দীর্ঘদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে মাসখানেক আগেই প্রকাশিত হয় আসামের জাতীয় নাগরিকপঞ্জী বা এনআরসি-র চূড়ান্ত তালিকা। যা থেকে বাদ গিয়েছে ১৯ লক্ষ ৬ হাজার ৬৫৭ জনের নাম। যাঁদের মধ্যে অধিকাংশই বাঙালি। এঁদের মধ্যেই একজন হাইলাকান্দির সাবিত্রী রায়। গায়ে আগুন দিয়ে ‘বেঁচে গেছেন’। কিন্তু কাবেরী দত্তেরা প্রতিনিয়ত জ্বলেপুড়ে মরছেন। এনআরসি তালিকা প্রকাশের পর চরম অনিশ্চয়তা গ্রাস করেছে কাবেরীর মতো অনেককেই। ভারতীয় হয়েও ‘বিদেশি’ হওয়ার ভয় গিলে ফেলেছে তাঁদের।
হাইলাকান্দি শহরের বুকে সাবিত্রীর বরের দোকান। স্টেশনারি থেকে চা, মিষ্টি সবই পাওয়া যায়। সাবিত্রীর স্বামী দেবব্রত রায় জানালেন, রোজগার মন্দ নয়। বাড়িতে সাত ঘর ভাড়াটেও রয়েছে তাঁদের। ১৯ বছরের দাম্পত্য জীবন ভালই চলছিল। কিন্তু এনআরসির তালিকা শেষ করে দিল তাঁর সুখের সংসার। ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার মঠ চৌমুহনির মেয়ে সাবিত্রীকে বিয়ে করেছিলেন দেবব্রত। তিনি নিজে বিজেপির সমর্থক। তবু চূড়ান্ত খসড়ায় তাঁদের দু’জনেরই নাম ছিল না। পরে তাঁর নাম ওঠে। কিন্তু বাদ যায় বউয়ের নাম।
এরপর বউয়ের নাম তোলার চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি দেবব্রত। ত্রিপুরা থেকে ১৯৬৬ সালে তাঁর শ্বশুর-শাশুড়ির ভোটার তালিকায় নামের সার্টিফায়েড কপিও জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনও কাজ হয়নি। মেয়ে দীপিকাকে (১৫) মাতৃহারা করে ৪ সেপ্টেম্বর দুপুরে গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেন সাবিত্রী। তার আগে থেকেই বিষণ্ণতা তাঁকে গ্রাস করেছিল। বাথরুমে ঢুকে গায়ে আগুন দিয়ে শেষ করে দেন নিজেকে, এনআরসি-ছুট সাবিত্রী। তার পর অবশ্য বিজেপির স্থানীয় নেতারা তাঁর দেহ নিয়ে রাজনীতি কম করেননি। বিজেপি করে লাভ যে হয়নি, এখন সেটা বউ হারানোর পর বেশ বুঝেছেন দেবব্রত।
দেবব্রতর দোকানের কাছেই বাড়ি কাবেরী দত্তর। তাঁর শ্বশুরবাড়িও বাপের বাড়ির কাছেই। ছোট্ট একচালার ঘর। নিস্তব্ধতা যেন গিলে খেতে চাইছে বাড়িটিকে। অথচ এক সময় যে বাড়িটিতে সচ্ছলতা ছিল, তার ছাপও বেশ স্পষ্ট। কিন্তু সব শেষ করে দিয়েছে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল। এখন সেখানে শুধুই হাহাকার। আর্তনাদ বেঁচে থাকার। এবং বাচ্চাদের বাঁচিয়ে রাখার। সঙ্গে রয়েছে বৃদ্ধ বাবাকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনার অসম লড়াই। প্রতি পদে খরচ আর খরচ! সব মিলে দিশেহারা কাঞ্চন দত্তের (৫২) একমাত্র সন্তান কাবেরী।
তাঁর প্রশ্ন, ‘আমার বয়স মাত্র ৩২। দুটি বাচ্চা আছে। স্যর, এই বয়সে কি আমি জেলে যাব?’ কাবেরীর বাবা এক সময় ড্রাইভারি করতেন। অসুস্থ বলে তাঁকে কাজ করতে দিতেন না কাবেরী আর তাঁর মা পাপিয়া দত্ত। পাপিয়াদেবী অাসাম সরকারের স্বাস্থ্য দফতরের গ্রুপ ডি কর্মী। আর কাবেরীও হাইলাকান্দি হাসপাতালের ‘ওয়ার্ড গার্ল’। বরের ব্যবসা আছে। কিন্তু এনআরসিরও আগে ডি-ভোটার ‘শনি’ তাঁদের সংসারে সর্বনাশ ডেকে আনে। কাবেরীর বাবা কাঞ্চন দত্তের নামে ‘শত্রুতা করে’ কেউ বিদেশি ট্রাইব্যুনালে নালিশ জানায়।
১৯৭১-এর বহু আগে আসা মানুষটি নিজেকে অনেক পয়সা খরচ করে আইনি যুদ্ধ করেও ভারতীয় বলে প্রমাণ করতে পারেননি। অথচ ভোটার-তালিকা থেকে শুরু করে রেশন কার্ড, সবই ছিল তাঁর। ২০১৬-র ২৪ জুন তাঁকে বিদেশি বলে ঘোষণা করে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল। ভরা হয় শিলচর জেলের ডিটেনশন ক্যাম্পে। তিন বছর হয়ে গেছে। অনেক কষ্টে দু’লাখ টাকার জামানত ও দু’জন ভারতীয় জামিনদারও জোগাড় করেছেন তাঁরা। তবু ছাড়া পাচ্ছেন না কাঞ্চন দত্ত। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশও মানা হচ্ছে না। জেলে ‘চরম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে’ দিন কাটাচ্ছেন কাঞ্চন।
আর বাইরে মেয়ে ছটফট করছে আতঙ্কে। কেননা এনআরসি তালিকায় নাম ওঠেনি তাঁর। কারণ এখনও জানেন না তিনি। তবে কারণ না জানলেও তাঁকে যেতে হবে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালেই। সেখানেই ‘কাজির বিচার’ ঠিক করবে তাঁর ভাগ্য। তাই ভয়ে জ্বলেপুড়ে মরছেন কাবেরী। এক দিকে বাবাকে ছাড়িয়ে আনার লড়াই, অন্য দিকে আবার নিজেকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে প্রমাণ করার তাগিদ। দুই বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে কাবেরীর লড়াই।
সাবিত্রী বা কাবেরী উদাহরণ মাত্র। হাইলাকান্দিতে অাসাম রাজ্য নাগরিক অধিকার সুরক্ষা সমন্বয় সমিতির হয়ে বিপন্ন নাগরিকদের নিয়ে কাজ করছেন সুশীল পাল। তিনি ও তাঁর সঙ্গের অন্যরাও জানালেন এনআরসির নামে মানুষকে কীভাবে নিঃস্ব করা হচ্ছে। বিচারের নামে চলছে প্রহসন। বিশেষ করে বিবাহসূত্রে ত্রিপুরা বা পশ্চিমবঙ্গ থেকে কোনও মহিলা অাসামে এলে তাঁকে নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে। বিয়ের পর পদবি পরিবর্তনের পাশাপাশি কাজ করছে জাতিবিদ্বেষও, এমনটাই মনে করছেন হাইলাকান্দির অনেকেই। প্রায় ১০০ শতাংশ বাঙালির বাস এই শহরটিতে। কিন্তু তার পরও বাঙালির ওপর মানসিক ও সামাজিক নির্যাতন চলছেই।