাতে হয়।
সাহিত্যিক ও সাংবাদিক পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় ঐ সময় ভাগলপুরের তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজিয়েট স্কুলে শিক্ষকতা করতেন এবং ভাগলপুরে শরৎচন্দ্রের মামাদের প্রতিবেশী ছিলেন। পাঁচকড়িবাবুর পিতা বেণীমাধব বন্দ্যোপাধ্যায় শরৎচন্দ্রের মাতামহের বন্ধু ছিলেন। তাই শরৎচন্দ্র পাঁচকড়িবাবুকে মামা বলতেন। শরৎচন্দ্রের পড়ার আগ্রহ দেখে পাঁচকড়িবাবুই অবশেষে শরৎচন্দ্রকে তাঁদের স্কুলে ভর্তি করে নিয়েছিলেন।
শরৎচন্দ্র এই তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজিয়েট স্কুল থেকেই পর বৎসর অর্থাৎ ১৮৯৪ খ্রীষ্টাব্দে ফেব্রুয়ারী মাসে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। পরীক্ষার আগে স্কুলে পরীক্ষার ফি এবং ঐ সঙ্গে দেয় ক’ মাসের মাহিনার টাকা জমা দেবার সময়ও শরৎচন্দ্রের ছোটমামা বিপ্রদাসকে স্থানীয় মহাজন গুলজারীলালের কাছে হ্যান্ডনোট লিখে টাকা ধার করতে হয়েছিল। শরৎচন্দ্রের মাতামহের কনিষ্ঠ ভ্রাতা অঘোরনাথের জ্যেষ্ঠপুত্র মনীন্দ্রনাথও ঐ বছর এন্ট্রান্স পাস করেন। এন্ট্রান্স পাস করে মণীন্দ্রনাথ তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজে ভর্তি হলেন। কিন্তু টাকার অভাবে শরৎচন্দ্রের আর ভর্তি হওয়া হল না। অভাবের জন্যই বিপ্রদাস শরৎচন্দ্রকে কলেজে ভর্তি করাতে পারলেন না। শরৎচন্দ্রের পড়া হবে না দেখে মণীন্দ্রনাথের মা কুসুমকামিনী দেবীর বড় মায়া হল। তিনি তাঁর স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করে, তাঁদের দুই ছোট ছেলেকে পড়াবার বিনিময়ে শরৎচন্দ্রের কলেজে ভর্তি হওয়ার এবং কলেজে প্রতি মাসে মাহিনা দেওয়ার ব্যাবস্থা করে দিলেন। এর ফলে শরৎচন্দ্র কলেজে ভর্তি হতে সক্ষম হলেন। শরৎচন্দ্র রাত্রে মণীন্দ্রনাথের ছোট দু ভাই সুরেন্দ্রনাথ ও গিরীন্দ্রনাথকে পড়াতেন। এরাঁ তখন স্কুলের নীচের ক্লাসে পড়তেন। এঁরা ছাড়া বাড়ির অন্য ছোট ছেলেরাও তাঁর কাছে অমনি পড়ত। কলেজে পড়ার সময় শরৎচন্দ্র টাকার অভাবে কলেজের পাঠ্য বইও কিনতে পারেন নি। তিনি মণীন্দ্রনাথের এবং সহপাঠী অন্যান্য বন্ধুদের কাছ থেকে বই চেয়ে এনে রাত জেগে পড়তেন এবং সকালেই বই ফেরৎ দিয়ে আসতেন। কলেজে এইভাবে দু বছর পড়েও টেস্ট পরীক্ষার শেষে এফ.এ.পরীক্ষার ফি মাত্র কুড়ি টাকা জোগাড় করতে না পারায়, শরৎচন্দ্র আর এফ.এ. পরীক্ষাই দিতে পারলেন না। ঠিক এই সময়টায় শরৎচন্দ্র অবশ্য মামার বাড়িতে ছিলেন না। কারণ ১৮৯৫ খ্রীস্টাব্দের নভেম্বর মাসে শরৎচন্দ্রের মাতার মৃত্যু হওয়ায় তার কিছুদিন পরেই শরৎচন্দ্রের পিতা মতিলাল শ্বশুরালয় ছেড়ে পুত্রকন্যাদের নিয়ে মাইল খানেক দূরে ভাগলপুরের খঞ্জরপুর পল্লীতে এসেছিলেন। এখানে মতিলাল খোলার ছাওয়া একটা মাটির ঘরে পুত্রকন্যাদের নিয়ে থাকতেন।জ্যেষ্ঠা কন্যা অনিলা দেবীর ইতিপূর্বে হাওড়া জেলায় বাগনান থানার গোবিন্দপুর গ্রামে বিয়ে হয়েছিল।অনিলা দেবী তাঁর শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন। শরৎচন্দ্র কলেজের পড়া ছেড়ে ভাগলপুরের আদমপুর ক্লাবে মিশে অভিনয় ও খেলাধূলা করে কাটাতে লাগলেন। এবং ভাগলপুরের নির্ভীক, পরোপকারী, মহাপ্রান এক আদর্শ যুবক রাজেন মজুমদারের সঙ্গে মিশে তাঁর পরোপকারমূলক কাজের সঙ্গী হলেন। (শরৎচন্দ্র পরে তাঁর ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে এঁকেই ইন্দ্রনাথরূপে চিত্রিত করে গেছেন) শরৎচন্দ্র এই সময় প্রতিবেশী বিভূতিভূষণ ভট্টদের বাড়িতে মিশে সেখানে নিজের একটা আস্তানা করেছিলেন এবং সেই আস্তানায় বসে দিন-রাত অজস্র গল্প-উপন্যাস লিখতেন এবং পড়তেন। শরৎচন্দ্র এই সময় মাতুল সুরেন্দ্রনাথ, গিরীন্দ্রনাথ ও উপেন্দ্রনাথ (মাতামহের তৃতীয় ভ্রতার পুত্র), এঁদের বন্ধু যোগেশচন্দ্র মজুমদার এবং প্রতিবেশী বিভূতিভূষণ ভট্ট ও তাঁর ছোট বোন নিরুপমা দেবী প্রভৃতিকে নিয়ে একটা সাহিত্য সভাও গঠন করেছিলেন। সপ্তাহে একদিন করে সাহিত্য সভার অধিবেশন হত।সেদিন সভায় সভ্যরা যে যাঁর লেখা পড়তেন। নিরুপমা দেবী সভায় যেতেন না। তিনি তাঁর দাদা বিভূতিবাবুর হাত দিয়ে লেখা পাঠিয়ে দিতেন। সাহিত্য সভার ‘ছায়া’ নামে হাতে-লেখা একটা মুখপত্রও ছিল। শরৎচন্দ্র এই সময়েই তাঁর বড়দিদি, দেবদাস, চন্দ্রনাথ, শুভদা প্রভৃতি উপন্যাস এবং অনুপমার প্রেম, আলো ও ছায়া, বোঝা, হরিচরণ প্রভৃতি গল্পগুলি রচনা করেছিলেন। শরৎচন্দ্রের পিতা দেবানন্দপুরের ঘরবাড়ি সমস্ত বিক্রি করে এর-ওর কাছে চেয়ে চিন্তে কোন রকমে সংসার চালাতেন। শরৎচন্দ্র এই সময় বনেলী রাজ এস্টেটে অল্প কিছু-দিনের জন্য একটা চাকরি করেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ একদিন পিতার উপর অভিমান করে সব ছেড়ে নিরুদ্দেশ হন এবং সন্ন্যাসী সেজে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতে থাকেন। এই ঘুরে বেড়াবার সময় যখন তিনি মজঃফরপুরে আসেন, তখন একদিন তাঁর পিতার মৃত্যু সংবাদ জানতে পারেন।এই জেনেই তিনি ভাগলপুরে এলেন। এসে কোন রকমে পিতার শ্রাদ্ধ সম্পন্ন করে ছোটভাই-দুটিকে আত্মীয়দের কাছে এবং ছোট বোনটিকে বাড়ির মালিক মহিলাটির কাছে রেখে (শরৎচন্দ্রের ছোটমামা পরে একে নিজের কাছে নিয়ে এসেছিলেন এবং তিনিই এঁর বিয়েও দিয়েছিলেন) ভাগ্য অন্বেষণে কলকাতায় এলেন। কলকাতায় এসে তিনি উপেন মামার দাদা কলকাতা হাইকোর্টের উকিল লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে ওঠেন এবং তাঁর কাছেই ৩০ টাকা মাহিনায় হিন্দী পেপার বুকের ইংরাজী তর্জমা করার একটা চাকরি পান। শরৎচন্দ্র লালমোহনবাবুর বাড়িতে মাস-ছয়েক ছিলেন। এর পর (জানুয়ারী ১৯০৩) এখান থেকে বর্মায় চলে যান। বর্মায় গিয়ে লালমোহনবাবুর ভগ্নীপতি রেঙ্গুনের অ্যাডভোকেট অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে ওঠেন। শরৎচন্দ্র রেঙ্গুন যাওয়ার দু-একদিন আগে কলকাতার বৌবাজারে সুরেন মামা ও গিরীন মামার সঙ্গে দেখা করতে গেলে (এঁরা দুজনেই কলকাতায় কলেজে পড়তেন) গিরীন মামার অনুরোধে বসে সঙ্গে সঙ্গেই একটা গল্প লিখে কুন্তলীন প্রতিযোগিতায় পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু গল্পটিতে নিজের নাম না দিয়ে সুরেনবাবুর নাম দিয়েছিলেন। গল্পটির নাম ‘মন্দির’। দেড়শ গল্পের মধ্যে ‘মন্দির’ সর্বশ্রেষ্ঠ বিবেচিত হয়েছিল।
শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনে গেলে কিছুদিন পরে মেসোমশায় অঘোরবাবু বর্মা রেলওয়ের অডিট অফিসে তাঁর একটা অস্থায়ী চাকরি করে দেন। বছর দুই পরে হঠাৎ অঘোরবাবুর মৃত্যু হয়। তখন তাঁর পরিবারবর্গ রেঙ্গুন ছেড়ে দেশে চলে আসেন। এই সময় শরৎচন্দ্রের রেলের অডিট অফিসের চাকরিটিও চলে যায়। শরৎচন্দ্র তখন তাঁর রেঙ্গুনের এক বন্ধু গিরীন্দ্রনাথ সরকারের সঙ্গে পেগুতে যান। পেগু রেঙ্গুন থেকে ৪৫ মাইল উত্তরে। পেগুতে গিয়ে তিনি গিরীনবাবুর বন্ধু অবিনাশ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে অনেক দিন ছিলেন। অবিনাশবাবুর বাড়ি ছিল শরৎচন্দ্রের জন্মস্থান দেবানন্দপুরের অদূরে বৈদ্যবাটীতে। তাই অবিনাশবাবু সেই বিদেশে শরৎচন্দ্রকে নিজের দেশের লোক হিসাবে খুবই আদর-যত্নে রেখেছিলেন। অবিনাশবাবুর বাড়িতে থাকাকালে বর্মার পাবলিক ওয়ার্কস একাউন্টস অফিসের ডেপুটি একজামিনার মণীন্দ্রকুমার মিত্রের সঙ্গে শরৎচন্দ্রের একদিন পরিচয় হয়। মণিবাবু শরৎচন্দ্রকে বেকার জেনে পরে ১৯০৬ খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে নিজের অফিসে তাঁর একটা চাকরি করে দেন।শরৎচন্দ্র এই চাকরি পেয়েই পেগু থেকে রেঙ্গুনে চলে আসেন। এই চাকরি পাওয়ার আগে শরৎচন্দ্র মাঝে নাঙ্গলবিনে কিছুদিন এক ধানের ব্যাবসায়ীর সঙ্গে কাজ করেছিলেন। শরৎচন্দ্র মণিবাবুর দেওয়া এই চাকরিই ১৯১৬ খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিল পর্যন্ত করেছিলেন।১৯১২-তে শরৎচন্দ্রের অফিস বর্মার একাউন্টেন্ট জেনারেল অফিসের সঙ্গে মিলিত হয়েছিল। শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনে থাকার সময় বেশির ভাগ সময়টাই থেকেছেন শহরের উপকণ্ঠে বোটাটং-পোজনডং অঞ্চলে। এখানে শহরের কলকারখানার মিস্ত্রীরাই প্রধানত থাকত। শরৎচন্দ্র মিস্ত্রীদের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা করতেন। তিনি তাদের চাকরির দরখাস্ত লিখে দিতেন, বিবাদ-বিসংবাদ মিটিয়ে দিতেন, অসুখে বিনামূল্যে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতেন, বিপদে সাহায্যও করতেন। মিস্ত্রীরা শরৎচন্দ্রকে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভক্তি করত এবং দাদাঠাকুর বলে ডাকত। শরৎচন্দ্র এদের নিয়ে একটা সঙ্কীর্তনের দলও করেছিলেন। শরৎচন্দ্র মিস্ত্রীপল্লীতে থাকার সময় তাঁর বাসার নীচেই চক্রবর্তী উপাধিধারী এক মিস্ত্রী থাকত। ঐ মিস্ত্রীর শান্তি নামে একটি কন্যা ছিল। চক্রবর্তী এক প্রোঢ় ও মাতাল মিস্ত্রীর সঙ্গে তার কন্যার বিয়ের ব্যাবস্থা করে। চক্রবর্তীর কন্যার কিন্তু এই বিবাহে ঘোর আপত্তি থাকে, তাই চক্রবর্তীর কন্যা একদিন তাকে ঐ বিপদে রক্ষা করবার জন্য শরৎচন্দ্রের পায়ে পড়ে তাঁকে অনুরোধ করে। তখন শরৎচন্দ্র বাধ্য হয়ে নিজেই তাকে বিয়ে করেছিলেন। শরৎচন্দ্র স্ত্রী শান্তি দেবীকে নিয়ে বেশ সুখেই ছিলেন। তাঁদের একটি পুত্রও হয়। পুত্রের বয়স যখন এক বৎসর, সেই সময় রেঙ্গুনেই প্লেগে আক্রান্ত হয়ে শান্তি দেবী এবং শিশুপুত্র উভয়েরই মৃত্যু হয়। স্ত্রী ও পুত্রকে হারিয়ে শরৎচন্দ্র তখন গভীর শোকাহত হয়েছিলেন। শান্তি দেবীর মৃত্যুর অনেকদিন পরে শরৎচন্দ্র ঐ রেঙ্গুনেই দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন। বিবাহের সময় পর্যন্ত শরৎচন্দ্রের এই দ্বিতীয়া স্ত্রীর নাম ছিল মোক্ষদা। বিবাহের পর শরৎচন্দ্র তাঁর মোক্ষদা নাম বদলে হিরণ্ময়ী নাম দিয়েছিলেন এবং তখন থেকে তাঁর এই নামই প্রচলিত হয়। বিয়ের সময় হিরণ্ময়ী দেবীর বয়স ছিল ১৪। হিরণ্ময়ী দেবীর বাবার নাম কৃষ্ণদাস অধিকারী। তাঁর মূল বাড়ি মেদনীপুর জেলায় শালবনীর নিকটে শ্যামচাঁদপুর গ্রামে। কৃষ্ণবাবু তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর আট বছরের কনিষ্ঠা কন্যা মোক্ষদাকে সঙ্গে নিয়ে ভাগ্যান্বেষণে এক মিস্ত্রী বন্ধুর কাছে রেঙ্গুনে এসেছিলেন। তাঁর পুত্র ছিল না। ক্ষীরোদা, সুখদা ও অপর একটি কন্যার আগেই বিয়ে দিয়েছিলেন। হিরণ্ময়ী দেবী যখন রেঙ্গুনের মিস্ত্রীপল্লীতে তাঁর বাবার কাছে থাকতেন, সেই সময় শরৎচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর বাবার বিশেষ পরিচয় হয়। এই বিশেষ পরিচয়ের জোরেই হিরণ্ময়ী দেবীর বাবা একদিন সকালে কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে শরৎচন্দ্রকে অনুরোধ করে করে বলেন-আমার মেয়েটির এখন বিয়ের বয়স হয়েছে। একে সঙ্গে নিয়ে একা বিদেশ বিভুঁইয়ে কোথায় থাকি! আপনি যদি অনুগ্রহপূর্বক আমার এই কন্যাটিকে গ্রহন করে আমায় দায়মুক্ত করেন তো বড় উপকার হয়। আর একান্তই যদি না নিতে চান তো, আমায় কিছু টাকা দিন। আমি মেয়েকে নিয়ে দেশে ফিরে যাই। দেশে গিয়ে মেয়ের বিয়ে দিই। কৃষ্ণবাবু শেষে শরৎচন্দ্রের কাছে টাকার কথা বললেও, তিনি বিশেষ করে শরৎচন্দ্রকে অনুরোধ করেন, যেন তিনিই তাঁর কন্যাটিকে গ্রহণ করেন। শরৎচন্দ্র প্রথমে অরাজী হলেও কৃষ্ণবাবুর অনুরোধে শেষ পর্যন্ত তাঁর কন্যাকে বিয়ে করেন। হিরণ্ময়ী দেবী নিঃসন্তান ছিলেন। বিয়ের সময় পর্যন্ত হিরণ্ময়ী দেবী লেখাপড়া জানতেন না। পরে শরৎচন্দ্র তাঁকে লিখতে ও পড়তে শিখিয়েছিলেন। হিরণ্ময়ী দেবী ছেলেবেলা থেকেই শান্তস্বভাবা, সেবাপরায়ন ও ধর্মশীলা ছিলেন। শরৎচন্দ্র তাঁকে নিয়ে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সুখে শান্তিতেই কাটিয়ে গেছেন।
শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনে চাকরি করার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে প্রচুর পড়াশুনা, গান-বাজনা এবং সাহিত্য-চর্চাও করতেন। প্রথম দিকে অনেক দিন ছবিও এঁকেছেন। মিস্ত্রী-পল্লীতে বোটাটং-এর ল্যান্সডাউন স্ট্রীটে যখন তিনি একটা কাঠের বাড়ির দুতলায় থাকতেন, সেই সময় ১৯১২ খ্রীষ্টাব্দের ৫ই ফেব্রুয়ারী তারিখে তাঁর বাসার নীচের তলায় আগুন লাগে। সেই আগুনে তাঁর কয়েটি বইয়ের পান্ডুলিপি, কিছু অয়েল পেন্টিং এবং এক সাহেবের কাছ থেকে কেনা একটি লাইব্রেরী-সমেত তাঁর বাসাটিও পুড়ে ছাই হয়ে যায়। রেঙ্গুনে থাকাকালে ১৯১২ খ্রীষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে শরৎচন্দ্র একবার অফিসে এক মাসের ছুটি নিয়ে দেশে আসেন। এই সময় মাতুল উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের মারফত যমুনা-সম্পাদক ফণীন্দ্রনাথ পালের সঙ্গে একদিন তাঁর পরিচয় হয়। পরিচয় হলে ফণীবাবু তাঁর কাগজে লিখবার জন্য শরৎচন্দ্রকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেন। শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনে গিয়ে লেখা পাঠিয়ে দেবেন বলে কথা দেন। ঐ কথা অনুযায়ী শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনে গিয়ে তাঁর ‘রামের সুমতি’ গল্পটি পাঠিয়ে দেন। ফণীবাবু এই গল্প তাঁর কাগজে ১৩১৯ সালের ফাল্গুন ও চৈত্র সংখ্যায় প্রকাশ করেন। রামের সুমতি যমুনায় প্রকাশিত হলে শরৎচন্দ্র এক গল্প লিখেই একজন মহাশক্তিশালী লেখক হিসাবে সাহিত্যিক ও পাঠক মহলে পরিচিত হন। ইতিপূর্বে ১৩১৪ সালে ভারতী পত্রিকায় শরৎচন্দ্রের ‘বড়দিদি’ প্রকাশিত হয়েছিল। তখন অনেকের মত রবীন্দ্রনাথও এই লেখা পড়ে শরৎচন্দ্রকে প্রতিভাবান লেখক বলে বুঝেছিলেন। বিভূতিভূষণ ভট্টর সতীর্থ সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় ভাগলপুরে শরৎচন্দ্রের লেখার খাতা থেকে ‘বড়দিদি’ নকল করে এনেছিলেন এবং পরে শরৎচন্দ্রকে না জানিয়ে এটি ভারতীতে প্রকাশ করেছিলেন। ‘রামের সুমতি’ প্রকাশিত হলে তখন নবপ্রকাশিত ভারতবর্ষ এবং সাহিত্য প্রভৃতি পত্রিকার কর্তৃপক্ষও তাঁদের কাগজের জন্য শরৎচন্দ্রের কাছে লেখা চাইতে থাকেন। শরৎচন্দ্র যমুনার সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষেও লিখতে আরম্ভ করেন।শেষে যমুনা ছেড়ে কেবল ভারতবর্ষেই লিখতে থাকেন এবং ভারতবর্ষ পত্রিকার মালিক গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স তাঁর বইও প্রকাশ করতে শুরু করেন। যমুনা-সম্পাদক ফণী পালই অবশ্য প্রথম তাঁর ‘বড়দিদি’ উপন্যাসটি প্রকাশ করেছিলেন। ঐ সময় ফণীবাবুর বন্ধু সুধীর চন্দ্র সরকারও তাঁদের দোকান এম.সি. সরকার এন্ড সন্স থেকে শরৎচন্দ্রের পরিণীতা, পণ্ডিতমশাই প্রভৃতি কয়েকটি বই প্রকাশ করেন। ১৯১৬ খ্রীস্টাব্দের গোড়ার দিকে শরৎচন্দ্র হঠাৎ দুরারোগ্য পা-ফোলা রোগে আক্রান্ত হন। তখন তিনি স্থির করেন অফিসে এক বছরের ছুটি নিয়ে কলকাতায় এসে কবিরাজী চিকিৎসা করাবেন। অফিসে শেষ দিনে ছুটি চাইতে যাওয়ায় উপরওয়ালা সাহেবের সঙ্গে ঝগড়া হয়। ফলে শরৎচন্দ্র চাকরিতে ইস্তফা দিয়েই বরাবরের জন্য রেঙ্গুনে ছেড়ে দেশে চলে আসেন। শরৎচন্দ্র তাঁর রেঙ্গুন-জীবনের শেষ দিকে আর মিস্ত্রীপল্লীতে থাকতেন না। এই সময় প্রথমে কিছুদিন ছিলেন ৫৭/৯ লুইস স্ট্রীটে। তারপর ছিলেন ৫৪/৩৬ স্ট্রীটে ।
শরৎচন্দ্র রেঙ্গুন থেকে সস্ত্রীক এসে প্রথমে হাওড়া শহরে ৬নং বাজে শিবপুর ফার্স্ট বাই লেনে ওঠেন। এ বাড়িতে তিনি প্রায় ৮ মাস ছিলেন। তারপর এ বাড়ি ছেড়ে তিনি পাশেই ৪নং বাজে শিবপুর ফার্স্ট বাই লেনে যান। ঐ বাড়িতে তিনি প্রায় ৯ বছর ছিলেন। তারপর এখান থেকে শিবপুর ট্রাম ডিপোর কাছে ৪৯/৪ কালীকুমার মুখার্জী লেনে গৌরীনাথ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি ভাড়া নিয়ে বছরখানেক ছিলেন। এইখানে থাকার সময়েই তিনি তাঁর দিদিদের গ্রাম হাওড়া জেলার বাগনান থানার গোবিন্দপুরের পাশেই সামতাবেড়েয় জায়গা কিনে একটা সুন্দর মাটির বাড়ি তৈরি করান। বাড়িটি একেবারেই রূপনারায়ণের গায়েই। শরৎচন্দ্র ১৯২৬ খ্রীস্টব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে হাওড়া শহর ছেড়ে তাঁর সামতাবেড়ের বাড়িতে চলে যান। শরৎচন্দ্রের মেজভাই প্রভাস রামকৃষ্ণ মিশনে যোগ দিয়ে সন্ন্যাসী হয়েছিলেন। সন্ন্যাস জীবনে তাঁর নাম হয়েছিল স্বামী বেদানন্দ। শরৎচন্দ্র রেঙ্গুন থেকে ফিরে ছোটভাই প্রকাশকে এনে কাছে রাখেন। পরে বিয়ে দিয়ে তাঁকে সংসারী করে দেন। প্রকাশবাবুর এক কন্যা ও এক পুত্র। হাওড়ায় বাজে শিবপুরে থাকার সময়েই শরৎচন্দ্র তাঁর বহু গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তাই ঐ সময়টাকেই তাঁর সাহিত্যিক জীবনের স্বর্ণযুগ বলা যেতে পারে। এই বাজে শিবপুরে থাকাকালেই ১৯২১ খ্রীস্টাব্দে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে তিনি তখন দেশবন্ধুর আহ্বানে কংগ্রেসে যোগ দেন এবং তিনি হাওড়ায় থাকতেন বলে দেশবন্ধু তাঁকে হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি করেন । ১৯২১ থেকে ১৯৩৬ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত একটানা দীর্ঘ ১৬ বছ র তিনি হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। মাঝে ১৯২২ খ্রীস্টাব্দে তিনি একবার হাওড়া কংগ্রেসের সভাপতির পদত্যাগ করতে চাইলে দেশবন্ধু তা করতে দেননি। শরৎচন্দ্র অহিংস কংগ্রসের একজন ছোটখাট নেতা হলেও বরাবরই কিন্তু ভারতের মুক্তি আন্দোলনের সশস্ত্র সংগ্রামী বা সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতেন। বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স বা সংক্ষেপে বি ভি দলের সর্বাধিনায়ক প্রখ্যাত বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষ, কাকোরী ষড়যন্ত্র মামলার আসামী বিপ্লবী শচীন সান্যাল প্রমুখ ছাড়াও বারীন ঘোষ, উপেন বন্দোপাধ্যায়, চারু রায়, অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিপিন গাঙ্গুলী প্রমুখ খ্যাতনামা বিপ্লবীদের সঙ্গেও তাঁর যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল। বিপিনবাবু সম্পর্কে শরৎচন্দ্রের মামা হতেন। শরৎচন্দ্র বহু বিপ্লবীকে নিজের রিভলবার, বন্দুকের গুলী এবং অর্থ দিয়েও সাহায্য করতেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের নায়ক মহাবিপ্লবী সূর্য সেনকেও তিনি তাঁর বৈপ্লবিক কাজের জন্য অর্থ সাহায্য করেছিলেন। শরৎচন্দ্র হাওড়ার বাজে শিবপুরে থাকার সময়েই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ পরিচয় হয়। পরিচয় হয়েছিল জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রনাথের বাড়িতে বিচিত্রার আসরে। শরৎচন্দ্রের বাল্যবন্ধু ঔপন্যাসিক চারু বন্দোপাধ্যায় শরৎচন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে কবির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে শরৎচন্দ্র বিচিত্রার আসরে ১৩২৪ সালের ১৪ই চৈত্র তারিখে তাঁর বিলাসী গল্পটি পড়েছিলেন। পরে নানা সূত্রে এঁদের উভয়ের মধ্যে আরও ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। শরৎচন্দ্র নানা প্রয়োজনে একাধিকবার শান্তিনিকেতনে ও জোড়াসাঁকোয় কবির কাছে গেছেন। শরৎচন্দ্র শেষ বয়সে কলকাতায় বাড়ি করলে সেখানে অনুষ্ঠিত এক সভায় কবি একবার শরৎচন্দ্রের বাড়িতেও গিয়েছিলেন। কবির সত্তর বছর বয়সের সময় দেশবাসী যখন কলকাতার টাউন হলে তাঁকে অভিনন্দন জানায় সেই অভিনন্দন সভার বিখ্যাত মানপত্রটি রচনা করেছিলেন শরৎচন্দ্র। কবিও নিজে একবার শরৎচন্দ্রকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। শরৎচন্দ্র হাওড়া শহর ছেড়ে সামতাবেড়ে যখন থেকে বাস করতে থাকেন, তখন থেকে ঐ অঞ্চলের দরিদ্র লোকদের অসুখে চিকিৎসা করা তাঁর একটা কাজই হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রোগী দেখে তিনি শুধু ওষুধই দাতব্য করতেন না, অনেকের পথ্যও কিনে দিতেন। হাওড়া শহরে থাকার সময় সেখানেও তিনি এই-রকম করতেন। শরৎচন্দ্র সামতাবেড় অঞ্চলের বহু দুঃস্থ পরিবারকে বিশেষ করে অনাথ বিধবাদের মাসিক অর্থসাহায্য করতেন। শরৎচন্দ্র সামতাবেড়ে থাকার সময় অল্প তিন-চারটি মাত্র গ্রন্থ রচনা করতে পেরেছিলেন। শরৎচন্দ্র সামতাবেড়ে থাকার সময় শেষ দিকে কলকাতার বালীগঞ্জে একটা বাড়ি তৈরি করিয়েছিলেন। এটি তৈরি হয়েছিল ১৯৩৪ খ্রীস্টাব্দে। বাড়িটি দোতালা এবং দেখতে সুন্দর। এই বাড়ির ঠিকানা হল – ২৪ অশ্বিনী দত্ত রোড। কলকাতায় বাড়ি হলে তিনি কখন কলকাতায়, আবার কখন সামতাবেড়ে – এইভাবে কাটাতেন। কলকাতায় থাকাকালে কলকাতার তখনকার সাহিত্যিক ও শিল্পীদের দুটি নাম-করা প্রতিষ্ঠান রবিবাসর ও রসচক্রের সদস্যরা তাঁকে আমন্ত্রণ করে তাঁদের অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতেন। এঁরা কখন কখন শরৎচন্দ্রকে সম্বর্ধনাও জানিয়েছেন। রসচক্রের সদস্যরা শরৎচন্দ্রকে তাঁদের প্রতিষ্ঠানের সভাপতি করেছিলেন। ১৯৩৬ খ্রীস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শরৎচন্দ্রকে ডি.লিট. উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন। এর আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে জগত্তারিণী পদক উপহার দিয়েছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে একবার বি.এ. পরীক্ষায় বাংলার পেপারসেটার বা প্রশ্নকর্তাও নিযুক্ত করেছিলেন। এসব ছাড়া, দেশবাসীও তাঁকে তখন ‘অপরাজেয় কথাশিল্পী,’ ‘সাহিত্য সম্রাট’ এই আখ্যায় বিভূষিত করেছিলেন।বৈদ্যবাটী যুব সংঘ, শিবপুর সাহিত্য সংসদ, যশোহর সাহিত্য সংঘ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের ও সাধারণভাবে দেশবাসীর পক্ষ থেকে একাধিকবার তাঁকে সম্বর্ধনা জানান হয়।
শরৎচন্দ্র কেবল গায়ক, বাদক, অভিনেতা ও চিকিৎসকই ছিলেন না, তাঁর চরিত্রে আরও অনেকগুলি গুণ ছিল। তাঁর চরিত্রের যে বৈশিষ্ট্যটি সবার আগে চোখে পড়ে, তা হল- মনেপ্রাণে তিনি ছিলেন একজন দরদী মানুষ। মানুষের, এমন কি জীবজন্তুর দুঃখ-দুর্দশা দেখলে বা তাদের দুঃখের কাহিনী শুনলে, তিনি অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়তেন। অনেক সময় এজন্য তাঁর চোখ দিয়ে জলও গড়িয়ে পড়ত। পুরুষ-শাসিত সমাজে পুরুষ অপেক্ষা নারীর প্রতিই তাঁর দরদ ছিল বেশী। আবার সমাজের নিষ্ঠুর অত্যাচারে সমাজপরিত্যক্তা, লাঞ্ছিতা ও পতিতা নারীদের প্রতি তাঁর করুণা ছিল আরও বেশী। পতিতা নারীদের ভুল পথে যাওয়ার জন্য তিনি হৃদয়ে একটা বেদনাও অনুভব করতেন। জীবজন্তুর প্রতি স্নেহবশতঃ শরৎচন্দ্র বহু বছর সি.এস.পি.সি.এ. অর্থাৎ কলকাতা পশুক্লেশ নিবারণী সমিতির হাওড়া শাখার চেয়ারম্যান ছিলেন। এক সময় অবশ্য তিনি একজন ছোটখাট শিকারীও ছিলেন। তখন ছিপ দিয়ে মাছ ধরতে এবং বন্দুক নিয়ে পাখি শিকার করতে তিনি বিশেষ পটু ছিলেন। পরে এসব ছেড়ে দেন। তিনি বরাবরই দক্ষ সাঁতারু ছিলেন। সাপুড়েদের মত অতি অনায়াসেই বিষধর সাপও ধরতে পারতেন। আর তিনি ছিলেন অসাধারণ অতিথিপরায়ণ, বন্ধুবৎসল পত্নীপ্রেমিক।বিলাসী না হলেও কিছুটা সৌখিন ছিলেন- বিশেষ করে বেশভূষায় ও লেখার ব্যাপারে। তিনি ঘরোয়া বৈঠকে খুব গল্প করতে পারতেন। বন্ধুদের সঙ্গে বেশ পরিহাস-রসিকতা করতেন। আত্ম-প্রচারে সর্বদাই বিমুখ ছিলেন এবং নিজের স্বার্থের জন্য কাউকে কিছু বলা কখন পছন্দ করতেন না।
শরৎচন্দ্রের জীবনের শেষ ক’বছর শরীর আদৌ ভাল যাচ্ছিল না। একটা-না-একটা রোগে ভুগছিলেনই। ১৯৩৭ খ্রীস্টাব্দের গোড়ার দিকে তিনি কিছুদিন জ্বরে ভোগেন। জ্বর ছাড়লে ডাক্তারের উপদেশে দেওঘর বেড়াতে যান। সেখানে তিন-চার মাস থাকেন। দেওঘর থেকে এসে কিছুদিন সুস্থ থাকার পর শরৎচন্দ্র সেপ্টেম্বর মাসে আবার অসুখে পড়লেন। এবার তাঁর পাকাশয়ের পীড়া দেখা দেয় এবং দেখতে দেখতে এই রোগ ক্রমেই বেড়ে যেতে লাগল। যা খান আদৌ হজম হয় না। তার উপর পেটেও যন্ত্রণা দেখা দেয়। শরৎচন্দ্র এই সময় সামতাবেড়ে গ্রামের বাড়িতে থাকতেন। চিকিৎসা করাবার জন্য কলকাতার বাড়িতে এলেন। কলকাতায় ডাক্তাররা এক্স-রে করে দেখলেন, শরৎচন্দ্রের যকৃতে ক্যানসার ত হয়েইছে, অধিকন্তু এই ব্যাধি তাঁর পাকস্থলীও আক্রমণ করেছে। এই সময় শরৎচন্দ্র একটি উইল করেন। উইলে তিনি তাঁর যাবতীয় স্থাবর ও অস্থাবর সম্পতি স্ত্রী হিরণ্ময়ী দেবীকে জীবনস্তত্বে দান করেন। হিরণ্ময়ী দেবীর মৃত্যর পর কনিষ্ঠ ভ্রাতা প্রকাশচন্দ্রের পুত্র বা পুত্ররা সমস্থ সম্পতির অধিকারী হবেন, উইলে এ কথাও লেখা হয়।(হিরণ্ময়ী দেবী তাঁর স্বামীর মৃত্যর পর প্রায় ২৩ বছর বেঁচে ছিলেন। তাঁর মৃত্য তারিখ ১৫ই ভাদ্র, ১৩৬৭ বঙ্গাব্দ।) কলকাতার তৎকালীন শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকগন – ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়, ডাঃ কুমুদশঙ্কর রায় প্রভৃতি শরৎচন্দ্রকে দেখে স্থির করলেন যে, শরৎচন্দ্রের পেটে অস্ত্রোপচার ছাড়া আর কোন উপায় নেই। ডাঃ ম্যাকে সাহেবের সুপারিশে শরৎচন্দ্রের চিকিৎসার জন্য তাঁকে বাড়ি থেকে দক্ষিণ কলকাতার ৫নং সুবার্বন হস্পিটাল রোডে একটি ইউরোপীয় নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়া হল। কিন্তু এখানে শরৎচন্দ্রকে তাঁর নেশার জিনিস সিগারেট খেতে না দেওয়ায়, তিনি কষ্ট বোধ করতে লাগলেন। এই নার্সিং হোমে সকালে ও বিকালে দেখা করবার নির্দিষ্ট সময় ছাড়া অন্য সময় কাউকেও শরৎচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে দিত না। তাছাড়া ইউরোপীয় নার্সরা এদেশীয় লোক বলে শরৎচন্দ্রের সঙ্গে নাকি ভাল ব্যাবহার করতেন না। এই সব কারনে শরৎচন্দ্র দুদিন পরে সেখান থেকে চলে এসে তাঁর দূর সম্পর্কীয় আত্মীয় ডাঃ সুশীল চ্যাটার্জীর ৪ নং ভিক্টোরিয়া টেরাসে অবস্থিত ‘পার্ক নার্সিং হোমে’ ভর্তি হলেন। শরৎচন্দ্রের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সংবাদ শুনে রবীন্দ্রনাথ তখন এক পত্রে লিখেছিলেন – ‘‘কল্যাণীয়েষু, শরৎ, রুগ্ন, দেহ নিয়ে তোমাকে হাসপাতালে আশ্রয় নিতে হয়েছে শুনে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হলুম। তোমার আরোগ্য লাভের প্রত্যাশায় বাংলা দেশ উৎকণ্ঠিত হয়ে থাকবে। ইতি ৩১।১২।৩৭’’।
সেই সময়কার বিখ্যাত সার্জন ললিতমোহন বন্দোপাধ্যায় শরৎচন্দ্রের পেটে অপারেশন করেছিলেন।
অপারেশন করেও শরৎচন্দ্রকে বাঁচানো সম্ভব হল না।
অপারেশন হয়েছিল ১২।১।৩৮ তারিখে। এর পর শরৎচন্দ্র মাত্র আর চারদিন বেঁচে ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর দিনটা ছিল রবিবার, ১৯৩৮ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ই জানুয়ারী (বাংলা ১৩৪৪ সালের ২রা মাঘ)। এই দিনই বেলা দশটা দশ মিনিটের সময় শরৎচন্দ্র সকলের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ৬১ বৎসর ৪ মাস। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে শরৎচন্দ্রের মৃত্যুসংবাদ শুনে ইউনাইটেড প্রেসের প্রতিনিধিকে বলেন – ‘‘যিনি বাঙালীর জীবনের আনন্দ ও বেদনাকে একান্ত সহানুভূতির দ্বারা চিত্রিত করেছেন, আধুনিক কালের সেই প্রিয়তম লেখকের মহাপ্রয়াণে দেশবাসীর সঙ্গে আমিও গভীর মর্মবেদনা অনুভব করছি।’’ এর কয়েকদিন পরে ১২ই মাঘ তারিখে কবি আবার শরৎচন্দ্রের মৃত্যু সম্পর্কে এই কবিতাটি লিখেছিলেন –
‘‘যাহার অমর স্থান প্রেমের আসনে।
ক্ষতি তার ক্ষতি নয় মৃত্যুর শাসনে।
দেশের মাটির থেকে নিল যারে হরি
দেশের হৃদয় তারে রাখিয়াছে বরি।’’
(চিত্র পরিচয়: শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্টুডিওতে তোলা একটি দুর্লভ ছবি। সাল অজ্ঞাত। ১৯৭৭ সালে সারা বাংলা শরৎ স্মৃতিরক্ষা কমিটির স্মারক পুস্তিকায় ছবিতে প্রকাশিত হয়েছিল।)
(তথ্যসূত্র:
১- The Life of Sharatchandra Chattopadhyay: Drifter and Dreamer, by Narasingha Sil.
২- The Great Vagabond by Vishnu Prabhakar.
৩- শরৎচন্দ্র প্রসঙ্গ, উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত