বঙ্গদেশের বহু শহীদ তাঁদের জীবন আহুতি দিয়েছেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মহাযজ্ঞে। এঁদের অনেকেই বর্তমান তরুণ প্রজন্মের কাছে একেবারে অপরিচিত। বিপ্লবী গোপীনাথ সাহা তাঁদেরই একজন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, অগণিত বিস্মৃতপ্রায় বাঙালি বিপ্লবীদের সাথে বর্তমান প্রজন্মের পরিচয় করানোর প্রয়োজন অনুভব করা হয় নি। এদেশে গান্ধীবাদী আন্দোলন ও অন্যান্য রাজ্যের অন্য ভাষার মানুষের জীবনের উপরে যতটা আলোকপাত করা হয়েছে, তার সিকিভাগও বঙ্গদেশের ভূমিপুত্রদের জীবনের উপরে করা হয় নি। স্বাধীনতার এত বছর পরেও তাই গোপীনাথ সাহার মতন বিপ্লবী অধিকাংশ বাঙালির বিস্মৃতির অতলেই রয়ে গেছেন।
গোপীনাথ সাহা হুগলী জেলার শ্রীরামপুরে ১৯০৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মতারিখ নিয়ে সংশয় আছে, কারণ কোথাও সুস্পষ্টভাবে তাঁর জন্মতারিখের কোন উল্লেখ নেই। তবে কয়েক জায়গায় বেশ কিছু গবেষক ও লেখক তাঁর জন্মতারিখ ৭ই ডিসেম্বর বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর পিতার নাম ছিল শ্রী বিজয়কৃষ্ণ সাহা। গোপীনাথ অসহযোগ আন্দোলনের সময় বিদ্যালয় ত্যাগ করতে বাধ্য হন। তিনি ছাত্রাবস্থায় বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং ক্রমে ক্রমে হুগলী বিদ্যামন্দির, কলকাতা সরস্বতী লাইব্রেরী ও সরস্বতী প্রেস, দৌলতপুর সত্যাশ্রম, বরিশাল শঙ্করমঠ, উত্তরপাড়া বিদ্যাপীঠ প্রভৃতি স্থানের বিভিন্ন বিপ্লবী সংগঠনের বিভিন্ন নেতৃত্বের সঙ্গে কাজ করেন। এই সময়টাতে কলকাতার অত্যাচারী পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট বিপ্লবীদের কাছে সাক্ষাৎ দানব হয়ে উঠেছিলেন। একদিন গোপীনাথ প্রস্তুতি নিলেন চার্লস টেগার্টকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবার। সালটা ছিল ১৯২৪ এবং এই সময়েই গোপীনাথ পুরোপুরি ঢুকে পড়েছিলেন ঘরছাড়া লক্ষ্মীছাড়াদের বিপ্লবী আন্দোলনে। এদিকে ১৯২২ সালে গয়া কংগ্রেসে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সাথে মতবিরোধের ফলে তখন বাংলার বিপ্লবী যুবকদের প্রতি সর্বাপেক্ষা সহানুভূতিশীল নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস সারা দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
১২ই জানুয়ারি ১৯২৪ সাল, দেশবন্ধু সেদিন তাঁর নিজের বাড়িতে অনেক কাগজপত্র নিয়ে ভয়ানক ব্যস্ত। কোমরে রিভলবার গুঁজে গোপীনাথ গেলেন দেশবন্ধুর কাছে আশীর্বাদ নিতে। তবে তিনি দেশবন্ধুকে তাঁর করতে চলা অপারেশন নিয়ে কিছুই বলেন নি – তাঁকে গোপীনাথ সামান্যতম আঁচ পেতে দেননি যে তিনি কি করতে চলেছেন। যেহেতু সেদিন দেশবন্ধু খুবই ব্যস্ত ছিলেন তাই তাঁর সাথে সামান্য কিছু কথাবার্তা সেরে তাঁকে আর বিরক্ত না করে গোপীনাথ দেশবন্ধুকে বললেন, ‘তাহলে আশীর্বাদ করুন – আমি যাই’। তাঁর দেশবন্ধুর কাছে আগমনের মূল উদ্দেশ্যই ছিল তাঁর আশীর্বাদ ও পদধূলি নেওয়া। দেশবন্ধু তখন এত তন্ময় হয়ে কাগজপত্রে ডুবে ছিলেন যে তাঁর কানে কথাটি গিয়ে পৌঁছায় নি। দেশবন্ধুর কাছ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে গোপীনাথ তাঁকে বারবার একই কথা বলে চলেন – ‘তাহলে আশীর্বাদ করুন – আমি যাই’। দেশবন্ধু গোপীনাথকে ভালোভাবেই জানতেন ও চিনতেন। তিনি গোপীনাথকে ‘fire brand’ ছেলে বলতেন। হঠাৎ দেশবন্ধু কাগজ থেকে মুখ তুলে গোপীনাথকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায় যাবি?’ গোপীনাথ শুধু হেসে বললেন, ‘সেই যে বলেছিলাম’। গোপীনাথ তখন কি বলেছিলেন, কেন বলেছিলেন সেসব কিছুই দেশবন্ধুর মনে পড়ল না। কাজের সময় ছেলেটা তাঁকে ভীষণ বিরক্ত করছে দেখে তিনি বললেন, ‘যা, যেখানে যাবি যা!’ একথা শুনেই গোপীনাথ আনন্দে আত্মহারা হয়ে আবেগে দেশবন্ধুর পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন পথে, তাঁর অপারেশন সফল করতে। স্বয়ং দেশবন্ধু তাঁকে নির্দেশ দিয়েছেন, একি তাঁর কম সৌভাগ্য! গোপীনাথ গিয়ে উপস্থিত হলেন চৌরঙ্গী আর পার্ক স্ট্রীটের জংশনে। টেগার্ট সেই পথ দিয়েই গাড়িতে করে যাতায়াত করতেন। ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগলেন তাঁর শিকারের। অবশেষে অভিষ্ট মুহূর্ত এল। গর্জন করে উঠল গোপীনাথের রিভলবার, গাড়ির মধ্যেই ঢলে পড়লেন এক সাহেব। গোপীনাথ আনন্দে আত্মহারা হয়ে ভাবলেন যে টেগার্ট গেছে!
কিন্তু শেষে গ্রেপ্তার হয়ে যখন দেখলেন যে চার্লস টেগার্টই তাঁকে অভ্যর্থনা করতে উপস্থিত তখন তাঁর আর আফসোসের সীমা রইল না। আদতে গোপীনাথ সাহার রিভলবার থেকে চালানো গুলিতে মারা গিয়েছিলেন কিলবার্ণ কোম্পানির অফিসার আর্নেস্ট ডে। খুব দ্রুত বিচারে গোপীনাথ সাহার ফাঁসির হুকুম হয়। ১লা মার্চ ১৯২৪ সালে তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়। কিন্তু ঘটনার শেষ এখানেই নয়। ফাঁসির আদেশকে গোপীনাথ সাহা সাদরে গ্রহণ করেছিলেন এবং বলেছিলেন, ‘আমার প্রতিটি রক্তবিন্দু, ভারতের ঘরে ঘরে রক্তবীজের মত স্বাধীনতা সংগ্রামী সৃষ্টি করুক’। গোপীনাথের মৃত্যুর পূর্বের সবকথা জানা যায় নি। তবে ‘Institute of Historical Studies’ থেকে যে ‘Dictionary of National Biography’ প্রকাশিত হয়েছিল, তা থেকে কিছুটা ইংরেজি তর্জমা তুলে দিলাম, যা গোপীনাথ ফাঁসির কুঠুরি থেকে তাঁর সাথে শেষ বারের জন্য দেখা করতে আসা তাঁর মা কে বলেছিলেন বলে বইতে উল্লেখ আছে –
“… That you are my mother, this is your glory. There is nothing to bewail. Let every mother give birth to a courageous son of your type and this illumine the face of mother India.”
গোপীনাথ সাহার ফাঁসিতে দেশবন্ধু ভীষণভাবে মর্মাহত হয়েছিলেন। তিনি নিজে এই বিষয়ে কলকাতা পৌরসভার পৌর অধিবেশনে শোকপ্রস্তাব উত্থাপন করেন ২৭শে জুন ১৯২৪ সালে। কিন্তু তাঁর উত্থাপিত সেই শোক প্রস্তাব ৭৮-৭০ ভোটে পরাজিত হয়! শহীদ গোপীনাথ সাহার মৃত্যু নিয়ে এর চেয়ে লজ্জাজনক তথ্য আর কি হতে পারে।
(তথ্যসূত্র:
১- মুক্তির মন্দির সোপান তলে, দীপক কুমার রায় ও অরুণা চৌধুরী।
২- বৃটিশ-বিরোধী বিপ্লবীদের জীবনকথা, তপন কুমার দে, জাগৃতি প্রকাশনী।
৩- যা ইতিহাসে নেই, বিমল মিত্র, বিপ্লবীদের কথা (২০১৪)।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত