কথায় বলে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। সারা বছর ধরেই নানারকমের ধর্মীয় এবং সামাজিক অনুষ্ঠান লেগেই রয়েছে। তা এই নানান পার্বণের সঙ্গে জুড়ে থাকা গল্পগুলি সাথে আমরা তো অনেকটাই পরিচিত। আজকেও সেইরকম এক পার্বণের দিন। আজ কার্তিকপুজোর দিন। যদিও মা-দুর্গার বাকি ছেলেমেয়েদের – লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশের পুজো নিয়ে বাঙালিরা সর্বজনীনভাবে যতটা হইচই করে, কার্তিক ঠাকুরের পুজো নিয়ে সেরকম বিরাট হইচই সর্বত্র হয়না, কিন্তু তাহলেও, কার্তিক ঠাকুরও আমাদের লোকসংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, তাই তাঁকে নিয়েও আলোচনা করা উচিত।
হর-পার্বতীর আদরের ছোট পুত্র কার্তিক। গণেশ তাঁর দাদা। তবে কোনও কোনও পুরাণে কার্তিককে বড় এবং গণেশকে ছোট পুত্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব নিয়ে নানা মতপার্থক্যও আছে। কার্তিক দেবসেনাপতি। তারকাসুরের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য দেবতারা একজন শৌর্য-বীর্যসম্পন্ন দেবসেনাপতির খোঁজ করছিলেন। অবশেষে সকলে মিলে মহাদেবের শরণাপন্ন হলেন তপস্যা ভঙ্গ করে অন্তত যাতে একটা পুত্র তিনি দেবতাদের উপহার দেন। এতে শিব সম্মত হয়ে পুত্রলাভের নিমিত্ত পার্বতীর কাছে যান। কিন্তু শিবের মনোবাসনা পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই দেবতারা তাঁর দরবারে হাজির হলেন। মহাদেবের তেজ গিয়ে পড়ল পৃথিবীতে। বসুন্ধরা এই তেজ সহ্য করতে না পেরে তা অগ্নিতে নিক্ষেপ করলেন। অগ্নি আবার সেই মহাতেজ শরবনে নিক্ষেপ করলেন। আর এই শরবনেই একটি সুন্দর সন্তানের জন্ম হল। ঠিক এই সময় ছয়জন কৃত্তিকা (অগ্নির ছয় পত্নী) সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন।
তাঁরা শিশুসন্তানটিকে আদর করে বাড়ি নিয়ে গিয়ে মানুষ করতে থাকেন এবং স্নেহ ভরে নাম রাখেন কার্তিক। কার্তিকের অন্য নাম হল স্কন্দ, কুমারেশ, কুক্কুটধ্বজ প্রভৃতি। কার্তিকের দেহ তরুণ সূর্যসদৃশ, জ্যোতিস্বরূপ, সুকুমার, তপ্তকাঞ্চনবর্ণ, শক্তিধারী, দ্বিভুজ, উন্নত চক্ষু।তিনি সর্বদা সৈন্যদলের পুরোভাগে অবস্থান করেন। কার্তিকের জন্ম নিয়ে আরও নানা কাহিনি প্রচলিত আছে। যাই হোক, পরে পার্বতী অতি সুন্দর ও লাবণ্যময় কার্তিকের জন্মসংবাদ পেয়ে তাঁকে বাড়ি নিয়ে আসেন। কৃত্তিকা নক্ষত্রে তাঁর জন্ম হয়েছিল এবং ছয় কৃত্তিকার দ্বারা তিনি পুত্ররূপে গৃহীত ও প্রতিপালিত হন বলে তাঁর নাম কার্তিকেয় বা কার্তিক।
ময়ূর কার্তিকের বাহন। ময়ূর ভারতের জাতীয় পাখি। অসাধারণ কর্মতৎপর এই পক্ষী খুবই সুন্দর দেখতে। সৈনিক পুরুষের নানা গুণ ময়ূরকে বাহন করতে সাহায্য করেছে। ময়ূর খুব সামান্যই নিদ্রা যায়। সর্বদা সতর্ক। আলস্যহীন। ময়ুরের স্বজনপ্রীতি লক্ষণীয়। সৈনিক পুরুষ ময়ূরের মতো অনলস, কর্মকুশল এবং লোকপ্রিয় হবেন তা বলাই বাহুল্য। তাছাড়া, ময়ূর মেঘ দেখলে যেমন আনন্দে পেখম তুলে নৃত্য করে, তেমনই ধীর ব্যক্তি শত বিপদেও উৎফুল্ল থাকবেন। সম্ভবত এই সব কারণেই কার্তিকের বাহন ময়ূর।
কার্তিকেয় বা কার্তিক হিন্দু যুদ্ধদেবতা। তিনি শিব ও দুর্গার সন্তান। কার্তিক বৈদিক দেবতা নন; তিনি পৌরাণিক দেবতা। প্রাচীন ভারতে সর্বত্র কার্তিক পূজা প্রচলিত ছিল। উত্তর ভারতে ইনি এক প্রাচীন দেবতা রূপে পরিগণিত হন। অন্যান্য হিন্দু দেবদেবীর মতো কার্তিকও একাধিক নামে অভিহিত হন। যথা – কৃত্তিকাসুত, আম্বিকেয়, নমুচি, স্কন্দ, শিখিধ্বজ, অগ্নিজ, বাহুলেয়, ক্রৌঞ্চারতি, শরজ, তারকারি, শক্তিপাণি, বিশাখ, ষড়ানন, গুহ, ষান্মাতুর, কুমার, সৌরসেন, দেবসেনাপতি ইত্যাদি। দেবলোকে যেখানেই যুদ্ধ হয় সেখানেই কার্তিকের ডাক পড়ে।
পুরাণ অনুসারে হলুদবর্ণের কার্তিকের ছটি মাথা। তাই তাঁর অপর নাম ষড়ানন। যুদ্ধের দেবতা বলে নাকি তাঁর ছটি মাথা। চারিদিক থেকে তাঁর লক্ষ্য অবিচল। পাঁচটি ইন্দ্রিয় অর্থাত চোখ, কান, নাক, জিভ ও ত্বক ছাড়াও একাগ্র মন দিয়ে তিনি যুদ্ধ করেন। তাঁর হাতে থাকে বর্শা-তীর-ধনুক।
আবার কারো মতে মানব জীবনের ষড়রিপু- কাম (কামনা), ক্রোধ (রাগ), লোভ (লালসা), মদ (অহং), মোহ (আবেগ), মাত্সর্য্য (ঈর্ষা) কে সংবরণ করে দেব সেনাপতি কার্তিক যুদ্ধক্ষেত্রে সদা সজাগ থাকেন। এই ষড়রিপু মানুষের জীবনের অগ্রগতির বাধা তাই জীবনযুদ্ধে জয়লাভ করতে গেলেও কার্তিকের মত সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে।
পুরাণমতে তিনি তরুণ সদৃশ, সুকুমার, শক্তিধর এবং সর্বসৈন্যের পুরোভাগে অবস্থান করে। তাই মাদুর্গার যুদ্ধযাত্রায় এমন শৌর্যবীর্য সম্পন্ন পুত্র সঙ্গী না হয়ে যায় কোথায়!
কোনো কোনো মতে রণ-দেবতা কার্তিক হলেন আকুমার ব্রহ্মচারী। আবার কোনো কোনো পুরাণ মতে কার্তিকের পত্নী হলেন ইন্দ্রের কন্যা দেবসেনা বা লক্ষ্মীরূপিণী ষষ্ঠী।
ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় দক্ষিণ ভারতে কার্তিকের পূজা অধিক জনপ্রিয়। তামিল ও মালয়ালম ভাষায় কার্তিক মুরুগান বা মায়ূরী কন্দসামী নামে এবং কন্নড় ও তেলুগু ভাষায় তিনি সুব্রহ্মণ্যম নামে পরিচিত। তামিল বিশ্বাস অনুযায়ী মুরুগান তামিলদেশের (তামিলনাড়ু) রক্ষাকর্তা। দক্ষিণ ভারত, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া ও মরিশাস – যেখানে যেখানে তামিল জাতিগোষ্ঠীর প্রভাব বিদ্যমান সেখানেই মুরুগানের পূজা প্রচলিত। শ্রীলঙ্কার দক্ষিণাংশে কার্তিকেয়ের উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত কথারাগম (সিংহলি ভাষায় “কথারাগম দেবালয়”) মন্দিরে হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
এখানে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে কার্তিক পূজা নিয়ে কিছুটা তথ্য দেওয়া প্রয়োজন। বাংলার লোকসংকৃতি এবং লৌকিক দেবদেবীদের ওপরে যেমন বৌদ্ধধর্মের প্রভাব লক্ষ্যনীয়, ঠিক তেমনই এর উল্টোটাও হয়েছে। বাংলাদেশ তথা বৃহত্তর চট্টগ্রামের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভিন্ন পূজা অর্চনা, লোক সংস্কৃতি ও আচার অনুষ্ঠান প্রচলিত আছে। এ সকল ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কার, পূজা-পার্বণ ও লোকাচারসমূহ সাধারণত পুরনো আস্তর নামে খ্যাত হয়ে থাকে। এটি শাস্ত্র শব্দের বিকৃত রূপ (হাস্তর>শাস্তর>শাস্ত্র)। প্রাচীন কালে এখানকার বৌদ্ধ অধিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত লৌকিক সংস্কৃতির আচার অনুষ্ঠানসমূহ শাস্ত্র বাক্য জ্ঞানে একান্ত ভাবে বিশ্বাস ও আচরণ করা হত বলে শাস্ত্র শব্দটি আঞ্চলিক উচ্চারণে ‘হাস্তর’ রূপ প্রাপ্ত হয়েছিল এবং তা প্রাচীন কাল থেকে পুরানো শব্দটি যুক্ত হয়ে ‘পুরানো হাস্তর’ নামে খ্যাত হয়ে এসেছে। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকের মধ্যভাগ হতে বড়ুয়া বৌদ্ধদের আর্যধর্ম, সভ্যতা, সংস্কৃতি, ভাষা ও লিপি প্রচারিত হয়। বাঙালি বড়ুয়া ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের মতে, প্রাচীন কাল থেকে বিভিন্ন কুসংস্কার, লোকবিশ্বাস, লোক সংস্কৃতি ও আচার অনুষ্ঠানসমূহের প্রথম গোড়াপত্তন হয়েছিল।
সহজ সত্য চিরকালই এক, কিন্তু সেই সহজ সত্যই মানুষ বারংবার ভুলে যায়। তথাগত বুদ্ধ সেই বিস্মৃত সত্য সরল ও হৃদয়স্পর্শী কথায় বলেছেন, সুবিজ্ঞভুত ক্রিয়াকর্মের আবর্জনা উড়িয়ে দিয়ে মানুষকে সত্যের উজ্জ্বল মুক্তি দেখিয়েছিলেন। ধর্মের প্রাণ হচ্ছে ‘বিশুদ্ধ বিশ্বাস’ (belief) । এই বিশ্বাসকে কেন্দ্র করেই আসে সামাজিক জীবনাচরণ ও সংঘবদ্ধতা। ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনকে ধর্মীয় দিক থেকে সংহিত করার জন্য প্রতিটি সমাজেই ক্রিয়া ও অনুষ্ঠানের প্রয়োজন। প্রত্যেক ধর্মেরই ধর্মীয় গ্রন্থ আছে (কখনো মৌখিক), আছে তার পবিত্র ভাষা, আছে মন্ত্র স্তোত্র ইত্যাদি। বৌদ্ধধর্মের উৎপত্তি যেহেতু প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে তাই তখনকার যুগ আর এখনকার যুগ এবং জ্ঞান মেধা ও প্রজ্ঞায় পার্থক্য দেখা যায়। এ সময় মানুষ আদিম (Primitive) কুসংস্কার (Superstition) ও লৌকিক (Earthly) সংস্কৃতির বেড়াজালে আবদ্ধ ছিল কিন্তু সেই কুসংস্কার অনিয়ম অপসংস্কৃতিগুলো আজও ধর্ম ও সমাজে বিদ্যমান। এগুলো সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে। বৌদ্ধ সমাজে বিশেষত Religious Rituals and Falk Belief ব্যাপক ভাবে প্রচলিত রয়েছে।
একবিংশ শতাব্দীতে জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রসার লাভ ও চর্চার ফলে তার আড়ষ্টতা কিছুটা শিথিল হলেও এখনকার লোকজীবন থেকে তা একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। তাই সমগ্র বৌদ্ধধর্মে তথা বাঙালি বড়ুয়া বৌদ্ধদের মধ্যে লোক সংস্কৃতি ও আচার অনুষ্ঠানের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। একটু সচেতন ভাবে দেখলে বুঝতে পারা যায় যে, বাঙালি বড়ুয়া ও পার্বত্য বৌদ্ধদের আচার-অনুষ্ঠান, ধর্মীয় ও সামাজিক লোক সংস্কৃতির প্রতিটি বিষয়ে লৌকিকতা বিদ্যমান। বাংলাদেশের বৌদ্ধেরা সেকালের যুগে ধ্যান-জ্ঞান, শিক্ষা-দীক্ষা ও শিল্পকলায় অগ্রসর ছিল ঠিক কিন্তু তাঁরা লৌকিকতা (Worldlienss) বর্জিত ছিলেন না। সেকালের প্রাপ্ত লোক সংস্কৃতি ও আচার অনুষ্ঠানগুলো থেকে বৌদ্ধরা মুক্ত হতে পারেন নি, ছাড়তে পারেন নি, পরিহার করতে পারেন নি। খ্রিষ্ঠপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতের চিন্তারাজ্যে এক তুমুল বিপ্লব ঘটেছিল। বহু শতাব্দী ধরে এদেশের হিন্দু আর্যগণ যে ধর্মীয় প্রভাব গড়ে তুলে ছিল তার আমূল পরিবর্তন সাধন করেন গৌতম বুদ্ধ। মূলত আধুনিক কালে হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের প্রভাব এবং সামাজিক লোকাচার ও সংস্কৃতির ধারা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান ও রীতি-নীতি সরব হয়ে উঠে।
বর্তমান বাঙালি হিন্দু সমাজের অধিকাংশ লৌকিক দেবদেবী ও আচার অনুষ্ঠান আজ বৌদ্ধদের ঘরোয়া আচারে ও প্রাচীন ধর্মীয় সংস্কারে রয়ে গেছে। প্রচলিত অনেকগুলি আবার হিন্দু ও মুসলমানের ধর্মীয় ও সামাজিক রীতি রেওয়াজ। বর্তমান বিশ্বায়ন হল যুক্তি তত্ত্ব ও কম্পিউটার বিজ্ঞান প্রযুক্তির যুগ। এ যুগের মানুষ বস্তুবাদে বিশ্বাসী, বাস্তবতায় বিশ্বাসী। বৌদ্ধধর্ম শাস্ত্রে লৌকিকতা ও অলৌকিকত্বকে সহজে মেনে নিতে পারে না। বাংলাদেশের বৌদ্ধরা থেররাদ আদর্শের অনুসারী। থেরবাদে প্রতিষ্ঠিত হলেও বৌদ্ধদের প্রকৃত আচরণে, বিনয় বিধানের অন্তরালে থাকে বিভিন্ন কুসংস্কার, লোক বিশ্বাস, আচার-আচরণ, পূজা-পার্বণ ও লৌকিক সংস্কৃতি। এমন কি ধর্মের তত্ত্বাশ্রিত আবেদন লৌকিক ধারায় নেমে এসে ধর্মের অলৌকিকত্বের বেড়া ভেঙ্গে জীবনাশ্রিত সংস্কৃতি হিসেবে রূপ লাভ করেছে। এর অসংখ্য উদাহরণ সমতলি বাঙালি বড়–য়া ও পার্বত্য নৃতাত্ত্বিক ক্ষুদ্র আদিবাসী বৌদ্ধদের মধ্যে সচরাচর বিদ্যমান।
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে বাংলাদেশের বৌদ্ধরা বুদ্ধের প্রকৃত ধর্মদর্শন ও বিনয়নীতি সম্বন্ধে মোটেই অবহিত ছিলেন না। পাল ও গুপ্ত যুগের পরে বৌদ্ধধর্ম ক্রমশ নিজ বৈশিষ্ট্য হারিয়ে নানা কুসংস্কার ও লৌকিকতায় বিশ্বাসী হয়ে পড়েছিল – এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। বৌদ্ধধর্মের তাদৃশ বিপর্যয় বৌদ্ধদের ধর্ম ও সমাজ জীবনে দারুণভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল। উল্লেখ যে বেন্ডেল সাহেবের মতে, ১৪৪৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশে প্রাচীন বৌদ্ধধর্ম পুঁথি লিখিত হয়েছিল। বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্মের প্রধান দুটি ধারা থেরবাদ ও মহাযান প্রভাবান্বিত ছিল। বিশেষত লৌকিকতা ও বিভিন্ন মতাদর্শের কারণে পাল ও চন্দ্র বংশের রাজাদের রাজত্ব কালে বাংলাদেশে মহাযান ধর্মের প্রসার ঘটে। এই সময় তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের চারটি বিশেষ শাখা – বজ্রযান, কালচক্রযান, মন্ত্রযান, তন্ত্রযান ও সহজযান বাংলাদেশে নিজ নিজ প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত করে। বর্তমান বিশ্বে মূলত হীনযান ও মহাযান এ দুটি ধারা বিদ্যমান। বাংলাদেশে মূলত থেরবাদ আদর্শের সংঘরাজ নিকায় ও মহাস্থবির নিকায় এ দু’সংঘ ধারা প্রচলিত আছে। এ শুধু বৌদ্ধধর্মে নয় প্রত্যেক ধর্ম এ রকম শ্রেণিভেদ লক্ষ্য করা যায়। যেমন- হিন্দুধর্মে শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব; মুসলিম ধর্মের শিয়া ও সুন্নি এবং খ্রিষ্টান ধর্মে ক্যাথলিক ও প্রোটেস্টান্ট। এ সমস্ত শাখা প্রশাখা ও মতভেদের জন্য এ সমস্ত লৌকিক ক্রিয়াকলাপ, আচার ও সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
“আশ্বিনে রান্না, কার্তিকে খায়
যে রব মাগে সে রব পায়।”
যে রব মাগে অর্থাৎ প্রার্থনা করে তা পূরণের আশায় মানুষ এ কার্তিক পূজা বা কার্তিকের পান্তা ভাত রান্না করে থাকে। বস্তুত এ কার্তিক পূজা হিন্দুধর্মের অন্যতম প্রধান পূজা। এ পূজা বাঙালি বৌদ্ধ সমাজে বহুল ভাবে সমাদৃত। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল বা স্থান বিশেষে বড়ুয়া বৌদ্ধরা এ কার্তিক পূজা বা কার্তিকের ভাত রান্না করে থাকেন। বাঙালি বৌদ্ধদের মাঝে প্রচলিত আছে যে কোন লোক যদি তাঁর মনের আশা, বা অভাব অনটন, দুঃখ মুক্তি, যশখ্যাতি অর্জন ইত্যাদি থেকে বা উন্নতি লাভ করার জন্য যদি এ কার্তিক পূজা করা হয় তা হলে তাঁর সে আশা পূরণ হয়। যদিও বৌদ্ধ পণ্ডিত ও বিশেষজ্ঞদের মতে, লোক সমাজে এ পূজার কোন বাস্তব ভিত্তি নেই। এটি লৌকিক কুসংস্কার ছাড়া আর কিছু নয়। এ ধরনের অনেক অলৌকিক অবাস্তব কাল্পনিক ও কুসংস্কার পরিপন্থী পূজার কথা প্রচলিত আছে এবং মানুষ তা অনুসরণ করছে। আসলে এসব লৌকিক পূজা পার্বণ।
বাংলায় কার্তিক সংক্রান্তির সাংবাৎসরিক কার্তিক পূজার আয়োজন করা হয়। পূর্বের তুলনায় এখন কার্তিক জনপ্রিয়তা কিছুটা কমেছে। পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার চুঁচুড়া-বাঁশবেড়িয়া কাটোয়া অঞ্চলের কার্তিক পূজা বিশেষ প্রসিদ্ধ। এছাড়া বাংলার গণিকা সমাজে কার্তিক পূজা বিশেষ জনপ্রিয়। দুর্গাপূজা সময়ও কার্তিকের পূজা করা হয়। কলকাতাতে তাঁর মন্দির আছে।
কার্তিক ঠাকুরের সাথে ছয় সংখ্যা জড়িয়ে আছে৷ সেজন্য হয়ত স্ত্রী ষষ্ঠীর সাথে তাঁর মিল৷ তিনি শিশু বড় না হওয়া অব্দি তাঁদের বিপদ থেকে রক্ষা করেন৷ তাঁর কৃপা পেলে পুত্রলাভ, ধনলাভ হয়৷ সেজন্য বিয়ে হয়েছে কিন্তু এখনও সন্তান আসেনি এমন দম্পতির বাড়ির সামনে কার্তিক ঠাকুরের মূর্তি ফেলা হয়। সুঠাম গড়নের ল্যাংটো কাটোয়ার কার্তিক লড়াই খুব বিখ্যাত। কাটোয়ার কার্তিক পুজো বিখ্যাত বলেই এখানে এক পুজোর সঙ্গে অন্য পুজোর প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে কার্তিক লড়াই বলে। কার্তিক পুজোর দিন পথে কাটোয়ায় এক বড়সড় মিছিল নামে। সব পুজো-মণ্ডপের দলবল তাদের ঠাকুর নিযে বেরোয় শোভাযাত্রায়। চলে লড়াই কার ঠাকুর আগে যাবে। এ যুদ্ধ রীতিমতো লাঠিসোটা, এমনকী তরোয়াল নিয়েও চলে। হালিশহরের ‘জ্যাংড়া কার্তিক’ ও ‘ধুমো কার্তিক’ পূজাও খুব বিখ্যাত। এভাবেই যুদ্ধ আর সন্তান উৎপাদন- দুইয়ের অনুষঙ্গেই কার্তিককে স্মরণ করে বাঙালি।
দক্ষিণ ভারতে তিনি খুব জনপ্রিয়। সেখানে তাঁর অসংখ্য মন্দির আছে। তবে তামিলনাড়ুর ৬টি মন্দির খুব পবিত্র। সেগুলি হল- স্বামীমালাই মুরুগান মন্দির, পালানী মুরুগান মন্দির, থিরুচেন্দুর মুরুগান মন্দির, থিরুপ্পারামকুমারাম মুরুগান মন্দির, থিরুথানি মুরুগান মন্দির, পাঝামুদিরচোলাই মুরুগান মন্দির।
দেবতারূপে কার্তিক একসময়ে সারা ভারতীয় উপমহাদেশেই খুব জনপ্রিয় ছিলেন। ভারতীয় পুরাণগুলির মধ্যে স্কন্দ পুরাণে কার্তিকের বিষয়ে সবিস্তারে লেখা আছে। তাছাড়াও মহাভারতে এবং সঙ্গম তামিল সাহিত্যে কার্তিকের নানা বর্ণনা রয়েছে। আমাদের জাতীয় যাদুঘরে (ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে) বারোটি হাত যুক্ত কার্তিকের একটি অভিনব মূর্তি রক্ষিত আছে।
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে উত্তর ভারতে কার্তিকের প্রভাব কমে আসে। আরাধ্য দেবতা রূপে কার্তিক উত্তর ভারতীয়দের থেকে অনেক বেশি জনপ্রিয় দক্ষিণ ভারতে। আধুনিক বাঙালিদের মধ্যে কার্তিক ঠাকুর পুজো নিয়ে খুব বেশি হইহুল্লোড় হয় না। দুর্গাপুজোর পরেপরেই কিছুদিনের মধ্যেই কার্তিকমাসের সংক্রান্তিতে হয় কার্তিকের পুজো।
কোন কোন প্রাচীন পরিবারে ধারাবাহিকভাবে, এবং এক-দুটি বিশেষ অঞ্চলে খুব হইচই করে এই পুজো হয়; কিন্তু সর্বজনীন পুজো হিসাবে কার্তিকপুজো বাঙালি সমাজে এখন আর সেরকম জনপ্রিয় নয়। সেই রকমের একটি প্রাচীন কার্তিক পূজা হয় পশ্চিম বর্ধমান জেলার পাল পরিবারে। বর্ধমান (পশ্চিম বর্ধমান) জেলার গৌরবাজার (পান্ডবেশ্বর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে) নামে এক গ্রামে বিগত ১৬৬ বছর ধরে এই পুজো হয়ে আসছে বলে অনুমান। এই পুজোর বিশেষত্ত হল তিনটি কার্তিক, বড় কার্তিক, মেজো কার্তিক, ছোটো কার্তিক। অনেকের কাছে বিষয়টা অদ্ভূত এবং কৌতূহলের, যে পুজো হলে তো একটি কার্তিকের হবে, এখানে একই ঠাকুরের তিনটি মূর্তি কেনো? উত্তর লুকিয়ে আছে ইতিহাসের পাতায়। বিঘা বিঘা জমি, বর্ধমান রাজাদের তত্ত্বাবধানে পালদের জমিদারির তখন রমরমা। সারা গ্রাম থেকে আশে পাশের গ্রামে পালে দের জমিদারি ছিল বিশেষ। জানা যায় আনুমানিক ১৮৫৩ সাল নাগাদ জমিদার জয় নারায়ণ পাল, শ্যামপাল, লক্ষী নারায়ণ পালের কোনো সন্তান জন্ম না হওয়ায়, তাঁরা চরম চিন্তায় ছিলেন। অনেক উপায় অবলম্বন করেও কোনও সুরাহা হয় নি। তখন এক রাত্রে স্বপ্ন আদেশে জয় নারায়ণ পাল দেখেন যে নিঃস্বার্থ কার্তিক পুজো করতে হবে তাঁদের তিন ভাই কে। তবেই তাঁদের শুন্য কোল আলো হবে। তাই তাঁরা তিন ভাই মিলে অভিনব ভাবে মন্দির তৈরি করে একসাথে তিনটি কার্তিক পূজা করা শুরু করেন। এবং তারপরে আনুমানিক ১৮৫৭ সালে লক্ষী নারায়ণ পালের এক পুত্র সন্তান লাভ হয়, নাম ধ্বজাধারি পাল, এবং আরো দুই ভাই এর একটি করে কন্যা সন্তান লাভ হয়। সেই সৌভাগ্যবসত পরম্পরা অনুযায়ী পুজো করে আসছেন বংশধরেরা এবং এই সন্তান না হওয়ার অন্ধকার এই বংশকে আর এসে ঘিরে ধরেনি। এই পুজো আজও বর্তমান।
(তথ্যসূত্র:
১- বাংলার লোকসংস্কৃতি, ড. আদিত্য মুখোপাধ্যায়, অমর ভারতী (২০০৯)।
২- বাংলার লোকসংস্কৃতি চর্চা, সুভাষ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, একুশ শতক (২০০৯)।
৩- বাংলার লৌকিক দেবতা, গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু, দে’জ পাবলিশিং (২০১৫)।
৪- বৌদ্ধ সংস্কৃতি বনাম বাঙালি সংস্কৃতি, ড. জিতেন্দ্র লাল বড়ুয়া, অন্যধারা (২০১৪)।
৫- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৬ই নভেম্বর ২০১৭ সাল।
৬- উইকিপিডিয়া।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত