(ছবিতে – মেদিনীপুরের পটচিত্রে সপরিবারে দেবী দুর্গা।)
পটচিত্র কি?
বাংলার পটচিত্র, পট বা বস্ত্রের উপর আঁকা একপ্রকার লোকচিত্র। এটি প্রাচীন বাংলার (বাংলা ভাষাভাষী অধ্যুষিত অঞ্চল) অন্যতম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। প্রাচীনকালে যখন কোন রীতিসিদ্ধ শিল্পকলার অস্তিত্ব ছিলনা তখন এই পটশিল্পই বাংলার শিল্পকলার ঐতিহ্যের বাহক ছিল। যারা পটচিত্র অঙ্কন করেন তাদেরকে সেযুগে এবং এযুগেও পটুয়া বলা হয়।
পট কি?
পট শব্দের প্রকৃত অর্থ হল কাপড়। শব্দটি সংস্কৃত “পট্ট” থেকে এসেছে। বর্তমানে এই শব্দটিকে ছবি, ছবি আঁকার মোটা কাপড় বা কাগজের খন্ড ইত্যাদি অর্থেও ব্যবহার করা হয়। পটের উপর তুলির সাহায্যে রং লাগিয়ে বস্তুর রূপ ফুটিয়ে তোলাই পট চিত্রের মূলকথা। এতে কাহিনী ধারাবাহিক ভাবে চিত্রিত হতে থাকে। অন্তত আড়াই হাজার বছর ধরে পটচিত্র এ উপমহাদেশের শিল্প জনজীবনের আনন্দের উৎস, শিক্ষার উপকরণ এবং ধর্মীয় আচরণের অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে।বাংলাদেশের পটচিত্রের মধ্যে গাজীর পট ও কালীঘাটের পট উল্লেখযোগ্য। পট মূলত দুই ধরনের হয়, যথা:
১) জড়ানো পট: এ ধরনের পট ১৫-৩০ ফুট লম্বা এবং ২-৩ ফুট চওড়া হয়।
২) চৌকা পট: এগুলোর আকার ছোট হয়।
কাপড়ের উপর গোবর ও আঠার প্রলেপ দিয়ে প্রথমে একটি জমিন তৈরি করা হয়। সেই জমিনের উপর তুলি দিয়ে বিভিন্ন চিত্র অঙ্কিত হয়।
কাপড়ের উপর কাদা, গোবর ও আঠার প্রলেপ দিয়ে প্রথমে জমিন তৈরি করা হয়। তারপর সেই জমিনে পটুয়ারা তুলি দিয়ে বিভিন্ন চিত্র অঙ্কন করেন। পটে নানা ধরনের দেশজ রং ব্যবহূত হয়। ইঁটের গুঁড়া, কাজল, লাল সিঁদুর, সাদা খড়ি, আলতা, কাঠ-কয়লা ইত্যাদিও রঙের কাজে ব্যবহার করা হয়। পটটিকে সাধারণত কয়েকটি অংশে ভাগ করে তার উপর লাল, নীল, হলুদ, গোলাপি, বাদামি, সাদা ও কালো রং লাগিয়ে ছবি অাঁকা হয়। তুলি হিসেবে ব্যবহৃত হয় কঞ্চির ডগায় পশুর লোম বা পাখির পালক।
পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে আজও একটি বিশেষ চিত্রকর সম্প্রদায় এক আখ্যানধর্মী লোকচিত্রকলার পেশায় নিয়োজিত। এ শিল্পকলার আদি উৎপত্তি সম্পর্কে যেমন কিছু জানা যায় না, তেমনি এ শিল্পকর্মে নিয়োজিত চিত্রকর সম্প্রদায়ের আদি উৎপত্তি আজও জল্পনা-কল্পনার বিষয়।
মধ্যযুগের হিন্দু জনসমাজ তাঁদের স্বকীয় যাথার্থ্যবোধে পেশাগত সোপানিক ভিত্তিতে সমাজে বর্ণপ্রথা গড়ে তোলে। বৃহদ্ধর্মপুরাণে বিশ্বরূপকার বিশ্বকর্মার নয় ছেলে সম্পর্কে উল্লেখ আছে। ঐ আখ্যান অনুযায়ী, নিচুজাতের এক রমণীর সঙ্গে বিশ্বকর্মার মিলনের ফলে ঐ নয় সন্তানের জন্ম হয়। ঐ নয় সন্তান তথা নবসায়কের নিয়তি নির্ধারিত হয়, তাঁদেরকে গতর খাটিয়ে বেঁচে থাকতে হবে – এভাবে। পটচিত্রকরকে ঐ নয় সন্তানের কনিষ্ঠ সন্তান বলে গণ্য করা হয়। বাকি আট সন্তান পেশাগত বা অন্যান্য উপায়ে সামাজিক পর্যায়ে তাঁদের অবস্থার উন্নতি করতে সক্ষম হলেও, নবম চিত্রকর সন্তানটি তাতে ব্যর্থ হওয়ায় তাঁর জন্মকালের ললাটলিপির বোঝাই তাঁকে বয়ে চলতে হয়।
পরবর্তীকালে চিত্রকরদের এই জনসমাজের অনেকেই সামাজিক পর্যায়ে তাঁদের অবস্থার উন্নতির জন্য একযোগে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তবে যেহেতু তারপরেও তাঁদের মধ্যে প্রতিমাপূজার রীতি থেকে যায় সে কারণে তাঁরা মুসলিম জনসমাজের মূলধারায় সামাজিক পর্যায়ে গৃহীত বা স্বীকৃত হন নি। আর তাই এ জনসমাজের অনেক লোকেরা তাঁদের দ্বৈত পরিচয় দিয়ে থাকেন। নিজ সমাজের মধ্যে তাঁরা তাঁদের মুসলিম নামে পরিচিত, আবার তাঁদের হিন্দু গ্রাহকদের কাছে তাঁরা নিজের পরিচয় দেন হিন্দু নামেই। তবে তাঁদের নামের সাথে সাধারণ নাম: চিত্রকর -এ শব্দটি দেখেই তাঁদের পেশা ধরা যায়।
এই শিল্পশৈলীর উত্তরাধিকার এক পুরুষ থেকে আরেক পুরুষে বর্তায়। পটুয়া, পটিদার ও পট – এ সব নামে একজন চিত্রকর সাধারণত পরিচিত হন। এই চিত্রকর একাধারে কবি, গায়ক ও চিত্রশিল্পী। চিত্রকর হিন্দু অতিকথার আখ্যান কাহিনীকে ছড়ার আকার দেন। আর তাতে একটা নীতি শিক্ষার বিষয়ও থাকে। স্ক্রোল পেন্টিং বা জড়ানো পটে ধারাবাহিক কয়েকটি কাঠামো বা ফ্রেমে আখ্যানকাহিনীর ধারাচিত্রগুলি অাঁকেন পটচিত্রকর।
গ্রাহকের কাছে তিনি তাঁর জড়ানো পটের ফ্রেমগুলি একের পর এক খুলে ধরে বর্ণনা করে যেতে থাকেন। আর তার মাঝে যে নীতি শিক্ষার বিষয় তুলে ধরেন তাতে জীবনের নানা পাপ ও পুণ্য সম্পর্কে শ্রোতারা সজাগ হয়ে ওঠেন।
পটচিত্রের পরিকল্পনা ও শৈলীতে শিল্পকলার কোনও উদ্ভাবনী প্রতিভার স্বাক্ষর রাখার আকুতি পরিদৃষ্ট হয় না। বংশানুক্রমে হস্তান্তরিত ও পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া শৈলীর প্রশিক্ষণে ধরাবাঁধা কিছু ধারাবিন্যাস, রেখা, রং এবং ভাবভঙ্গিমার গতানুগতিক উত্তরাধিকার এ পটচিত্রকলা। এগুলির সবই শেখানো হয় পরের প্রজন্মকে। শৈলীগত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও যে শৈলী আমরা পটচিত্রে লক্ষ করি, তাতে এক অনন্য আকৃতিগত সারল্য ও রঙের অপূর্ব সুসঙ্গতি নজরে পড়ে। পটচিত্র বাংলার লোকশিল্পকলার সকল ঐতিহ্যিক উৎকর্ষে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। এ শিল্পকলা সাংস্কৃতিক সমজাতীয়তায় ও মূর্তির সাথে নিবিড় সম্পর্কিত এক জনগোষ্ঠীর উদ্দেশে নিবেদিত। পটচিত্র সাধারণত কাগজ বা মাড়যুক্ত কাপড়ে অাঁকা হয়। সম্মূখমুখী প্রতিকৃতির তিন চতুর্থাংশ পটচিত্রে দেখা যায়। এতে হাতের তালু থাকে মুষ্টিবদ্ধ। পটচিত্রের অাঁক তথা ড্রয়িং ধর্মীয় প্রকৃতির হোক (hieratic) কিংবা নিছক রেখার নকশা (diagrammatic) হোক তাতে স্থানন্যাসে গভীরতার (spatial depth) অভাব লক্ষ করা যায়। পটচিত্রে ঢালাও (flat), প্রাণবন্ত রং ব্যবহার করা হয়। চিত্রে দেহাবয়বের ভাবভঙ্গিতে ক্রিয়ার প্রকাশ ঘটলেও মুখে কোন অভিব্যক্তি নেই। সমোন্নতি রেখার চারধারে কলোরেখায় আকৃতির ভেতরে রৈখিক বিভাজনগুলি লক্ষ্যণীয়। প্রথম প্রলেপের রঙে রয়েছে বিশুদ্ধ রং ও উদ্ভিদ রঞ্জক। কালো রঙের জন্য ঝুলের কালি ব্যবহার করা হয়।
জড়ানো পটচিত্রে (scroll painting) বিশটিরও বেশি ফ্রেম বা কাঠামো থাকে। এ ছাড়াও থাকে, আড় লতাই বা আয়তাকার জড়ানো পট (oblong scroll) যাতে বিশেরও বেশি ফ্রেম থাকে। যমপট বা জাদুপট ও চক্ষুষ্মান পট এগুলির সাথে ধর্মীয় নিদানতত্ত্ব (eschatology) সম্পর্কিত। এগুলি সাম্প্রতিক কোন ঘটনায় শোকসন্তপ্ত পরিবারের জন্য অাঁকা হয়। হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কিত নানা আখ্যানকাহিনী চিত্রিত করার জন্য চিত্রকরেরা লোকসাহিত্য উপাদানের সাহায্য নিয়ে থাকেন। এসব ছবিতে মানব ও দেব প্রতিকৃতির সাদৃশ্য লক্ষ্যণীয়, তাদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যগুলির তফাৎ অবশ্য লক্ষ করা যায় তাদের মাথায় পরা মুকুট ও অন্যান্য দেবমূর্তি সম্পর্কিত বিশেষ চিহ্নগুলিতে। চিত্র বর্ণনায় বাস্তব ও কল্পনার উপান্তিক সীমানা মিলেমিশে একাকার হতে দেখা যায়। এধরনের লোকপ্রিয় অতিকথামূলক ধর্মীয় মূলভাবগুলির উদাহরণে মহিষাসুরমর্দিনী, কমলে কামিনী, বেহুলা-লখিন্দর, মনসা-চাঁদ সওদাগর, কৃষ্ণ-রাধা, চৈতন্যলীলা এ সবের উল্লেখ করা যায়। মরং বুরু, মরা-হাজা, পিচলু বুড়ি ইত্যাদির কাহিনী সাঁওতাঁল সম্প্রদায়ের জন্য অাঁকা হয়ে থাকে। আর মিশ্রশ্রেণীর গ্রাহকদের জন্য পীরপট অাঁকা হয়। এতে পীর যে সব অলৌকিক ঘটনা সম্ভব করেন তা অাঁকা হয়। রাশিচক্র দেখিয়ে রাশিপট অাঁকার বিষয়টিও জনপ্রিয়। যম, যাদু ও চক্ষুদানপটের মতো রাশিপট যাদুটোনা ও ধর্মীয় উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। চৌকা পটের মধ্যে চক্ষুদান পট কৌতূহলোদ্দীপক। পটুয়ারা মৃত ব্যক্তির চক্ষুবিহীন কাল্পনিক ছবি এঁকে তাঁর স্বজনদের নিকট গিয়ে এই বলে পারিশ্রমিক দাবি করত যে, চোখ অাঁকা না হলে তাঁরা স্বর্গের পথ দেখতে পাবে না। চৌকা পটের মধ্যে কালীঘাটের পট বিখ্যাত। ১´ × ৮´ মাপের কাগজে দেবদেবী, মানুষ, ব্যঙ্গ প্রভৃতি বিষয় অবলম্বনে এই পট অঙ্কিত হতো। আঠারো-উনিশ শতকের কলকাতা ছিল এর লালন ক্ষেত্র।
পটের বিষয়বস্তু হয় সাধারণত ধর্মীয়, সামাজিক ও কাল্পনিক। পটুয়াদের তুলিতে মানুষের ভাবলোক ও আধ্যাত্মিক জীবন সহজ-সরলভাবে প্রতিফলিত হয়। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা আট শতক থেকে বুদ্ধদেবের জীবনী-সংক্রান্ত জাতকের গল্পসম্বলিত মস্করী নামক পট প্রদর্শন করতেন। পরবর্তী সময়ে হিন্দুধর্ম ও পুরাণ হয় পটের প্রধান বিষয়। হিন্দুদের বিভিন্ন দেবদেবী, যেমন – দুর্গা, কালী, মনসা, অন্নপূর্ণা, লক্ষ্মী, যম, চন্ডী, দশ অবতার প্রভৃতি; পৌরাণিক কাহিনী, যেমন: রামলীলা, কৃষ্ণলীলা ইত্যাদি, এমনকি কৈলাস, বৃন্দাবন, অযোধ্যা ইত্যাদি পবিত্র স্থানসমূহও এতে মূর্ত হয়ে ওঠে। এছাড়া জাদু, গাজী এবং হিতোপদেশমূলক চিত্রপটও অঙ্কিত হতে দেখা যায়। হিন্দুধর্মের শিব-পার্বতীলীলা, মনসামঙ্গল, চন্ডীমঙ্গল, বৈষ্ণবধর্মের শ্রীগৌরাঙ্গলীলা ইত্যাদি পটের আকর্ষণীয় বিষয়। রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনী, যেমন: রামের বনবাস, সীতাহরণ, রাবণবধ, কৃষ্ণলীলা ইত্যাদিও পটে অঙ্কিত হয়।
মুসলমানদের গাজীর পটে গাজীকালু-চম্পাবতীর কাহিনী কিংবা গাজী পীরের বীরত্বব্যঞ্জক বিভিন্ন অলৌকিক কর্মকান্ড অঙ্কিত হয়। এতে গাজীকে কখনও দেখা যায় সুন্দরবনের রাজার সঙ্গে লড়াই করতে; কখনও ব্যাঘ্রপৃষ্ঠে সমাসীন হতে; কখনও মাথায় টুপি অথবা রাজমুকুট পড়ে, পরনে রঙিন পাজামা কিংবা ধুতি, এক হাতে চামর বা ত্রিকোণ পতাকা এবং অন্য হাতে তলোয়ার বা মুষ্টিঘেরা জ্যোতি। গাজীর পটে মানিকপীর, মাদারপীর, সত্যপীর, কালুফকির, বনবিবি প্রভৃতি সম্পর্কে নানা অলৌকিক ক্রিয়াকর্মের ছবিও প্রদর্শিত হয়। এরূপ ধর্মীয় বিশ্বাসের পাশাপাশি নানা কৌতুক, রঙ্গরসসম্বলিত কাহিনী, ব্যঙ্গচিত্র এবং সামাজিক দুরবস্থার চিত্রও অঙ্কিত হয়। কখনও কখনও প্যাঁচা, বানর, গরু, বাঘ, সাপ, কুমির এবং গাছপালাও স্থান পায়। লোকধর্মে বিশ্বাসী সাধারণ মানুষ অনেক সময় পটুয়া এবং পটচিত্রকে ঝাড়ফুঁকের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন। অনেকে গৃহে পটচিত্র সংরক্ষণ করাকে কল্যাণ এবং দৈব-দুর্বিপাক থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় বলেও মনে করেন।
বারো-তেরো থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত বাংলার পটুয়ারা এ শিল্পকর্ম নির্মাণে বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলেন। বাংলাদেশের ঢাকা, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ ও রাজশাহী জেলা এবং পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম, বাঁকুড়া, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, হুগলি ও মেদিনীপুর ছিল এ শিল্পের প্রধান ক্ষেত্র। মানচিত্রের মতো জড়িয়ে একটি বংশদন্ডের মাথায় ঝুলিয়ে পটুয়া সঙ্গীত সহযোগে পটচিত্র প্রদর্শন করা হতো। এগুলি ছিল তখন সাধারণ মানুষের ধর্মতৃষ্ণা নিবারণ ও চিত্তবিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। পটচিত্রের সঙ্গে পটুয়া সঙ্গীতের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে; পটে যা অঙ্কিত হয়, গানের বাণীতে তাই বর্ণিত হয়। এ গান পাঁচালির ঢঙে গাওয়া হয়।
তীর্থক্ষত্র হিসাবে যেমন কালীঘাটের খ্যাতি যেমন সর্বত্র তেমনি কালিঘাটের পট ও সর্বত্র সমাদৃত এবং দেশ বিদেশে তার শিল্পগুনের জন্য সুপরিচিত। কালীঘাটের পটের শিল্পশৈলী অভিনব ও কৌতূহলদ্দীপক। উনিশ শতকে কলকাতায় তিনটি উন্নতমানের চিত্র পদ্ধতি ছিল,
(১)কালীঘাট পটচিত্র
(২)বটতলার ছবি বা পাটাচিত্র
(৩)কোম্পানি চিত্রপদ্ধতি
কালীঘাটে পটচিত্রের রমরমা ১৯ শতকে বেশী ছিল। তবে এর উদ্ভব ঠিক কবে হযেছিল বলা যায়না। শিল্পী মুকুল দে ও অন্যান্য আলোচকদের ধারণা এই শতকের গোড়ায় বা তার কিছু আগে কালীঘাটের পটের উদ্ভব হয়েছিল। কালীঘাটের পট চৌকো প্রকৃতির। কেউ কেউ মনে করেন চৌকো পটের জন্ম ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে এবং তা বিস্তৃত হয়েছিল ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। প্রখ্যাত শিল্প সমালোচক শোভন সোম এর মতানুযায়ী কলকাতায় কোম্পানী চিত্রকলার (উদ্ভব ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে) সঙ্গে সমান্তরালভাবে কালীঘাটেও পটচর্চা চলেছিল,তবে কালীঘাটের পটের সূচনা বহু আগেই হয়েছিল এক্ষেত্রে প্রামান্য যুক্তি হল এরকম-ভারতের প্রায় সকল মন্দিরে যেমন কাশীর বিশ্বনাথ, পুরীর জগন্নাথদেবে মন্দিরে, কন্যাকুমারিকা, তাঞ্জোর প্রভৃতি মন্দির সংলগ্ন বাজারের মত কালীঘাটের মন্দির বাজার যেখানে পটচিত্র বেশ কম দামে সহজলভ্য ছিল। এখান থেকে সস্তা দামে মধ্যবিত্ত ও নিন্ম মধ্যবিত্তরা ধর্মীয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ ছবি কিনে নিয়ে যেতেন। কালীঘাটের পট যখন আঁকা হয়েছিল তখন এদেশের তৎকালীন ভদ্র শিল্প রসিকেরা পটের রস উপভোগ করেনি এমনকি পটশিল্পকে বাঙালী নিম্নমানের চিত্ররূপে অবহেলা করত। তখন ধর্মীয় ও লোকায়ত দুধরনের পটই পাওয়া যেত। অবশ্য অবনীন্দ্রনাথ, কুমারস্বামী, হ্যাভেল, রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতি মনীষীরা ব্যতিক্রম ছিলেন।
কালীঘাট পটশৈলী রেখাঙ্কনে, বর্ণপ্রয়োগে, রূপবিন্যাসে স্বতন্ত্র, প্রাচীনতা ও নবীনতার মেলবন্ধন ঘটেছে। মুক্ত উদারতার সঙ্গে কিউবিস্টিক, রিয়ালিস্টিক, ইম্প্রেশানিস্টিক ইত্যাদি শিল্পরীতিসুলভ বৈশিষ্ট্য খুব কম শিল্পধারাতে চোখে পড়ে। কালীঘাট পটে তা বর্তমান। কালীঘাটের পটে যে ধর্মীয় বিশ্বাস প্রতিফলিত হত তা লৌকিক ধর্মেরই প্রতিচ্ছবি।
লক্ষী, সরস্বতী, কালী, দুর্গা, রামলীলা, কৃষ্ণলীলা নিয়ে কালীঘাটের পটুয়ারা যে ছবি আঁকতেন তা অনেক বেশী মানবিক করে আঁকা হত যেমন পায়ে বুট পরা রাবণ হনুমানের সাথে যুদ্ধ করছেন, হনুমানও চড়- লাথি- গুঁতো মারছেন আবার দেবী ষষ্ঠী বাঙালী ঘরের বধূর মত, পারিপার্শ্বিকের ছোঁয়া ছিল আকারে পোশাকে পরিচ্ছদে।
কালীঘাটের শিল্পীদের তৎকালীন সামাজিক ঘটনার সমালোচক-শিল্পী ও বলা চলে। সামাজিক পটের অধিকাংশই আঁকা হযেছিল ১৮৬০-১৯০০ এর মধ্যে। প্রাচীন পরম্পরাকে সাথে রেখে নতুন পরম্পরায় এঁরা ছবি আঁকতেন, এই রীতি ভারতের অন্যন্য তীর্থস্থানের শিল্পীদের মধ্যে দেখা যায়না। পুরী, তাঞ্জোর ইত্যাদি তীর্থক্ষেত্রে অঙ্কিত চিত্র পরম্পরাগত, শৈলীও গতানুগতিক কিন্তু কালীঘাটের ক্ষেত্রে বিষয়টা অন্যরকম। কালীঘাটের ধর্মনিরপেক্ষ পটচিত্রগুলি ১৯ শতকে “বাবু” সমাজের চিত্র উপহার দিয়েছে।
কালীঘাটের লোকায়ত পটচিত্রগুলিতে উচ্চতর সমাজের উজ্জ্বল ছবি ফুটিয়ে তোলা হত। সে সময় যেসকল বাঙালীরা অর্থবান ও প্রতিপত্তিশালী ছিলেন তারা কেউ ছিলেন সরকার, মুৎসুদ্দী, দেওয়ান বা চাকুরে ছিলেন। এঁরা বাবু সম্প্রদাযের আদি পুরুষ, চূড়ান্ত বিলাসিতায় জীবন কাটাতেন, উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত “বাবু” দের চেহারা বিচিত্র! নক্সা করা কোর্তা, ধুতি লম্বা কোঁচা, টানা টানা লম্বা চোখ, নাগরাই জুতো, বাবরি চুল ইত্যাদি। বাবুদের সাথে বিবিদের ছবিও দেখা গেছিল, এমনকি বারবনিতারাও ছিল এসব পটচিত্রে; গোলাপ হাতে গোলাপ সুন্দরী, আলবোলা হাতে তামাকসেবিনী। কেউ আবার প্রসাধনরতা; কেউ বীণাবাদনরতা; কেউ ফিরিঙ্গি কেতায় অভ্যস্ত। আসলে সবটাই বিদ্রুপরস মাখানো কিন্তু ব্যাঙ্গচিত্র উপভোগ্য। অবশ্য কিছু উচ্চস্তরের রমণী মূর্তি আঁকা হয়েছে। এই বিদ্রুপের জ্বালায় বা হয়ত পটের মর্যাদাহানীকর স্বল্পমূল্যের জন্য সম্পন্ন গৃহস্থরা সাজসজ্জার উপকরণ থেকে কালীঘাটের পটকে বর্জন করেছিলেন। কালীঘাট শৈলী আজ জীবিত না হলেও অনুভবে আসে,তৎকালীন মানুষের ধর্মীয় আকর্ষণ,সামাজিক রুচি স্প্ষ্ট হয়। পটশিল্প যামিনী রায়ের মত শিল্পীর চিন্তায়,কর্মে প্রভাব ফেলেছিল, এই ঐতিহ্য শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরনীয়।
বাংলাদেশে এক সময় গাজীর পট খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টির সুধীর আচার্য ছিলেন একজন খ্যাতনামা পটুয়া। তিনি ১´ × ৮´ আয়তনের গামছার ওপর ইটের গুঁড়া ও তেঁতুলের বিচির আঠায় তৈরি জমিনে লাল, কালো, হলুদ, সবুজ প্রভৃতি রঙে একটি বড় প্যানেলে বাঘের পিঠে গাজী এবং চবিবশটি ছোট ছবির খোপ এঁকেছিলেন। এসব খোপে ছিল মকরবাহিনী গঙ্গা, গাজীর আসা, খান্দুয়া বাঘ, যমদূত প্রভৃতি। যমবিষয়ক ছবির কারণে এটিকে যমপটও বলা হত। কলকাতার আশুতোষ মিউজিয়াম এবং গুরুসদয় দত্ত মিউজিয়ামে একাধিক গাজীর পট রক্ষিত আছে।
আজকাল পটচিত্রের লোকজ ঐতিহ্য দ্রুত নগরায়নের ফলে ক্ষীণ হয়ে আসছে। লোকালয়ের বেশিরভাগ মানুষ এখন আরও লাভজনক পেশার কাজ বেছে নিচ্ছে। ক্রমাগত অবলুপ্তির দিকে এগিয়ে চলেছে বাংলার পটচিত্র ও পটুয়ারা।
(তথ্যসূত্র:
১- বাংলার পটচিত্র: পটুয়াসংগীত: পটুয়াসমাজ ও লোকসংস্কৃতিবিজ্ঞান, সুব্রত কুমার মান্না, ফার্মা কে.এল. মুখোপাধ্যায় (২০১২)।
২- The Painters of Kalighat: 19th Century Relics of a Once Flourishing Indian Folk Art Killed by Western Mass Production Methods by Mukul Dey)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত