ইরাকে নিজের ঘরের কাছে ফুটবল খেলতে গিয়ে ভুল করে গ্রেনেডে লাথি মেরে দেয় দশ বছরের ছেলেটা। পা উড়ে যায় কিন্তু ফুটবল খেলা থামেনি৷ আলি আল জাইদাউই এক পায়ে খেলতে থাকে ‘বিউটিফুল গেম’। যুদ্ধ বিধ্বস্ত শহরে ধুলোমাখা এক টিভি সেটের ওপারে লিওনেল মেসি যখনই পায়ের জাদু দেখায়, আলি নিজের পাকে ফিসফিস করে বলে: “একটা পা দিয়ে ও যুদ্ধ জেতা যায় বুঝলি বোকা”।
আলি ও ওর মতো আরো অনেক ইরাকি ছেলে যাদের হাত বা পা বোমায় উড়ে গেছে, যাদের জীবন থেকে ফুটবলটা ও ছিনিয়ে নিয়েছে যুদ্ধ বিমান, তাদের নিয়ে একটা সিনেমা হয়। “মেসি বাগদাদ” বলে। এরকম একটা ছবি হয়েছে আর এতোগুলো ছেলে এক পায়ে ফুটবল খেলে মেসির জামা পরে, এটুকু শুনেই লিওনেল মেসি ঠিক করে এদের সাথে দেখা করবে। আলি সেদিন এক পায়ে হেঁটে আসে রাজপুত্রের সামনে। রাজপুত্র ওর পা’টা ছুঁয়ে দেখে। দুজন শিশু একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে। স্বপ্নপূরণের ছোট গল্প তো এভাবেই লেখা হয়।
সিরিয়ার মেয়ে নুজিন মুস্তাফা। ১৮ বছর বয়স, সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত, হুইলচেয়ারে ঘোরে। কিন্তু আইসিস এর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে সেই হুইলচেয়ার চেপেই পালিয়ে আসে ইউরোপে নিজের বোনের সাথে শরনার্থী হিসেবে। ব্যাগে সামান্য কিছু জামাকাপড় ছাড়াও লিও’র একটা ময়লা ছবি থাকে সবসময়। লিওনেল মেসির চোখ দেখলে নাকি ওর সমস্ত মনখারাপ দূর হয়ে যায়। লাজুক মেয়ের স্বপ্ন ছিল মেসিকে সামনে থেকে একবার দেখার। ইচ্ছের কথাটা লিওনেল জানতে পারে আর দুই বোনকে খেলা দেখতে চলে আসতে বলে স্পেন। হুইলচেয়ারের সামনে স্বপ্নের পুরুষ এসে হাঁটু মুড়ে বসে, হাত ধরে রাজকুমারীর। রূপকথার গল্প তো এরকমই হওয়ার কথা। ওখানে বোম, আইসিস, সৈনিক, ঘরের আগুন থাকবে কেন?
আফগানিস্তানের গজনি প্রদেশের ছয় বছরের ছেলে মুর্তাজা আহমেদি। গৃহযুদ্ধ, তালিবান রাজ, বিদেশী সেনা, কার্পেট বোম্বিং আর চরম দারিদ্র্য দুর্দশার মাঝে ও একচিলতে আরাম ছিল মেসির খেলা দেখা। কাগজের মন্ড পাকিয়ে ফুটবল খেলতো। প্লাস্টিকের বস্তা কেটে আর্জেন্তিনার নীল-সাদা ১০ নম্বর জার্সিতে মেসির নাম লিখে মাঠে নামতো। ছবিটি ভাইরাল হয়ে যায়। মেসি সেটা জানার পর তাঁর সই করা আর্জেন্তিনা দলের একটি জার্সি উপহার দেয় মোর্তাজা’কে।
এই মোর্তাজা, আলি, নুজিনরাই তো মেসি। দশ নম্বর জার্সি গায়ে রোজ জীবন যুদ্ধ লড়তে যাচ্ছে। লাতিন আমেরিকা হোক বা মধ্যপ্রাচ্যে, এরা সব্বাই মেসির মতো জীবনের ময়দানে ভেলকি দেখিয়ে জিতে যাচ্ছে, টিকে থাকছে। মেসির ঢোলা একটা জার্সি পরে ট্রেনে রোজ যে ছেলেটা হজমিগুলি,লাইটার, সানগ্লাস, ছুড়ি, কাঁচি বিক্রি করে বা যে মেসি ময়লা পরিষ্কার করে ম্যানহোলে নেমে বা রোজ ভোরবেলা শৈল্পিক ভাবে খবরের কাগজটা বারান্দা তাক করে ছুঁড়ে দেয়, এরা সব্বাই একদিন লিওনেল হওয়ার স্বপ্ন দেখে।
হয়তো সেই স্বপ্নে গোলপোস্ট নেই, হয়তো সেই স্বপ্নের রেফারি আরো কড়া, বল পায়ে আরো কম সুযোগ পাওয়া যায় কিন্তু ওরা প্রত্যেকে দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে চলেছে একটা বিউটিফুল লাইফের জন্য। দিনহাটা থেকে দামাস্কাস, সুন্দরবন থেকে সান দিয়াগো। একটা সন্ত্রাসবিহীন সুন্দর ভবিষ্যৎ, মাথার উপর ছাদ, মা রান্না করে দিচ্ছে, বাবা আদর করে বল কিনে দিচ্ছে, পড়াশোনার জন্য ইস্কুল আছে, শোয়ার জন্য বেডরুম, খেলার জন্য স্পোর্টস শ্যু। পৃথিবীর সব মোর্তাজা, আলি, নুজিনরাই লিওনেল মেসিকে দেখে জীবনের ম্যাচটা জেতার সাহস পায়। মেসি মাঠের বাইরে সেই সাহসটা জাস্ট একের পর এক দিয়ে যায় সান্টাক্লজের মতো, উপহার হিসেবে।
আজ সেই ইচ্ছে-পূরণের গাছ, সেই সান্টাক্লজের জন্মদিন। আজ সাহস – স্পর্ধা জুগিয়েছিল যে সেই জামাটির জন্মদিন। ভালো থেকো রাজপুত্র! অক্ষয় থাক ওই ১০নম্বর জার্সি!
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত