শ্যামল মিত্রের মৃত্যুর পর হেমন্ত মুখোপাধ্যায় একটা ভাববার মতো কথা বলেছিলেন, “আমার পরে বাংলা রোম্যান্টিক গানে তো ও-ই ছিল।”
কথাটার সত্যতা নিয়ে খুব যে ভাবার আছে তা নয়, কারণ ১৯৫৫-৫৬ থেকে ১৯৬৫-৬৬ অবধি বাংলা রোম্যান্টিক গানে শ্যামলের জনপ্রিয়তা ছিল হেমন্তর প্রায় সমতুল্য। তখন বাংলা সিনেমায় হেমন্ত একের পর এক রোম্যান্টিক গান দিয়ে যাচ্ছেন, আর নন-ফিল্মিকে রোম্যান্সের জোয়ার ডেকে দিচ্ছেন শ্যামল। কী রকম জোয়ার তাতে পরে আসছি, তার আগে জানা দরকার ভাবার বিষয়টা কী?
ভাবার হল, কী ভাবে হেমন্ত ও শ্যামল বাংলা রোম্যান্টিক গানকে নিজেদের মতো করে দুটো আকার-প্রকার গোত্রে ভাগ করে নিচ্ছিলেন।
এক হল, প্রেমের গান, লাভ সং, যেখানে হেমন্তর বিচরণ।
দুই, যাকে বলা হয় লাভার বয় সং, তরুণ উচ্ছল প্রেমিকের গান, উষ্ণ প্রেমের মিঠে-নোনতা যে গান কখনও প্রিয়ার কণ্ঠ জড়িয়ে, কখনও প্রিয়াকে বিব্রত, রক্তিমাভা করার জন্য দুনিয়াকে শুনিয়ে গাওয়া হয়।
এই দ্বিতীয় ধারার পত্তনই বলা যায় শ্যামলের গায়কিতে। এবং এ গানে তাঁর কোনও চ্যালেঞ্জার কখনও তৈরি হয়নি।
এই লাভার বয় সঙের পাশাপাশি সে সময় তিনি কিন্তু ‘এমন দিন আসতে পারে’, ‘আমি তোমার পাশে যেমন আছি’, ‘যদি ডাকো এপার হতে’-র মতো গভীর অনুরণন ও চোখের জলের প্রেমের গানও রেকর্ড করে গেছেন। কাউকে ভুলতে দেননি যে, ওঁর হিট গানের জয়যাত্রা ১৯৫২-য় সুধীরলাল চক্রবর্তীর মৃত্যুতে ‘স্মৃতি তুমি বেদনা’ গুরুপ্রণাম দিয়ে।
লাভ সং ও লাভার বয় সঙের বিলিতি চেহারাটার দিকে একটু চোখ ফেললে হয়।
ন্যাটকিং কোল, ফ্র্যাঙ্ক সিনাট্রা, জিম রিভজ-রা যে প্রেমের গান গাইতেন তা লাভ সং, আবার এলভিস প্রেসলির একেবারে প্রথম দিকের ‘লাভিং ইউ’, প্যাট বুন-এর ‘ও, ও, বার্নাডিন!’ ও হরেক এ রকম, টোনি ব্রেন্ট-এর ‘সামওয়ান এলস্ ইজ ইন ইওর আর্মজ টুনাইট’, ক্লিফ রিচার্ড-এর প্রায় সবই, অ্যান্ডি উইলিয়ামজ-এর কত কিছু কিংবা এঙ্গেলবার্ট হাম্পারডিঙ্ক-এর ‘প্লিজ রিলিজ মি লেট মি গো’-কে নমুনা করা হত লাভার বয় সঙের। তবে শ্যামল যে প্রেমিকের গানের ধারার সূচনা করলেন তার কোথাও কোনও বিলিতি ছাপ নেই, পুরোটাই তাঁর নিজস্ব ধরন, বলন, গায়ন ও গঠনে ধরা। যা পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের বাঙালিকে বিলকুল পাগল করে ছেড়েছিল।
পঞ্চাশের দশকে শ্যামল যখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে তখন জলসা আলো করার মতো এক রম্য, রোম্যান্টিক উপস্থিতিও ছিল তাঁর। টিকোলো নাক, কোঁকড়া চুল, ভাসা-ভাসা আয়ত চোখ ও আকর্ষক মাজা গায়ের রঙের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্মোহনে কাজ করত একটা গম্ভীর আনুনাসিক কণ্ঠধ্বনি। শচীনদেবের মতো ওঁরও ন্যাজাল টোনের একটা জাদু ছিল আজকালকার বাগবুলিতে ইউএসপি।
হেমন্তর মতো শ্যামলেরও বিপুল সাফল্যের হেতু তাঁর সহজ ও সরল অ্যাপ্রোচ। সুর নিয়ে অনাবশ্যক প্যাঁচ পয়জারে বিশ্বাস ছিল না, রোম্যান্টিক কণ্ঠের রোম্যান্টিকতা যতখানি সম্ভব বাঁচিয়ে রেখে আলতো করে সুর দিয়ে বাণীকে স্পর্শ করতেন। কিন্তু ওঁর গলা ছিল খোলা— যেটা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও উল্লেখ করেছেন— এবং ক্লিফ রিচার্ড, টোনি ব্রেন্ট জাতীয় লাভার বয় সংস্টারদের মতো ক্রুনিং বা শিল্পিত চাপা ধ্বনির চর্চা করতেন না। বড় অনায়াসে লম্বা লম্বা সুরের টান দিতেন এবং ধ্বনির রেশ ধরে রাখতেন, ওঁর গলার মধ্যে কোথাও যেন একটা ভায়োলিন টাচ আসত।
তাঁর খাদের আওয়াজটা ছিল চমৎকার, ওপরের সপ্তকে প্রবেশ ঘটত আনুনাসিক ধ্বনির, এবং দুইয়ে মিলে প্যাথস বা বিষাদ সৃষ্টির সুন্দর ব্যবস্থা হত। প্রেমিকের গানকে এত সরল ভাবে বরাবর গেয়ে গেছেন যে ওঁর চলে যাওয়াকে সে সময় উল্লেখ করা হয়েছিল ‘এক প্রেমিকের প্রস্থান’ বলে।
বাঙালির কাছে এই প্রেমিকটি কেমন ছিলেন তার কয়েকটা ছবি দিই। মধ্য কলকাতার ক্রিক রো পাড়ার বিখ্যাত ভানু বোসের জলসায় শ্যামল ছিলেন স্টার অ্যাট্র্যাকশন নাম্বার ওয়ান। অত্যন্ত রক্ষণশীল বাড়ির সুন্দরী মেয়েরা সারা রাত শাল মুড়ি দিয়ে জলসা শুনত শ্যামলকে শুনবেন ও দেখবেন বলে। তাঁর কালো হিন্দুস্তান ফোর্টিনটা ঘেরাও হয়ে যেত ফ্যানদের দ্বারা।
একবার প্যান্ডেলে ঢুকেছেন, বালিকা-যুবতী-মহিলারা গিয়ে ছেঁকে ধরলেন অটোগ্রাফের জন্য। সাফারি টাইপের জোড়া বুকপকেটের ছাই ছাই গ্যাবার্ডিনের শার্ট পরনে ছিল তাঁর সেদিন। শ্যামল পকেট থেকে ফাউন্টেন পেন বার করে সই করবেন, হঠাৎ কলমটা ছিটকে পড়ল মাটিতে। সেই কলম কুড়োতে তখন পাঁচ যুবতীর মধ্যে ঠেলাঠেলি। ততক্ষণে এক মহিলা নিজের কলমটা ওঁকে দিয়ে বললেন, “আপনি আমারটা দিয়ে সই করুন আর কলমটা রেখে দিন।” শ্যামল লাজুক হেসে বললেন, “আপনারটা দিয়েই লিখছি, কিন্তু রাখছি না। ওটা হয় নাকি?” যা শুনে পাড়ার এক দাদা মন্তব্য করেছিলেন অদূর থেকে, “এই হল কলির কৃষ্ণ।”
শ্যামল মিত্রের মধ্যে সত্যিই একটা কৃষ্ণ-কৃষ্ণ ব্যাপার ছিল। স্টেজে বসলে উনি জানতেন অডিয়েন্স তাঁকে তারিয়ে তারিয়ে দেখত ও গিলে খেত। তাঁর সুরে গান করা ও অনুরাগিণী বনশ্রী সেনগুপ্ত যেমন জানিয়েছেন, “অঙ্গভঙ্গিটঙ্গি কিছু ছিল না। কী সুন্দর মুখ নিচু করে শুধু গানটায় ডুবে থাকতেন স্টেজে বসলে। ওঁর রোম্যান্টিক স্টাইলেরই অঙ্গ ওই ভঙ্গিটা।”
আর অডিয়েন্সকে হাতে নেওয়ার আয়োজনে এক বড় ব্যাপার ছিল গানের সিলেকশন। লম্বা টানের গান দিয়ে আসরের মুখপাত করতেন।
জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় শ্যামল মিত্রকে নিয়ে বলতে গিয়ে ব্যবহার করেছিলেন ‘প্যাকেজ’ শব্দটা। বলেছিলেন, “শ্যামলবাবুর আওয়াজ খুব বড় নয়, কিন্তু খুব সুরেলা। সুর করতেনও খুব ভাল। ওঁর অনেক হিট গানেরই তো সুর ওঁর নিজের। খুব কাজে লাগিয়েছেন ওঁর কণ্ঠের আনুনাসিক ধ্বনি। আর গাইতেনও রোম্যান্টিকালি। ফলে সব মিলিয়ে একটা চমৎকার প্যাকেজ। যা ওঁকে দারুণ সাফল্য দিয়েছে।”
এই প্যাকেজিং ছাড়াও শ্যামল মিত্রের সাফল্যে আরও যে দুটি ব্যাপারের প্রবল প্রভাব— তাঁর অপূর্ব জিনিয়াস ও এলিগ্যান্স— সেই প্রতিভা ও চারুতা নিয়ে তাঁর ভক্তরা ভাবার সুযোগই পাননি ১৯৮৭-তে মাত্র আটান্ন (মতান্তরে উনষট্টি) বছরে ওঁর অকালমৃত্যুর আগে। কী অবলীলায় যে কত লোকাশ্রয়ী, রাগাশ্রয়ী গান গেয়েছেন ও সুর করেছেন, কিন্তু এতটাই নির্দর্প, নির্ভার স্বাক্ষরে যে সে গানের পিছনের তালিম নিয়ে কেউ ভাবার কথাও ভাবেনি।
সুধীরলাল চক্রবর্তীর কাছে বছর পাঁচেকের তালিম, চিন্ময় লাহিড়ির রচনা গাওয়া বা সলিল চৌধুরীর অবিশ্বাস্য সব কম্পোজিশন (‘আহা, ওই আঁকাবাঁকা যে পথ’, ‘যা যা রে যা, যা পাখি’, ‘যদি কিছু আমারে শুধাও’ বা কলাবতী রাগিণীতে ‘লাল পাথর’ ছবির ‘ডেকো না মোরে ডেকো না গো আর’) অমর করে যাওয়া কোন স্তরের শিক্ষা, মেধা ও ক্রিয়ার ছবি তুলে ধরে তা ওঁর অবর্তমানেই শ্রোতার খেয়ালে আসছে।
তাঁর সেরা সময়ে শ্যামলের গাওয়া বা সুর করা গান রেকর্ড হবে আর বাজার ধরে নেবে এটাই নিয়ম হয়ে গিয়েছিল। এত ঘন ঘন এটা ঘটত যে একটা সময় শ্যামল মিত্র বলতে এক স্বপ্নের ব্যাপারি বোঝাত। নিজেকে নিয়ে মানুষের জাদুচিত্র বয়নে আবার ইন্ধন জুগিয়েছে তাঁর অতীব সফল চলচ্চিত্র প্রযোজনার উদ্যোগ। ১৯৬৩-তে উত্তমকুমার ও তনুজাকে নিয়ে প্রযোজিত ও সুরারোপিত ‘দেয়া নেয়া’ ছবি যে কী তোলপাড় ফেলেছিল বাঙালিজীবনে, তা আজ বললে গল্পকথার মতো শোনাবে। কিন্তু তখন ক’জন বালক, কিশোর, যুবক বা আরও বড়রা ধারণা করতে পেরেছিলেন যে ছবির গল্পটা আসলে শ্যামল মিত্রেরই জীবনের বৃত্তান্তের আদলে গড়া!
নৈহাটির প্রসিদ্ধ ডাক্তার বাবা সাধনবাবুর বাসনা যে ছেলে তাঁর মতোই ডাক্তারিতে আসবে, আর শ্যামলের আকাঙ্ক্ষা সে গায়ক হবে। এক সময় সান্নিধ্যে আসা হল সলিল চৌধুরীর গণনাট্য সঙ্ঘের। মিছিলে গলা মেলানো হল ‘ও আলোর পথযাত্রী’তে এবং ১৯৪৬-এ বাড়ি ছেড়ে ওঠা হল কলকাতার মেসবাড়িতে। আর যাওয়া শুরু হল গুরু সুধীরলালের কাছে। ‘আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা’-র গায়কও পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের গানপাগলদের কাছে খুব একটা রক্তমাংসের মানুষ নন, যতটা কল্পনা ও কিছুটা স্বপ্নে ধরা। যে স্বপ্নটায় রক্তের ছোপ এসে পড়ল ১৯৬৯-এর ২১ মে তারিখে তাঁর মোটর গাড়ির অ্যাক্সিডেন্টে।
সেটা টিভিতে ঘণ্টায় ঘণ্টায় খবর ছড়ানোর দিনকাল নয়, শিল্পীদের নিয়ে পত্রপত্রিকার পাতায় পাতায় খবর আসার দিনও নয়। গেয়ে গেয়ে, লোকের মনে মনে দাগ কেটে সেলিব্রিটি হওয়ার যুগ তাঁদের। কাগজে কী এসেছিল জানি না, তবে শ্যামলবাবুর দুর্ঘটনার দুঃসংবাদ মুখে মুখেই চরে গিয়েছিল এবং পাড়ায় পাড়ায় লোকমুখে ঘুরতে শুরু করেছিল। অনেকটা উত্তমকুমারের হার্ট অ্যাটাকের খবরের মতো। ‘দেয়া- নেয়া’-র পর থেকেই যে উত্তম ও শ্যামল অত্যাগমন জুটি।
পাড়ার রকে রকে শ্যামলের খবর ভর করার আরেক কারণ, এই শ্যামলের গানই দেড় দশক ধরে মাত করে রেখেছিল রকে রকে। আশেপাশে বাড়ির মেয়েদের লক্ষ্যে প্রেমপত্র পাঠানোর বিকল্প ছিল সুরেলা বন্ধু ধরে গাওয়ানো ‘নাম রেখেছি বনলতা’, ‘আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা’, ‘কার মঞ্জির বাজে রিনি ঠিনি ঠিনি’, ‘তুমি আর আমি শুধু জীবনের খেলাঘর’ বা ‘ভালবাস তুমি শুনেছি অনেক বার’।
উত্তম-হেমন্তের মতো উত্তম-শ্যামল গোছের একটা সমীকরণ দীর্ঘদিন চালু চিল ফ্যানদের মধ্যে। সম্ভবত ‘সাগরিকা’ ছবিতে ওঁদের মেগাহিট নাম্বার ‘আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা’ দিয়েই যার শুরু।
আরতি মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “‘হেমন্তদা’, ‘মান্নাদা’ তো বড় গায়ক, ওঁদের পাশাপাশি শ্যামলদাও যে কত বড় একজন তা তো নতুন করে বলতে হয় না। কী সুর গলায়, আর কী রোম্যান্টিসিজম! এত সুন্দর করে গানের কথাগুলো বলতেন যেন প্রেম ঝরে পড়ছে। যে মানুষটার মুখে কোনও দিনও কারও সমালোচনা বা নিন্দের একটা কথা শুনিনি সেই মনটারই একটা ছাপ ওঁর গানে। কাজ তো প্রচুরই করেছেন। গাওয়া, সুর করা, ফিল্মে সুর দেওয়া ছাড়াও ছবির প্রোডাকশন। এই সমস্ত কাজের মধ্যেই কিন্তু ওঁর ওই রোম্যান্টিক মনটা ছড়ানো। গোছানো, নিপুণ, পার্ফেক্ট।”
আরতির এই উচ্ছ্বাস ও অনুরাগের যথেষ্ট কারণ আছে। বম্বে থেকে তনুজাকে নায়িকা করে এনে অত অপূর্ব অনুরাগে অনুলিপ্ত ছবিতে প্লেব্যাকের ব্রেক দিলেন আরতিকে এমন একটা গানে যা আজও বেজে উঠলে মনের অ্যালবামের পাতা ওল্টানোর কাজটা শুরু হয় মানুষের। কী গান? না, ‘মাধবী মধুপে হল মিতালি’।
কাজটায় সেই সময়ে আধুনিক সুরের রোম্যান্সের ছাপ স্পষ্ট, কিন্তু গানটা হয়েছে বহুকালের জন্য। শ্যামলের ‘বয় মিটস গার্ল’ মেজাজের (প্রেমের প্রথম ঝলক ও শিহরনের) গানেও এমন একটা Wit বা চোখা রস ও melodic intuition বা সুরের স্বজ্ঞা, যে তারা অনায়াসেই বয়স ও সময় অতিক্রম করে। ওঁর লাভার বয় সং গোত্রের গানও সব মানুষের মন ভোলায় আজও। কেউ সে-সব গাইলেই মনটা দুলে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে একটা খোঁচও ধরে। কই, সে-সব নিখুঁত সুর লাগানো বলার মাধুরী ও এলিগ্যান্সটা তো এল না!
মে মাসের সেই অ্যাক্সিডেন্টের পর গানে ফিরে শ্যামল গেয়েছিলেন বন্ধু-গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় ‘তোমাদের ভালবাসা’ তাঁর অগণিত শ্রোতা-ভক্তকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন হিসেবে। চোখে জল আনা অসম্ভব সুগীত গানটা কিন্তু মানুষকে সেদিনও চমকে দিয়েছিল। হয়তো সেই প্রথম সে ভাবে তাঁরা নজর করলেন যে তাঁদের প্রেমিক-গায়ক জীবনের প্রথম থেকেই বিদায়, বিচ্ছেদ ও হারিয়ে যাওয়ার বিষাদগীতি গেয়ে এসেছেন। ‘ও শিমুল বন দাও রাঙিয়ে মন’-এর মতো প্রাণোচ্ছল রচনার পাশাপাশি ‘এমন দিন আসতে পারে যখন তুমি দেখবে আমি নাই’ বা ‘যদি ডাকো ওপার হতে’-র মতো মন-মুচড়ানো এলিজি।
অনেকেরই হয়তো মনে পড়বে যে অ্যাক্সিডেন্টের বছর তিনেক আগেও তিনি গৌরীপ্রসন্নর লিরিকে রেকর্ড করেছেন, “এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে মন মোর যেতে নাহি চায়/ না না না যাব না’। চমকের আরেকটা কারণও লোকে খেয়াল করেছিল। নিজের সুরে গাওয়া শ্যামলের অধিকাংশ গানই ছিল বিরহবেদনার। শৃঙ্গার ও করুণ রসের মধ্যে ওঁর কান্না হাসির দোলদোলানি বরাবর জারি ছিল। আমরা দেখি বা না দেখি। তাঁর এই বিরহ সুরের প্রবণতার পেছনে তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি ভাললাগা-ভালবাসার টান কাজ করেছিল বলেই আজ মনে হয়। আশ্রম-ইস্কুল-গুরু ধরে তো তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীতে আসা নয়, কেবল ভাল লাগা আনুগত্য থেকে। তাতেও তো নিটোল সুরে অনুরাগের ছোঁয়া দিয়ে গেয়েছেন কত গান!
গানের মধ্যে কান্না ধরার একটা সহজাত ক্ষমতা গোড়ার থেকেই তৈরি ছিল শ্যামলের। দু’দশক ধরে তারই পরিশীলনে হয়তো ষাটের দশকের মাধ্যমে ডবল্ ভার্সান ছবির ‘অমানুষ’-এ ওঁর সুরে বেরিয়ে এল কিশোরকুমারের ওই চার্টবাস্টার নাম্বার, ‘কী আশায় বাঁধি খেলা ঘর বেদনার বালুচরে’। সর্বকালের বাংলা আধুনিকের সেরার কোটায় থেকে যাবে সে-গান।
সলিল চৌধুরী, রবীন চট্টোপাধ্যায়, সুধীন দাশগুপ্তর মতো সেরা কম্পোজার এবং গৌরীপ্রসন্ন, পবিত্র মিত্রের মতো বড় গীতিকারদের সঙ্গে যেমন দুরন্ত সব কাজ করেছেন শ্যামল, তেমনি অকাতরে সুর দিয়ে গেছেন অন্যের সেরা গানে। কখনও সেটা কিশোর, কখনও নিজের সঙ্গে ডুয়েটে হেমন্ত (‘ও বিধি রে’) বা মানবেন্দ্র (‘দোলে দোদুল দোলে’), কখনও আরতি (‘মাধবী মধুপে’), আশা (‘নেই সেই পূর্ণিমা রাত’) অথবা হৈমন্তী (‘এমন স্বপনও কখনও দেখিনি আগে’)।
তবে একটা গান শ্যামল গাইতেনই জলসায় এলে ষাটের দশক জুড়ে। ‘দ্বীপের নাম টিয়ারঙ’ ছবিতে রবীন চট্টেপাধ্যায় সুরে লোকাঙ্গিক ‘আমি চান্দেরি শাম্পান যদি পাই’। একটা লম্বা সময় ধরে লোকাশ্রিত সুরে অপূর্ব সব আধুনিক কম্পোজ করেছেন শ্যামল নিজেও। এত বিচিত্র অঞ্চলে যার চলাফেরা সেই শ্যামলকে কেন যে শুধু প্রেমের গানের শিল্পী করে ধরে রাখল বাঙালি, এটাই এখন বড় ভাবাচ্ছে।
অগুনতি স্মরণীয় বাংলা হিট উপহার দেওয়া, প্রায় একশো ছবির নেপথ্যে কণ্ঠ দেওয়া আর প্রায় পঞ্চাশ ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করা শ্যামল মিত্রর শেষ ক’টা বছর খুব ভাল কেটেছে বলা যায় না। বাংলা আধুনিকের স্বর্ণযুগের অবসান লগ্ন সেটা। নতুন কাজ তেমন হচ্ছে না, সেরা শিল্পীদের কাজ হয়েছে, তাঁদের পুরনো গান নিয়ে জলসায় বসা। অথচ তিনি এর মধ্যেও ছবিতে সুর করেছেন। গলা দিয়েছেন শ্যামল। কিন্তু হেমন্ত, সতীনাথ, মানবেন্দ্রর মতো তিনিও টের পাচ্ছিলেন যে বাংলা আধুনিক একই সঙ্গে দুই শিল্পেই (কলা অর্থে ও ব্যবসা অর্থে) মার খাচ্ছে।
তাঁর চিরবিদায় নেবার আগের অন্যতম শেষ আসর ছিল কলকাতার গল্ফ গ্রিনের গায়ে বিজয়গড়ের কালীপুজোর জলসায়। সেই পুরনো শান্ত মেজাজে পুরনো হিটই গেয়েছিলেন। শ্রোতার বয়েস বিচার করে ছন্দ ও গতির গান। ‘ও শিমুল বন’, ‘মহুল ফুলে জমেছে মউ’। ‘চৈতালী চাঁদ যায় ডুবে’, ‘নীল আকাশের ওই কোলে’, ‘এই পথে যায় চলে’ এমনকী সলিলের সুরে ‘আহা আঁকাবাঁকা যে পথ যায় সুদূরে’। সকলেই বুঝতে পেরেছিলেন, অডিয়েন্স বিচার করেই যুগের সঙ্গে নিজেকে মানাতে হচ্ছে শ্যামল মিত্রকে। শরীরও খুব দুর্বল দেখাচ্ছিল, স্টেজে উঠতে-নামতে বেগ পাচ্ছিলেন। তবু কেউ একবারের জন্যও মনে করেননি ‘ওই আঁকাবাঁকা পথে’র এত সুদূরে চলে যাবেন। এই আসরের ঠিক কুড়ি দিন পর চলে গিয়েছিলেন বাঙালির প্রিয় প্রেমিক গায়ক।
তখন রেকর্ড কোম্পানি, রেকর্ড করা গানের স্যাম্পেল কপি দিত শিল্পীদের, শিল্পী অ্যাপ্রুভ করলে সেটা প্রিন্ট হয়ে বেরোবে। সে বছর, খুব ভুল না করলে ১৯৫৭, সতীনাথ মুখোপাধ্যায় আর একজন শিল্পী গেছেন উৎপলা সেনের কাছে স্যাম্পেল রেকর্ড নিয়ে। কার গান হিট হবে জানতে, দু’জনই পরস্পরের সুরে গেয়েছেন সে বছর। সব কিছু শুনে উৎপলা সেন বললেন, দু’জনের সুরই অনবদ্য হয়েছে, তবে সতীনাথের সুর দেওয়া গান দুটো হিট হবেই। উৎপলা সেনের সামনে দুই বন্ধু পরস্পরের কাছে বাজি রাখলেন, এইচ.এম.ভি প্রথম ছ’মাসের বিক্রির যে লিস্ট দেবে তাতে যাঁর গানের বিক্রি বেশী হবে, সেই জয়ী। ঐ শিল্পী যদি বাজি জেতেন তাহলে সতীনাথ ওঁকে এক কার্টন বিয়ার দেবেন, আর উনি হারলে সতীনাথ কে দেবেন এক কার্টন গোল্ড ফ্লেক। সে বছর দেখা গেল শ্যামল মিত্রের সুর করা সতীনাথের গান, “রাতের আকাশ তারায় রয়েছে ভরে” উলটো দিকে “পথ চেয়ে শুধু মোর দিন কেটে যায়” আর বেস্ট সেলার হিসেবের শ্যামল মিত্রের গান, সতীনাথের সুর করা – “এত আলো আর এত হাসি গান” আর অন্য দিকে “তুমি আর আমি শুধু জীবনের খেলাঘর।”
একবার মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নতুন গাড়ি দেখে শ্যামল মিত্র বললেন, তাঁরও একটা চাই। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় সেই মডেলের গাড়ি শ্যামল কে এনে দিলেন। একই গাড়ি সতীনাথ মুখার্জি নির্মলেন্দু চৌধুরী অবধি পৌঁছে গেল। এবার পালা চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়ের। এক মডেলের গাড়ি আর কত পাওয়া যাবে! চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়কে রাগাবার জন্যে শ্যামল বললেন, আমরা সব আধুনিক গানের শিল্পী, লোকসংগীতের শিল্পী আমাদের জন্য একরকম গাড়ি, তুই হলি গিয়ে রবীন্দ্রসংগীতের শিল্পী, তোকে আলাদা গাড়ি জোগাড় করে দিচ্ছি। চিন্ময় যা বোঝার বুঝলেন। গাড়িটা ছিল – মরিস মাইনর। চিন্ময় মারা যাবার পর ‘বান্টি’ সিনেমার সামনে গাড়িটা পার্ক করা থাকত।
মানবেন্দ্র ছিলেন হুল্লোড়বাজ মানুষ। ডায়মন্ডহারবারে অনুষ্ঠান হবে, উদ্যোক্তা এসেছেন ওঁর কাছে। মানবেন্দ্র বললেন, নিলে আমাদের চারজন কে নিতে হবে, চারজন অর্থাৎ, মানব, শ্যামল, সতীনাথ ও নির্মলেন্দু । আর চারজনের চারটে অস্টিন গাড়ি যাবে। চারজনের সাথে একজনই গেলেন তবলা নিয়ে, তিনি রাধাকান্ত নন্দী। সেই টাকা সমান পাঁচ ভাগে ভাগ হল।
অমিয় দাশগুপ্তের লেখা একটা গান অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় সুর করে এইচ.এম.ভি তে নিয়ে গেছেন, মাথায় ঘুরছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের নাম। এইচ.এম.ভি –এর তৎকালীন কর্তা গীতিকার পবিত্র মিত্র তাঁর বাঙাল ভাষায় বললেন গানটা শুনে বুঝেছি যে, গানটা হেমন্তবাবুকে মাথায় রেখে করছেন। গানটা শ্যামলকে দিন, দেখুন কী হয়। সে গান শেষ অবধি শ্যামল রেকর্ড করলেন। ‘হংস পাখা দিয়ে নামটি তোমার লিখি’ — কী যে হল সেটা শ্রোতা নিশ্চয়ই জানেন। শ্যামল মিত্র মনে করতেন, আধুনিক গানের মুখড়া যদি আকর্ষণীয় না হয়, তাহলে শ্রোতা রিজেক্ট করবে। পাঠক, খেয়াল করে দেখুন ওঁর গানের মুখড়া, ‘দোলে শাল পিয়ালের বন’, ‘হয়তো কিছুই নাহি পাবো’, ‘এ প্রেম যেন তোমার স্বপন কোনো কবির’ এই তিনটে গানের সুরকার শ্যামল মিত্র। এই গানগুলোর মুখড়া শুনে দেখলেই আমার কথা স্পষ্ট হবে। শুধু তাই নয়, এঁদের সবার গানের ক্যাচি জায়গা হল মুখড়া আর সঞ্চারী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। হিমাংশু দত্ত থেকে হেমন্ত, সমস্ত সফল সুরকারের অধিকাংশের এটাই প্লাস পয়েন্ট।
শক্তি সামন্তের বাড়িতে শ্যামল গান শোনাচ্ছেন ‘অমানুষ’ সিনেমার জন্য, পাশে গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার। একটা গানও শক্তি বাবুর পছন্দ হচ্ছে না দেখে গৌরিপ্রসন্ন কাছেই রাহুল দেব বর্মনের বাড়ি চলে গেলেন। শ্যামল তখন বাথরুমে গেছেন, সেই সময় তাঁর ভাই সলিল মিত্র ঘরে ঢুকে বললেন, দাদার সুরে গৌরিবাবুর লেখা পুরনো একটা গান শোনাতে চান, শক্তি সামন্ত সেটা শুনে খুশি হলেন। বাথরুম থেকে ফিরে শ্যামল শুনলেন ভাইয়ের কীর্তি, সঙ্গে জানলেন পরিচালকের গানটা পছন্দ হয়েছে। গৌরিবাবুকে ডাকা হল। সামান্য এডিট করে গানটা লিখে দিলেন তিনি। বিপত্তি বাঁধল কিশোরকুমারকে নিয়ে, প্রথমে পছন্দ হওয়ায় রেকর্ড করবেন বলেছিলেন, কিন্তু রুমা গুহঠাকুরতা বললেন তাঁকে, এটা শ্যামলের হিট একটা রেডিয়োতে গাওয়া গান। শুনেই কিশোর বেঁকে বসলেন। রুমা দেবী সত্যিটা জানিয়েছিলেন। আর এটা সিনেমার গান নয়, রেকর্ড ও হয়নি, রেডিওতে গাওয়া হয়েছে মাত্র। কিশোর কে শ্যামল কনভিন্স করিয়ে রেকর্ড করলেন, কী আশায় বাঁধি খেলা ঘর। গানটা গেয়ে কিশোর জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছিলেন।
সেই সময়ে মনে করা হত উত্তমকুমারের লিপে গান না গাইলে একটা জায়গায় পৌঁছনো যেত না। কিন্তু উত্তমকুমারের লিপে তখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জয়জয়কার। লোকে বলত উত্তমকুমার আর হেমন্তর গলাটা যেন একই। ফলে বেসিক গানে হেমন্ত ও শ্যামল দুজনেই বহু হিট গান দিলেও সিনেমার গানে সেই জায়গাটা পাচ্ছিলেন না শ্যামল মিত্র। হেমন্তর অনুপস্থিতিতে গেয়েছিলেন ‘সাগরিকা’ ছবিতে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত উত্তমকুমার আর হেমন্ত জুটিতে ফাটল ধরল। সেটা ‘বিশ সাল বাদ’ সিনেমা নিয়ে। এই ছবি প্রযোজনা করছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ঠিক ছিল মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করবেন উত্তমকুমার। কিন্তু উত্তমকুমার ডেট দিতে পারছিলেন না বলে তাঁর জায়গায় চলে আসেন বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়। এখানেই একটা ফাটল তৈরি হল উত্তমকুমার ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মধ্যে। এইভাবেই উত্তমকুমারের লিপে চলে এল শ্যামল মিত্রর গান। এমনিতে উত্তমকুমার এবং শ্যামল মিত্র ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সিনেমায় দুই বন্ধুর যুগলবন্দীও কম আকর্ষণীয় নয়। ১৯৬২ থেকে প্রায় ১৯৭২ পর্যন্ত সিনেমায় উত্তমকুমারের লিপে বহু গান ছিল শ্যামল মিত্রর। এইভাবেই একদিকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও অন্যদিকে মান্না দে-র গানের মাঝখানে বাংলা সিনেমায় চলে এল শ্যামল মিত্রর গান আর উত্তমকুমারের লিপ। বাংলা ছবির দর্শকদের কাছে উত্তমকুমারের লিপে স্মরণীয় হয়ে থাকল শ্যামল মিত্রর গানও।
কথা আর সুরের যুক্ত ব্যঞ্জনে তৈরি হয় সঙ্গীত। কাঠামো, একমেটে, দোমেটে, রং ও চক্ষুদানের পর পুরোহিতের মন্তরে যেমন প্রাণ পায় মাটির প্রতিমা, তেমনি গীতিকবির অভিব্যাক্তি মাখা শব্দগুচ্ছে সুর আর গায়কের যাদুর কন্ঠ জন্ম দেয় এক একটি কালজয়ী গান। আধুনিক বাংলা গানকে যারা কথা ও সুরের বৈচিত্র্য আর আভিজাত্যে ভরিয়ে রেখেছিলেন বাংলা গানের সোনালী যুগের সেসব অমর কন্ঠ শিল্পীদের অন্যতম মেলোডিয়াস সুরের শিল্পী শ্যামল মিত্র। সুরকার হিসেবেও তিনি অনন্য। মিষ্ট সুরেলা কন্ঠশিল্পী শ্যামল মিত্রের ৩২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৮৭ সালের ১৫ই নভেম্বর প্রয়াত হন ভারতীয় উপমহাদেশের সঙ্গীতাকাশের উজ্জ্বলতম এই নক্ষত্র।
১৯২৯ সালের ১৪ই জানুয়ারি শ্যামল মিত্র জন্ম নেন ভারতের নৈহাটিতে। বাবা ডঃ সাধন কুমার মিত্র। চিকিৎসক বাবা চেয়েছিলেন ছেলে শ্যামল মিত্র তাঁর পেশায় আসুক। অথচ ছেলে যে সুরপাগল! তাঁকে আটকায় কে? নৈহাটির প্রাসাদোপম বাড়ি ছেড়ে চলে এলেন কলকাতায়।
সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের অবস্থান তখন সঙ্গীতের উচুঁ চূড়ায়। শ্যামল মিত্র পড়েন কলেজে। টেবিলে তাল ঠুকে গান করা ছিল তাঁর স্বভাব। মাঝে মধ্যে স্টেজ প্রোগ্রামও করতেন। এমনি এক আসরে তিনি নজরে পড়েন সতীনাথের। শ্যামলকে তিনি উপদেশ দিলেন, গানের আলোয় আসতে গেলে কলকাতা ছাড়া গতি নেই। সতীনাথের পরামর্শেই কলকাতায় এসে সুধীরলাল চক্রবর্তীর কাছে গানের তালিম নেন শ্যামল। এক পর্যায়ে বিখ্যাত গায়ক সতীনাথের কাছে তালিমও নিলেন তিনি। আর এভাবেই অক্লান্ত শ্রম আর লড়াই করে বাংলা সঙ্গীত জগতে অন্যতম উজ্জ্বল তারকা হয়ে যান শ্যামল মিত্র।
বাংলার পল্লিমাটির সহজিয়া টান ছিল শ্যামলের গানে আর সুরে। তাঁর মেলোডিয়াস সুর অনায়াসে ভরিয়ে দিত শ্রোতাদের মনপ্রাণ। সাগরিকা ছবিতে মহানায়ক উত্তম কুমারের লিপে শ্যামল মিত্রের গাওয়া ‘আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে/ সাত সাগর আর তেরো নদীর পারে’ পেয়েছে উত্তুঙ্গ জনপ্রিয়তা। এই গান গুনগুন করেনি এমন বাঙালী যুবক পাওয়া যাবে না।
শ্যামলের কন্ঠে, ‘নাম রেখেছি বনলতা/যখন দেখেছি/হয়তবা সেই ক্ষনে তোমায় ভালবেসেছি’, ‘তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা/কে বলে আজ তুমি নেই/তুমি আছো মন বলে তাই’, ‘জীবন খাতার প্রতি পাতায়/যতই লেখো হিসাব নিকাশ/কিছুই রবে না’, ‘তোমাকে দূরের আকাশ ভাববো না/তুমি যে ইন্দ্রধনুর কাব্য না’, ‘এই পথে যায় চলে/ঝরা পাতা যায় দলে’, ‘আহা ওই আঁকাবাঁকা যে পথ’, গান গুলি আজও বাঙালি শ্রোতাদের নিকট সমান আদৃত।
বাংলা সঙ্গীত জগতে নিজের প্রতিভার পরিচয় রাখার পরে বাংলা ছবিতেও অপরিহার্য হয়ে উঠলেন শ্যামল। উত্তমকুমারের লিপেই অমানুষ ছবিতে তাঁর সুর দেয়া গান কিশোরকুমারের কন্ঠে ”কি আশায় বাঁধি খেলাঘর, বেদনার বালুচরে” জনপ্রিয়তার শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করেছে। ১৯৫৩ সালে ‘লাখ টাকা’ ছবিতে প্রথম সংগীত পরিচালনা করেন। তাঁর বড় সাফল্য আসে ১৯৬৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দেয়ানেয়া’ ছবিতে। ছবির প্রতিটি গানই তখন মানুষকে স্পর্শ করেছে – ‘জীবন খাতার প্রতি পাতায়’, ’গানে ভূবন ভরিয়ে দেবে’, ‘আমি চেয়ে চেয়ে দেখি সারাদিন’, ‘মাধবী মধুপে হলো মিতালী’, ‘দোলে দোদ্যুল দোলে ঝুলনা’, ‘এগানের প্রজাপতি পাখায় পাখায় রং ছড়ায়’।
এছাড়াও ‘ভ্রান্তিবিলাস’, ‘অমানুষ’, ‘আনন্দ আশ্রম’ সহ অনেক ছবিতে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে সফল হয়েছেন শ্যামল মিত্র। ‘অমানুষ’, ‘আনন্দ আশ্রম’ সিনেমার হিন্দি ভার্সানেও সুর দিয়েছেন শ্যামল মিত্র। তাঁর ‘দিল অ্যায়সা কিসিনে মেরা তোরা’ গানটি বেশ জনপ্রিযতা পেয়েছিল। প্রায় পঞ্চাশটির মত ছবিতে সুর ও সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন তিনি। ৪৬টি ছবিতে শ্যামল মিত্রের সুরে প্রায় দেড়শো গান আছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সুরকারের সুরে নানা ছায়াছবিতে শ্যামল মিত্র বহু গান গেয়েছেন। চলচ্চিত্রে সুরকার হিসেবে শ্যামল মিত্রের প্রায় ৯০ শতাংশ গান হিট।
বেসিক রেকর্ডে শ্যামল মিত্র গেয়েছেন দেড়শোরও বেশি আধুনিক গান। তাঁর গীতিকার-সুরকারের তালিকায় পবিত্র মিত্র, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, শ্রীশঙ্কর, শ্যামল গুপ্ত, সুধীন দাশগুপ্ত, সুধীরলাল চক্রবর্তী, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, হিমাংশু দত্ত, সলিল চৌধুরী, সুবীর হাজরা, শৈলেন রায়, পঙ্কজ মল্লিক, মোহিনী চৌধুরী, নিতাই ঘটক, দুর্গা সেন প্রমুখ বিখ্যাত।
সুধীরলাল চক্রবর্তী সঞ্চারীর যে ধারা শুরু করেছিলেন, আদর্শ ছাত্র হিসেবে চিরকালই তা হুবহু অনুসরণ করেছিলেন শ্যামল মিত্র। গান লেখা হয়ে গেলে সুর করতে তাঁর সময় লাগত না। তাঁর সুরে বিদেশি প্রভাব দেখা যেত না।
বাংলা গানের জনপ্রিয় শিল্পী মনোময় ভট্টাচার্যের মতে, “শাস্ত্রীয় সঙ্গীতেও শ্যামল মিত্রের অনেক দিক জানা ছিল। ছবির পর ছবিতে সুর দিয়েই শ্যামলদা যে-ছবি আঁকতেন, আজ আর কি তা সম্ভব?”
শিল্পী আশা ভোঁসলের মতে, “বাঈজিবাড়ির গানে যে-ধারা শ্যামলদা বাংলা ছবিতে ব্যবহার করেছিলেন, তা খুব বেশি শোনা যায় না।”
চলচ্চিত্রের বাইরে অনেক বাংলা আধুনিক গানে সুর দিয়েছেন তিনি। তরুন বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘কাজল নদীর জলে, ভরা ঢেউ ছলছলে’ এই গানটিতে এক অসাধারন মায়াজাল তৈরী করেছিলেন তিনি। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ’হয়তো কিছুই নাকি পাব’ সহ আরো অনেক গান তাঁর সুর করা। তাঁর সুরে অনেকেই গান গেয়েছেন আবার তিনিও অনেক সুরকারের গান কন্ঠে তুলে নিয়েছেন পরম মমতায়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে শ্যামল মিত্রের সুর করা ও গাওয়া ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালী’ গানটি মানুষের মনে আজও গেঁথে আছে।
শ্যামল মিত্র বলেছিলেন তাঁর জীবনের গল্প। আর গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার একটা দিস্তা খাতায় সেই জীবনের গল্প লিখে চলেছিলেন। কী সেই জীবন? আসলে শ্যামল মিত্রর বাবা ছিলেন রাশভারী ডাক্তার। চাইতেন ছেলেও ডাক্তার হোন। কিন্তু শ্যামল মিত্রর চোখে তখন গায়ক হওয়ার স্বপ্ন। তাঁর সেই স্বপ্নকে বাড়িয়ে তুলেছিলেন সলিল চৌধুরি, মৃণাল কান্তি ঘোষ প্রমুখ। ফলে একদিন দারুণ রেগে গিয়ে শ্যামল মিত্রর বাবা বললেন, গান গাইতে হলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও। শ্যামল মিত্র নৈহাটির বাড়ি ছেড়ে চলে এলেন কলকাতায়। একটা মেসে থাকতেন, বঙ্গবাসী কলেজে পড়তেন আর সুধীরলাল চক্রবর্তীর কাছে গান শিখতেন। পরে তাঁর জীবনেরই এই অংশটা ভরে দেওয়া হয়েছিল ‘দেয়া নেয়া’ ছবিতে।
২৫শে মার্চ ২০১৭ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায়, শ্যামল মিত্র স্মরণে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র শ্রী সৈকত মিত্র লিখেছিলেন –
“বাবাকে আমি ডাকতাম বাবন। আমার দেখাদেখি পাড়ায় আমার বন্ধুরা, এমনকী দাদার বন্ধুরাও ডাকত ‘বাবন’। বাবন মানেই গান। সিনেমা। আড্ডা। ছবির মতো গল্প বলা। ফ্যাশনেবল জামাকাপড়। নামী ব্র্যান্ডের সিগারেট। স্কচটা বিলিতি। দুর্দান্ত ব্যাডমিন্টন খেলত বাবন। ফুটবলটাও খেলত বেশ। খেলা নিয়ে কত যে খবর রাখত! ভালবাসত প্রচণ্ড মজা করে বাঁচতে।মাঝেমধ্যেই ছুটিছাটার দিনে লং ড্রাইভে বাবন আমাদের নৈহাটিতে দেশের বাড়ি নিয়ে যেত। তখন শ্যামবাজারে দ্বারিকের দোকানে থামাটা ছিলটা ‘মাস্ট’। ওখানে কিছু না কিছু খেয়ে আবার স্টার্ট। বি.টি. রোড ধরে সোজা। সে রাস্তা তখন খানাখন্দে ভরা। প্রায় নাচতে নাচতে গাড়ি এগোত বলে, বি.টি. রোডকে বাবা বলত ‘উদয়শঙ্কর সরণি’।
নৈহাটি স্টেশন থেকে বাঁ ধারে যে রাস্তাটা সোজা গঙ্গার দিকে চলে গেছে, সেই দিকে প্রথমে পড়ে মিত্র পাড়া, তার পরই ব্যানার্জিপাড়া। আমাদের বাড়ি। রেললাইনের ও পারে থাকতেন সমরেশ বসু। সাহিত্যিকের চেয়েও তখন আমার কাছে সমরেশকাকুর পরিচয়, বাবনের বন্ধু। একবার বাবনের খুব ঝোঁক চেপেছিল, ওঁর ‘বিবর’ নিয়ে ছবি বানাবে। নায়ক করবে উত্তমকাকুকে। তখনই ‘বিবর’ নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ‘ব্যান’ যখন উঠল, আমি বললাম, ‘এখন তো করতে পারো।’ তত দিনে উত্তমকাকু চলে গিয়েছেন। ওঁকে ছাড়া কিছুতেই ছবিটা করতে রাজি হয়নি বাবন।
নৈহাটির বাড়িটা বিশাল। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এক সময় যখন ব্রিটিশ পুলিশের গ্রেফতারি, গুলিগোলা লেগেই ছিল, বাবন তখন আইপিটিএ-তে। বাড়িতে প্রায়ই ২৫/৩০ জন এসে পড়ত, হঠাৎ হঠাৎ। একসঙ্গে খেয়েদেয়ে রাতে ঘুমোতও তারা। সেই দলে সলিল চৌধুরীও ছিলেন। তেমনই সময় গভীর রাতে একবার সলিলজেঠু বাবাকে ডেকে তুলে বলেছিলেন, ‘‘একটা গানের ছোট্ট অংশ সুর করে ফেলেছি, শুনবি?’’ বলে শুনিয়েছিলেন, ‘গাঁয়ের বঁধূ’র ‘ডাকিনী যোগিনী এল শত নাগিনী’-র জায়গাটা। তখন কে জানত, এই সলিলজেঠুই বাবনকে মুম্বই নিয়ে যাবেন, বাবনও পর পর ছবিতে কাজ করবে ওখানে!
নৈহাটির বাড়িতে বিধান রায়ও গিয়েছেন। আমার ঠাকুর্দা ছিলেন নামী ডাক্তার, বিধান রায়ের ছাত্র। এস্রাজ বাজাতেন, বাবনের কাকা, তিনিও আমাদের দাদু, ছিলেন ধ্রুপদ গাইয়ে। কিন্তু গায়ক হতে গিয়েই ঠাকুর্দার কোপে পড়ে বাবন! শেষে বাড়িছাড়াও হতে হয়। বাবনের ‘নাম’ হতে অবশ্য ঠাকুর্দার রাগ পড়েছিল। সে অনেক পরে।
হুগলি মহসিন কলেজে পড়ার সময় বাবনের খুব বন্ধু ছিলেন সতীনাথকাকু (মুখোপাধ্যায়)। এক বছরের সিনিয়র। সম্ভবত সতীনাথকাকুই বাবনকে বলেন, ‘‘এখানে পড়ে থাকলে গানটা হবে না, কলকাতা চ’।’’
ফলে নৈহাটি ছে়ড়ে চক্রবেড়িয়া রোডে পিসির বাড়ি। উল্টো দিকে গিরিশ মুখার্জি রোড। সেখানে থাকতেন উত্তমকুমার। উত্তমকাকু তখন চাকুরে। নাটক করেন। সিনেমায় ঢোকার চেষ্টা করছেন।
চক্রবেড়িয়া থেকে বাবন চলে যায় লেক মার্কেটের মেসে। মেসে উঠে আসার অন্যতম কারণ সুধীরলাল চক্রবর্তী। তত দিনে ওঁর গান শুনে বাবনের পাগল-পাগল দশা। ওঁর কাছেই শিখতে হবে। নইলে জীবন বৃথা! ফলে উজিয়ে চলে গিয়েছিলেন ৫ নম্বর জনক রোডে, সুধীরলালের বাড়ি।
সুধীরলালেরও ভাল লেগেছিল বাবনকে। শুরু হল গান শেখা। বাবন ওঁকে যে কী শ্রদ্ধা করত! আমাদের বাড়ির বাইরের দরজার ঠিক পাশে সুধীরলালের একটা ব্লো-আপ টাঙানো ছিল, বাবন রোজ বেরোবার সময় ছবিটায় প্রণাম করে বেরোত। ১৯৫২ সালে সুধীরলালের যখন অকালপ্রয়াণ হয়, সে বছর পুজোয় ওঁকে মনে রেখেই বাবন গান রেকর্ড করে ‘স্মৃতি তুমি বেদনার’ আর ‘আশা বাঁধে ঘর’।
বাবনের গুরুভক্তি ঠিক কী পর্যায়ের ছিল, শুনুন। প্রথম প্লে-ব্যাক। ‘সুনন্দার বিয়ে’ ছবিতে। সুপ্রীতিপিসির (ঘোষ) সঙ্গে। সুপ্রীতিপিসিই বলেছিলেন, ‘‘রিহার্সালে দেখেছি ভদ্রসভ্য। রেকর্ডিং-এর দিনে মনে হল, মুখে যেন মদের গন্ধ! জিজ্ঞেস করতে বলল, ‘কী করব, গুরু যে বললেন, দু’ঢোঁক খেয়ে যা, ভাল গান হবে’!’’
বাবনের মেসবাড়ির উল্টো দিকে ছিল মায়ের পিসির বাড়ি। পিসির রান্নার হাত ভাল। মায়ের মামারা ও-বাড়ি আসতেন ওই রান্নার লোভেই। ওঁদের আবার বন্ধু ছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। বাবার সঙ্গে ভানুকাকুর আলাপ ওখানেই। মায়ের সঙ্গেও তাই। বাবনকে প্রথম প্রথম মা ‘মামা’ ডাকত। মামার বন্ধু যে!
আমার বড় হওয়া ওয়েডার বার্ন রোডে। বাবন থাকলে সে-বাড়ির দরজা খোলাই থাকত। আমার যখন তিন-চার বছর বয়স, প্রায়ই দেখতাম, একটা লম্বা করে লোক হুটহাট চলে আসেন। ঢোলা পাজামা। কোঁচকানো পাঞ্জাবি। চোখে চশমা। এলোমেলো চুল। বাবন কীসব বোঝায় তাঁকে। তার পর হাতে কিছু টাকা দিলে উনি চলে যান। অনেক পরে জেনেছিলাম ওঁর নাম— ঋত্বিক ঘটক!
‘রাজকন্যা’র স্ক্রিপ্ট করতে বাবা ওঁকেই ডেকেছিল। এ দিকে স্ক্রিপ্ট আর দেন না। কেবলই ঘোরান। একদিন নাছোড় হয়ে পাকড়াও করতেই বললেন, ‘‘হয়েই গেছে প্রায়। শোনাচ্ছি।’’ হাতে একতাড়া কাগজ নিয়ে বসলেন। মিড শট, লং শট বলে বলে গড়গড় করে পড়তেও লাগলেন। খানিক পর বললেন, ‘‘বাথরুম থেকে ঘুরে আসছি।’’
উনি চলে যেতে বাবন উঠে কাগজের তাড়াটা হাতে নিয়ে দেখতে গেছে, কতটা হয়েছে! দেখে, কোথায় স্ক্রিপ্ট! এ তো হিজিবিজি কাটা, ‘‘তার মানে, এতক্ষণ মন থেকে বলে যাচ্ছিল ঋত্বিক!’’
বাবনের চেয়ে উত্তমকাকু ছিলেন বছর তিনেকের বড়। কিন্তু সম্পর্কটা ছিল তুই-তোকারির। উত্তমকাকু এক রকম জোর করে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’-এ বাবনকে দিয়ে অভিনয় করান। সেই বিখ্যাত গানের দৃশ্য— ‘আমার এ যৌবন’। প্রচণ্ড নাকি রিহার্সাল হত। কিন্তু বাবন বলেছিল, ‘‘কখন যে টেক হত, কিচ্ছু বুঝতে পারতাম না। রিহার্সাল হতে হতেই ‘টেক’ হয়ে গেছে, এমনও হয়েছে।’’
বাবন আর উত্তমকাকুর কমন ফ্রেন্ড ছিলেন ‘ম্যাক’ বলে একজন। ওঁর আলিপুরের ফ্ল্যাটে একবারের পার্টির কথা মনে পড়ে। আমিও ছিলাম সেখানে। তখন বাবনদের পার্টিতে যে যাই করুক, শেষে গান গাওয়া ছিল বাঁধা। সে বার অনেক রাত হয়েছে, তবু আমি ঘুমোচ্ছি না। বেণু আন্টিও কত বলছে, তবু না। আসলে আমি বসে ছিলাম গান শোনার লোভে। সে দিনের পার্টিতে গায়ক-নায়ক রবীন মজুমদারও ছিলেন। কী কারণে পাশের ঘরে গেছি। হঠাৎ শুনি চিৎকার করে গান, রবীন মজুমদারেরই, ‘আমার আঁধার ঘরের প্রদীপ’। ছুট্টে গেলাম। দেখি, সবার অবস্থা তূরীয়! কে কত চড়ায় যেতে পারে তার কম্পিটিশন চলছে! সে কী তারস্বরে গান!
উত্তমকাকুর ওপরে একবার বেজায় চটে গিয়েছিল বাবন। কাকুর ব্যক্তিজীবনে তখন বিরাট বাঁক এল। এ দিকে ‘দেয়ানেয়া’র শ্যুটিং চলছে। বাবন সরাসরি বলেছিল, ‘‘এটা কী করলি তুই? ছবিতে কাজ করতে হলে, আগে বাড়ির ব্যাপারটা ঠিক কর।’’ শ্যুটিং বন্ধ করে দিয়েছিল এক মাস। কিছুই ঠিক হয়নি, তবে ঘটনাটা ভুলতে পারিনি আজও।
কী সব সময়, কী সব সম্পর্ক ছিল তখন! সন্ধ্যাপিসির (মুখোপাধ্যায়) কথা বলি। ১৪ জানুয়ারি যে বাবনের জন্মদিন, বাবনেরই মনে থাকত না, পিসির কিন্তু কোনও দিন ভুল হয়নি। ঠিক ফুলমিষ্টি নিয়ে চলে আসবেনই।
মান্নাজেঠুকে দেখতাম, রেকর্ডিং-এর জন্য গান তুলতে এসেছেন। শেখা হল। ব্যস, তার পর হারমোনিয়ামটা বাগিয়ে নিয়ে শুরু হল মন খুলে গান, আড্ডা। সময়সীমা বলে কোনও কিছু নেই।
দমদম এয়ারপোর্ট। আমি আর বাবন গিয়েছি। হঠাৎ মান্নাজেঠুর সঙ্গে দেখা। তার ঠিক আগের দিন বাবনের গলায় সুধীরলাল চক্রবর্তীর একটা গান শুনেছেন মান্নাজেঠু, রেডিয়োতে। ‘শেষ কথা আজ বলে যাও ওগো’!
প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে লাউঞ্জে দাঁড়িয়েই মান্নাকাকু বলতে লাগলেন, ‘‘ওফ্, কী করে গাইলেন বলুন তো!’’ বাবন বিনয়ী গলায় ম্লান মুখে শুধু বলল, ‘‘কী যে বলেন!’’
এই মান্নাজেঠুর সঙ্গে কিন্তু একবার ফাটাফাটি লেগে গিয়েছিল বাবনের। গান নিয়েই। গানটা ছিল ‘এ তো পুতুলখেলা নয়’। ‘রাজবংশ’ ছবির। বাবনের সুর। গানের স্কেলটা কিছুতেই পছন্দ হচ্ছে না মান্নাজেঠুর। বাবনও ছাড়বে না। শেষে তক্ক। রাগারাগি। বাবন বলল, ‘‘যা বলছি তাই হবে। এ ভাবে যদি না করেন, ছেড়ে দিন। গাইতে হবে না।’’
কী আশ্চর্য, এর পর কিন্তু মান্নাজেঠু একটা কথাও বললেন না। ইগো দেখালেন না। এ ঘটনা যদি এখন ঘটত, কী না কী হত!
কিশোরকুমার। দাদরার ওপরে বাবনের বেশি ঝোঁক ছিল বলে বাবানকে উনি ডাকতেন ‘দাদরাবাবু’।
ছবির নাম ‘অমানুষ’। গান, ‘কী আশায় বাঁধি খেলাঘর’। গাইবেন কিশোরকুমার। গান শুনে প্রথমে বেঁকে বসলেন তিনি। বললেন, ‘‘এ আমার দ্বারা হবে না। তা ছাড়া এই গানটা আপনি রেডিয়োতে বহুবার গেয়েছেন।’’ অনেক জোর করায় এক মাস সময় নিলেন শিখতে। তার পরের ঘটনা তো আজ ইতিহাস!
গৌরীকাকুর (গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার) সঙ্গে বাবার সম্পর্টা যে কী ছিল! গান তৈরিতে বসে কত যে ম্যাজিক করত দু’জনে! দুটো গান মনে পড়ে। ‘ঝিরি ঝিরি বাতাস কাঁদে’ আর ‘‘তোমার ওই ধূপছায়া রং শাড়ির পাড়ে’। গৌরীকাকু মুখড়া লিখছেন, স্বভাবমতো কাগজটা ছুড়ে দিচ্ছেন বাবনকে। বাবন সুর করছে। গৌরীকাকু অন্তরা লিখছেন। আবার দিচ্ছেন ওই একইভাবে। সুরও হচ্ছে। এ ভাবে মাত্র কুড়ি মিনিটে লিজেন্ডারি দুটো গান তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
একটা সময়ে খুব মদ্যপান বাড়িয়ে দিয়েছিল বাবন। শেষমেশ কাল হল সেটাই। উত্তমকাকুর চলে যাওয়ার দিনটা মনে পড়ে। রাতে খবর এল। পরদিন সকালে ‘কলঙ্কিনী’ ছবির গানের রেকর্ডিং। ‘যেতে পারব না’ জানিয়ে দিয়ে সকাল থেকে মদ নিয়ে বসে পড়ল। আশাজি (ভোঁসলে) জোরজার করে নিয়ে গিয়েছিল রেকর্ডিং-এ।
গাড়ির দুর্ঘটনাটাও ওই মদ্যপানের কারণেই। রোড-রোলারে ধাক্কা মেরে বাবন সে দিন মারাই যেতে পারত! দু’মাসের ওপর শিশুমঙ্গল হাসপাতালে থেকে ফিরল বটে, কিন্তু জখম এতটা বীভৎস যে, বাড়িতে এক্কেবারে বিশ্রাম। তখন খুব ভেঙে পড়েছিল। অবসাদে ভুগত। এক সময় ভেবেছিল, গানেই আর ফিরতে পারবে না। ওই সময়ই বিশু আঙ্কলকে (বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়) দেখেছি, ‘নিশিপদ্ম’-র ‘রাজার পঙ্খী উইড়্যা গেলে’ গানের রেকর্ডিং-এর দিন। বাবনকে পাঁজাকোলা করে রেকর্ডিং করতে নিয়ে গেল আঙ্কল।
কত যে ফ্যান-মেল আসত তখন! সবাইকে তো উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। তাই সুস্থ হয়ে যখন গানে ফিরতে পারল বাবন, গৌরীকাকুকে বলে একটা ফরমায়েশি গান লিখিয়েছিল ওঁর ভক্তকুলের জন্য, ‘তোমাদের ভালবাসা মরণের পার থেকে ফিরায়ে এনেছে মোরে’।
ফিরল বটে। কিন্তু মাঝে মাঝেই শরীর দিত না। অনুষ্ঠান করতে গেলে আমায় নিয়ে যেত। আমায় এগিয়ে দিত গাইতে। সেই প্রথম আমার পাবলিক প্রোগ্রামে গাইতে ওঠা। এমনও হয়েছে, গাইতে গিয়ে গাড়িতে বাবন শুয়ে আছে অসুস্থ হয়ে। আমি উঠেছি স্টেজে একা।
শেষ দিকে, দাঁত দিয়ে খুব রক্ত পড়ত। ভাবত, বুঝি ফল্স দাঁতের সেটিংটা গোলমাল করছে। ভাবতেই পারেনি, ভেতরে ভেতরে লিভারটা তখন বিদ্রোহ করতে শুরু করেছে। রক্তটা তারই।
১৯৮৭ সাল। বাবনকে হাসপাতালে দিতে হল। খুব আশঙ্কার মধ্য দিয়ে কাটতে কাটতে একদিন হঠাৎই যেন একটু হলেও ভাল হল।
তার ঠিক পরদিন। নভেম্বরের ১৫। চিরকালের জন্য চলে গেল বাবন।”
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় নিজের সুরে শ্যামল মিত্র গেয়েছিলেন – ‘এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে মন যেতে নাহি চায়’, তবে সেই পৃথিবী তাঁকেও ছাড়তে হয়েছে একদিন। যতদিন বাঙালির মাঝে সংগীত বেঁচে থাকবে, তত দিন শ্যামল মিত্র বেঁচে থাকবেন তাঁদের হৃদয়ে আপনজন হয়ে।
(তথ্যসূত্র:
১- শ্যামল মিত্র, অলক চট্টোপাধ্যায়, আজকাল (২০১০)।
২- বঙ্গদর্শন পত্রিকা, ২০শে মে ২০১৭ সাল।
৩- আজকাল পত্রিকা, ২০শে জুলাই ২০১৯ সাল।
৪- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৫শে মার্চ ২০১৭ সাল।
৫- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৩ই ডিসেম্বর ২০১৪ সাল।
৬- উইকিপিডিয়া।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত