প্রায় সাত বছর আগের ঘটনা। ইস্টবেঙ্গল দলের নিয়মিত গোলরক্ষক তিনি। সেইসময় আই লীগেরই এক গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ গুরপ্রীত সিংহ সান্ধুকে খলনায়ক বানিয়ে দিয়েছিল। সে দিন যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন থেকে মাথা নিচু করে ফিরেছিলেন পঞ্জাবতনয়। আই লিগের সেই ম্যাচে ইউনাইটেড স্পোর্টসের বিরুদ্ধে খেলার একেবারে শেষ লগ্নে গোল করার জন্য গুরপ্রীত পৌঁছে গিয়েছিলেন বিপক্ষের পেনাল্টি বক্সে।
তারপর অন্য দৃশ্য দেখেছিল যুবভারতী। একটা লুজ বল ধরে ইউনাইটেডের বিশ্বকাপার কেন ভিনসেন্ট সাপের মতো এঁকেবেঁকে দৌড়তে দৌড়তে বল নিয়ে এসে লাল-হলুদের জাল কাঁপিয়ে দেন। ভিনসেন্টকে ধরার মরিয়া একটা চেষ্টা করেছিলেন গুরপ্রীত। কিন্তু, তাঁর নাগাল পাননি। গোলের পর ইস্টবেঙ্গল পেনাল্টি বক্সের ভিতরে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখা গিয়েছিল হতাশ গুরপ্রীতকে। তাঁকে লক্ষ্য করে গ্যালারি থেকে উড়ে এসেছিল উন্মত্ত লাল-হলুদ সমর্থকদের তীব্র কটাক্ষ।
সেই ঘটনার পরে গঙ্গা দিয়ে বয়ে গিয়েছে অনেক জল। নরওয়ের ক্লাবে তিন বছর থেকে গুরপ্রীত নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন অন্য এক উচ্চতায়। ভিনসেন্টও ভারত ছেড়ে এখন খেলেন তাইল্যান্ডের ক্লাবে। বুধবার ইউনাইটেড স্পোর্টসের প্রাক্তন স্ট্রাইকার ভিনসেন্ট তাঁর প্রাক্তন প্রতিদ্বন্দ্বীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বললেন, ‘‘গুরপ্রীতকে অভিনন্দন। বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জনকারী পর্বের ম্যাচে নিজেকে দারুণ ভাবে প্রতিষ্ঠা করল ও। কাতারের মতো দলকে ও একাই রুখে দিয়েছে। এগিয়ে চল বন্ধু।’’
মঙ্গলবার কাতারের মাঠে অতীতের সব ভুল-ত্রুটি, কেরিয়ারের কালো দাগ অদৃশ্য কোনও ইরেজার দিয়ে যেন মুছে দিলেন গুরপ্রীত। কাতারের ‘গোলাবর্ষণ’ বুক চিতিয়ে বাঁচালেন। ভারতের বারের নীচে তিনি যেন হয়ে উঠেছিলেন ‘নীলকণ্ঠ’। এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন কাতারের সব বিষ তিনি প্রায় একাই শুষে নেন। পরিসংখ্যান বলছে, ভারতের গোল লক্ষ্য করে ২৭টা শট নিয়েছিল কাতার। গুরপ্রীতকে পরাস্ত করা য়ায়নি। খেলার শেষে সোশ্যাল মিডিয়ায় গুরপ্রীতকে নিয়ে দারুণ চর্চা। ভারতের গোলকিপার টুইট করেন, ‘এই রাত ভোলার নয়। দলের প্রত্যেকেই ইচ্ছাশক্তি ও সাহসের পরিচয় দিয়েছে। এই পারফরম্যান্স একটা দল হিসেবে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাবে। সেই সঙ্গে দেশের নামও উজ্জ্বল করবে।’
গুরপ্রীত সম্পর্কে কিছু বলতে গিয়ে অতীতে উজ্জ্বল হয়ে উঠত ট্রেভর জেমস মর্গ্যানের চোখ-মুখ। ইস্টবেঙ্গলের কোচ থাকার সময়ে তরুণ গোলকিপারকে নিয়ে প্রায়ই কটূ প্রশ্ন উড়ে আসত সাহেব কোচের দিকে। মর্গ্যান বলতেন, ‘‘ওর পাশে থাকুন। ওর মধ্যে দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে।’’ লাল-হলুদ-এ সেই কবেই প্রাক্তন হয়ে গিয়েছেন মর্গ্যান। তবে পুরনো ছাত্রের দারুণ পারফরম্যান্সে এখনও গর্ব বোধ করেন সাহেব কোচ। লন্ডন থেকে বুধবার তিনি বলছিলেন, ‘‘গুরপ্রীতের জন্য আমার দারুণ গর্ব হয়। ও দারুণ উন্নতি করেছে।’’ কাতারকে আটকে দেওয়া প্রসঙ্গে সাহেব বলছেন, ‘‘ভারতের এটা দারুণ পারফরম্যান্স বলতেই হবে। তবে যোগ্যতা অর্জন করতে হলে ভারতের লড়াই কিন্তু খুব কঠিন। হাল ছাড়লে চলবে না।’’
কথায় বলে, ক্যাপ্টেন সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। গতকাল রাতে সুনীল ছেত্রী অসুস্থ থাকায় খেলতে পারেননি। গুরপ্রীতের হাতে ওঠে নেতৃত্বের আর্মব্যান্ড। শেষ প্রহরী হয়ে দলকে নেতৃত্ব দেন তিনি। খেলার শেষে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন ভারতীয় গোলকিপার। গ্যালারিতে উপস্থিত ভারতীয় সমর্থকদের উদ্দেশ্যে তিনি ইঙ্গিত করে যেন বলার চেষ্টা করছিলেন, ‘‘আমাকে ভুলো না।’’ সত্যিই তো! এমন দুরন্ত পারফরম্যান্সের পরে গুরপ্রীতকে ভুলে যাবে, এমন সাধ্য কার?