নিজের জীবদ্দশায় বারবার আক্রান্ত হয়েছেন বাংলার গোঁড়া সমাজপতিদের হাতে। মানসিক লাঞ্ছনা এমনকি কটূক্তিও তাঁকে সইতে হয়েছিল। জন্মের দ্বিশতবর্ষের প্রাক্কালেও এই আক্রমণ অব্যাহত। বিদ্যাসাগরের দিন শেষ বলে তাঁরই নামাঙ্কিত কলেজে ঢুকে যারা তাঁর মূর্তি ভাঙলো সেই বিজেপি গুণ্ডারা জানেনা বর্ণ পরিচয়ের স্রষ্টা না থাকলে তাদের মাতৃ ভাষায় এই কথাটুকুও বলা হত না। বঙ্গের ভোটরঙ্গে এমন কুৎসিত কালো দিন এর আগে আর কখনও আসেনি। বিদ্যাসাগরের ওপর আক্রমণ মানে বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ওপর আক্রমণ। দ্বিধার দিন শেষ, এখনও যদি আমরা এই ঘৃণ্য কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সামিল হতে না পারি তাহলে গেরুয়া গুণ্ডারা আমাদের নিজভূমে পরবাসী করে দেবে। রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ কেউই আর অক্ষত থাকবেন না। দল, জার্সি, প্রভাব কোন কিছু না বিচার করে যারা এই ঘৃণ্য কাজ করেছেন আমি অবিলম্বে তাদের গ্রেপ্তার ও উপযুক্ত শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।
সাংবাদিকরা সমাজের বাইরে নয়, শুধু খবর করে বা ছবি তুলে আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়না। বাংলার মনীষী, ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের ওপর আক্রমণ মানে আমাদের সবার ওপর আক্রমণ। হিন্দুত্বের নামে বিজেপি গোটা দেশের ওপর বিভেদের সংস্কৃতি চাপিয়ে দিতে চাইছে। এই বিভেদপন্থা আমাদের কাজের পরিসরটুকু ধ্বংস করে দেবে। বিপন্ন করবে নানা বিশ্বাস, মত, ধর্ম ও বিদ্যাসাগরের মত মনীষীদের কাজের ফলে গড়ে ওঠা বাংলার মিলেমিশে থাকার সংস্কৃতিকে। এখনি এই চেষ্টাকে রুখতে না পারলে বাংলা তো বটেই গোটা দেশ টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।
বিভেদপন্থা একমাত্র ভয় পায় মানুষের সম্মিলিত প্রতিরোধকে। তাই আজ আমাদের সবাইকেই এর প্রতিবাদে পথে নামতে হবে। এটা না করলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। সাংবাদিকদের সমস্ত সংগঠন, প্রেস ক্লাবকে এর প্রতিবাদে এগিয়ে আসতে হবে। আমার মনে পড়ছে ভিয়েতনামে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনের প্রতিবাদে ৬০ এর দশকে কলকাতার যুবছাত্ররা যে বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন তার ফলে বিশ্ব ব্যাঙ্কের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা কলকাতায় ঢুকতে পারেন নি। এই মুহূর্তে সেই ধরণের কর্মসূচী নেওয়া জরুরি। আসুন, আমরা সবাই মিলে গেরুয়া গুণ্ডাদের বিরুদ্ধে এমন একটা মানব প্রাচীর গড়ে তুলি যার ফলে তারা আর শহরে পা রাখার জায়গা পাবে না। শহরে ঢুকতে হলে আমাদের বুকের ওপর দিয়ে ঢুকতে হবে।
৭০ এর দশকে নকশালরা বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙেছিল। সেটা ছিল তাদের রাজনীতির ভুল। পরে তারা সেই ভুল বুঝে মূর্তি ভাঙার রাজনীতি থেকে সরে আসে। কিন্তু তাদের মূর্তি ভাঙার পিছনে কোন ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা বা বিভেদপন্থার ছক ছিল না। মোদি- অমিতদের পার্টির বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা বাংলার সংস্কৃতির ওপর একটা পরিকল্পিত আক্রমণ। বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে মানুষের ওপর বিভেদপন্থী ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ চাপিয়ে দেওয়ার কাজের অঙ্গ হিসেবে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা হয়েছে। গোঁড়া হিন্দুত্ববাদিরা দেশের সংস্কৃতিকে তাদের ইচ্ছামত সাজিয়ে নিতে চায়। সতীদাহ, বাল্যবিবাহের মত সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো বিদ্যাসাগরের মত সমাজ সংস্কারকদের তারা সহ্য করতে পারেনা। এই রাজনীতি আমাদের প্রতিহত করতে হবে।
একটা জিনিস আমার খুব খারাপ লাগছে, তা হল বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার মত ঘৃণ্য ঘটনাও রাজ্যের সব রাজনৈতিক দলকে একটা মঞ্চে আনতে পারলো না। আমি মানছি, প্রতিটি দলই তাদের নিজেদের মত করে প্রতিবাদ জানিয়েছে। কিন্তু এইসময় দরকার ছিল বাংলার এক যুগপুরুষের মূর্তি ভাঙার বিরুদ্ধে সব দলের সম্মিলিত প্রতিবাদ। কারণ, বিদ্যাসাগর তো কোন দলের সম্পত্তি নন, তিনি গোটা দেশ তথা বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী। গৈরিক গুণ্ডাদের হামলার প্রতিবাদটা তাই সমবেত হওয়া উচিৎ। বাংলার মানুষ অন্তত এক্ষেত্রে তাদের দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে এক সাধারণ মঞ্চে দেখতে চায়। তাহলেই প্রতিবাদটা আরও জোরালো হবে। ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখবেন।
গৈরিক গুণ্ডারা যার মূর্তি ভাঙলো বিদ্যাসাগর নামে সেই ছোটখাটো মানুষটির ছিল দুর্জয় সাহস। প্রবল প্রতাপান্বিত রাজপুরুষরাও তার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারতো না। সেই সাহস আমাদের স্পর্শ করুক। আসুন, দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠি আমরা। তাহলেই মূর্তি ভাঙার দল বুঝতে পারবে মূর্তি ভাঙলেও বাংলার মানুষের মন থেকে শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ও ভালবাসাকে মুছে দেওয়া যায়না।
বিদ্যাসাগর মানে বাঙালির আত্মপরিচয়। বিদ্যাসাগর মানে বাঙালির সমাজ সংস্কার ভাবনার উৎকর্ষ। বিদ্যাসাগরদের মত মানুষেরাই বাংলার নবজাগরণকে গতি দিয়েছিলেন। বাংলা আজ যা ভাবে গোটা দেশ তা ভাবে কাল বাংলার ভাবনা চিন্তার স্বাতন্ত্র্যের এই স্বীকৃতি এসেছিল বিদ্যাসাগরদের মত মানুষদের জন্য। গৈরিক গুণ্ডাদের রাজ্য থেকে নির্মূল করেই আমরা তাঁর মূর্তি ভাঙার মত ঘৃণ্য কাজের জবাব দিতে পারি। মোদি-অমিতরা বুঝবেন মূর্তি ভেঙে বাংলার মানুষের মন থেকে বিদ্যাসাগরকে মুছে দেওয়া যায়না।
ইতিহাস কাপুরুষদের কখনও ক্ষমা করে না। লোকচক্ষুর অগোচরে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা একটা কাপুরুষতা। গৈরিক গুণ্ডাদের বলি, এভাবে বিদ্যাসাগরকে আপনারা ছোট করতে পারবেন না। মানুষের মনে তিনি তাঁর আগের জায়গাতেই থাকবেন। এই ঘৃণ্য কাজ আপনাদের বাংলার মানুষ ও রাজনীতি থেকে কতটা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে তা আর কিছুদিন পরে আপনারা বুঝতে পারবেন।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত