দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে দিন কয়েক আগেই আসামে প্রকাশিত হয়েছে জাতীয় নাগরিকপঞ্জী বা এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা। আর এর ফলে ‘নিজভূমে পরবাসী’ হতে হয়েছে ১৯ লক্ষ ৬ হাজার ৬৫৭ জনকে। ইতিমধ্যে বাংলাতেও এনআরসি করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিতে শুরু করেছে গেরুয়া শিবির। শুধু তাই নয়। আসামে বসবাসকারী বাঙালি ও নেপালিদের চরম দুর্দশার পরও রাস্তাঘাটে সাধারণ মানুষের মধ্যেও ইদানীং এনআরসি নিয়ে কারও কারও উৎসাহের কানে আসে। আসলে ধর্মীয় সুড়সুড়ি দিয়ে মানুষকে ভুল বোঝানোর অভিযোগ নতুন কিছু নয়। বাংলায়ও যে সেই কাজটা চালিয়ে যাচ্ছে একাংশ, রাস্তাঘাটে কান পাতলেই বোঝা যায়। কিন্তু আসামের ভুক্তভোগীরা বলছেন, এনআরসি হলে বাংলার সর্বনাশ হয়ে যাবে। সেটা অবশ্য বুঝতেও পারছেন এখন অনেকেই। কিন্তু তার পরও একটা ছোট অংশের মধ্যে এখনও এনআরসি-প্রীতি চোখে পড়ে। তাঁদের এখন সাবধান করছেন আসামের বাঙালিরা।
আপাতদৃষ্টিতে এনআরসিতে খারাপ কিছু নেই। কিন্তু প্রথমত এই এনআরসি প্রক্রিয়ায় যে পরিমাণ হয়রানির মধ্যে পড়তে হচ্ছে, তা সামলাতেই এখনও হিমশিম খাচ্ছেন আসামের বাঙালিরা। নিজের দেশেই নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে গিয়েই জেরবার তাঁরা। আসলে স্রেফ নথিভুক্ত প্রমাণ দিলেই হচ্ছে না, দিতে হচ্ছে সেই নথির প্রমাণও। যেমন ধরুন, আপনার জন্ম ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে। জমা দিলেন জন্মের শংসাপত্রের প্রতিলিপি। বা, তালিকার কোনও একটি শংসাপত্র। কিন্তু এখানেই থামছে না প্রক্রিয়া। যে সংস্থা সেই শংসাপত্র দিয়েছে, তাদের কাছে তা যাবে পুনরায় যাচাইয়ের জন্য। সেখানকার রেকর্ড দেখে তারা যদি বলে আপনার পাঠানো নথি ঠিক, তবেই গ্রাহ্য হবে সেই সার্টিফিকেট। নতুবা নয়। বহু পুরনো নথির যদি রেকর্ড না থাকে, তা হলেই বিপদ। এরপর রয়েছে এনআরসি কেন্দ্রে হাজিরার ঝামেলা। মালদার লোককে যেতে হতে পারে আসানসোল। আবার বাঁকুড়ার কাউকে ছুটতে হতে পারে বজবজ বা বালুরঘাটে। পুরোটাই নিজের খরচে।
বংশবৃক্ষের প্রমাণ দেওয়াটাও বেশ কঠিন। ঘটি হলেই যে উতরে যাবেন, তত সহজ নয় বিষয়টি। বাঙালদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আসামের অভিজ্ঞতা অন্তত সেরকমই। ভোটারদের বর্তমান সচিত্র পরিচয়পত্র, আধার কার্ড, পাসপোর্ট, প্যান কার্ড, রেশন কার্ড— সবই মূল্যহীন এনআরসির কাছে। লাগবে অন্তত ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগেকার নথি। ফলে যাঁরা ’৭১–এর পরে জন্মেছেন, তাঁদের সমস্যা আরও বেশি। কারণ তাঁদের বংশবৃক্ষের প্রমাণ দিতে হবে। শুধু তাই নয়। বারবার ডাকা হতে পারে এনআরসি সেবা কেন্দ্রে। কেউ অভিযোগ করলে তো কথাই নেই। সমস্যা পড়তে পারেন ঠিকানা বদলকারীদের। ধরুন আপনি আগে থাকতেন মালদায়। সেখান থেকে বর্ধমান হয়ে এখন দমদম। সেক্ষেত্রে তিন জায়গাতেই আপনাকে হাজিরা দিতে হতে পারে। এই কারণেই আসামের বাঙালিদের আশঙ্কা, আসামের মতো সর্বনাশ হতে চলেছে বাংলারও। কারণ হয়রানির সব রকম রাস্তাই খোলা থাকছে এনআরসি প্রক্রিয়ায়।