উত্তমকুমার অভিনীত প্রায় তিন ডজন সিনেমায় তুলসী চক্রবর্তী অভিনয় করেছেন। উত্তমকুমার বলতেন,’‘তুলসীদা যেভাবে অভিনয় করেন, আমি তো কোন দিনই পারব না। ওঁর মতো ‘জীবন্ত’ হয়ে ওঠা আমার দ্বারা হবে না।……তুলসী চক্রবর্তীকে প্রণাম জানানোর একটাই পথ আমার কাছে। যখনই কাজ পাই, পরিচালক প্রযোজককে বলে ওঁকে ডেকে নিই। তুলসীদা থাকলে সিনটা দারুনভাবে উতরে যায়। ওঁর ঋণ শোধ তো করতে পারব না, যেটুকু পারি সাহায্য করি।’’
দুঃখের কথা এই যে আমৃত্যু তুলসী চক্রবর্তী সিনেমায় কমেডিয়ান হয়েই বেঁচে ছিলেন, অভিনেতা হয়ে নয়। এমনকী ‘পরশপাথর’-এর পরও। সেই সাথে দারিদ্র ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী।
সংসার পাতেন স্ত্রী ঊষারানী চক্রবর্তীর সাথে ২নং কৈলাস বসু থার্ড লেন-এ, মধ্য হাওড়ার এক সংকীর্ণ গলির দু’কামরার দোতলা বাড়িতে। ঘরে আসবাব বলতে ছিল একটি প্রাচীন পালঙ্ক, একটি কাঠের আলমারি, গোটা কয়েক টুল আর একটা ইজি-চেয়ার। অবসর সময়ে ঘরেই বসাতেন সংগীতের আসর। তাঁর কিছু গান স্বরচিতও ছিল। সেগুলোতে পছন্দ মতো রাগ বসাতেন।
একটি গান তিনি প্রায় গেয়ে শোনাতেনঃ
‘শিবরাত্রির পরের দিন /
শিবের হল সর্দিকাশি/
ঘটি ঘটি জল ঢেলেছে/
জ্যেঠি কাকী মামী মাসী/
তাই শিবের হল সর্দিকাশি/
আদা দিয়ে চা করে/
দুগ্গা এসে সামনে ধরে/
‘সিদ্ধি আজকে খেও না, বাপু’/
বললে শিবে মুচকি হাসি/
শিবের হল সর্দিকাশি।’
এই দোতলাবাড়ি যাওয়ার আগে তিনি একটা ‘বারো ঘর, এক উঠোন’-এ ভাড়া থাকতেন। দোতলা বাড়িটা যখন ছ’হাজার টাকায় কেনেন তাঁর স্ত্রী তখন তাকে তার জমানো বেশ কিছু টাকা দিয়েছিলেন। সেই টাকা পেয়ে তিনি যেমন অবাক হন, তেমনি ভয়ও পান। কারণ তাঁর স্ত্রীর কাছে টাকা কি ভাবে এল ভেবে পাচ্ছিলেন না। তিনি অল্প রেটে যা কাজ করে পেতেন বাড়ি ফিরেই স্ত্রীকে দিতেন, তাতেই সংসার চলতো। স্ত্রী যে তার থেকে জমাতে পারেন ভাবতেই পারেন নি। তবু বাড়ি কেনার সময় স্ত্রীকে বলেছিলেন, কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে ‘বাপের বাড়ি থেকে দিয়েচে।’ শুনে স্ত্রী হেসেছিলেন। কারণ বিধবা মা বিয়েই দিয়েছিলেন গোটা দু-তিনটে শাড়ি সম্বল করে।
সাহিত্যিক শংকর তাঁর ‘মানব সাগর তীরে’বইতে লিখেছেন,‘যদি তুলসী চক্রবর্তী, রবি ঘোষ, নৃপতি চ্যাটার্জির মতো অভিনেতা বিদেশে জন্মাতেন, তা হলে তাঁদের স্মরণে এক-একটি সরণি থাকত।’ তুলসী চক্রবর্তীর স্মরণে হাওড়ার মানুষ তাঁর নামে একটি পার্ক গড়ে তুলেছেন।
চক্রবর্তী সম্পতি নিঃসন্তান ছিলেন। সিনেমার লোকজনকে ‘ছেলে’ বলে ডাকতেন। উত্তমকুমার, তরুনকুমারকেও ‘ছেলে’ বলে সম্বোধন করতেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে স্বস্নেহে ‘সৌমিত্তির’ বলতেন। এই সব স্বনামধন্য অভিনেতারাও তাঁকে ভীষণ ভালবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন। শোনা যায় শীতে কষ্ট পাচ্ছিলেন বলে, অনুপকুমার তুলসী চক্রবর্তীকে একটা কোট কিনে দিয়েছিলেন। সেটা পেয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন সন্তানহীন তুলসী চক্রবর্তী। অনুপকুমারকে জড়িয়ে ধরেছিলেন ছেলে হিসেবে।
সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলেন জহর গাঙ্গুলি। ছবি বিশ্বাস, কালী ব্যানার্জি, নৃপতি চ্যাটার্জিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। কখনও বাড়িতে মদ খেতেন না। ঘরে ঠাকুর থাকায় নেশা কাটলে স্নান করে ঘরে ঢুকতেন।
সেলাইয়ের কাজও ভাল জানতেন। থিয়েটারে একবার অন্যের বদলে ক‘দিন রাজার অভিনয় করতে গিয়ে রাজার নাগরা নেই দেখে মোজার উপর নাগরা এঁকে সেলাই করে, মঞ্চে নেমে পরেন। বড় সরল-সাধারণ ছিলেন মানুষটি। সরল–সাধারণ জীবনের অন্তরালে থেকে অন্তরের দুঃখরূপী গরলকে স্তিমিত রাখতেন। সন্তান না হওয়ার দুঃখ। চিন্তা ছিল তাঁর অবর্তমানে ব্রাহ্মণীর ভবিষ্যতের।
এই বরেণ্য অভিনেতাকে অপেক্ষা করতে হত ছোট্ট মাস্টার বিভু ভট্টাচার্যের জন্য বরাদ্দ গাড়িতে বাড়ি ফেরার জন্য। ছবি বিশ্বাস বলেছিলেন উনি হলিউডে জন্মালে অস্কার পেতেন। শুনে নিশ্চয়ই মুচকি হাসেন ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসের এই যাত্রী। প্রথাগত স্বীকৃতি হয়ত পাননি কিন্তু তাঁর অভিনয়, দীর্ঘ সিনেমায় স্বল্প উপস্থিতির পরিসর স্বল্প থাকেনি। বাড়ি ফেরার পথে দর্শকের গল্পের বিষয় হতেন তুলসী চক্রবর্তী।
আর পাঁচজন গৃহস্থের মতো ভালবাসতেন স্ত্রীর হাতের রান্না। ভাল সরু চালের ভাত আর মাছের ঝোল তাঁর প্রিয় ছিল। তাছাড়া পছন্দ ছিল ডাল-ভাত, ঘি, ডিম আর মাংস।
মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে অসুস্থ হয়ে পরেন। পয়সাও ছিল না চিকিৎসার জন্য। প্রচণ্ড দারিদ্র তো ছিলই, তার ওপরে নিজের বাড়ীটা দান করেছিলেন এলাকার দরিদ্র পুরোহিতদের জন্য।খানিকটা সেরে উঠেই বাজারে গিয়ে একদিন কিনে আনলেন গলদাচিংড়ি, ফুলকপি, কড়াইশুঁটি। রাতে রান্না হল, খেয়ে শুলেন। ভোররাত থেকে শুরু হল ভেদবমি। ভোরে ডাক্তার আসতে না আসতেই সব শেষ। ১৯৬১-র ১১ই ডিসেম্বর তিনি চলে গেলেন অনন্তলোকে। স্ত্রী উষারাণী দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন একমুঠো খাবারের জন্য। দারিদ্রের কারণে স্বামীর সবকটি মেডেল বিক্রী করতে বাধ্য হয়েছেন। এভাবে ৩৫ টা বছর কাটিয়েছেন।
মারা যাবার পর সরকারের তরফ থেকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোরও কোনও বন্দোবস্ত ছিল না তখন। যদিও তাতে কিছু আসে যায় না । তিনি আছেন বাঙালির অন্তরে, থাকবেনও
তুলসী চক্রবর্তীকে না পেলে সত্যজিৎ রায় যে ‘পরশপাথর’ করতে পারতেন না, তা তিনি তাঁর অন্তিমজীবনেও স্পষ্ট করে বলে গেছেন। ‘পরশ পাথর’-এর পরেশ বাবু (তুলসী চক্রবর্তী) পরশ পাথরের মাধ্যমে ধনী হয়েও নির্লোভ থেকে যান। হাতের মুঠোয় অতুল ক্ষমতা হঠাৎ পেলেও তার অপব্যবহার করা উচিত নয়- এই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীই যেন পরেশের চরিত্রে ফুটে ওঠে। ছবিতে তাই ‘টুপি’ একটি চমৎকার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। গান্ধীটুপিতে তার টাক ঢেকে রাখা মন্ত্রীদের পরিহাস করে যেন তৃপ্ত হয়েছিলেন পরেশবাবু। ভোটে নামতে গেলে বিদ্যাবুদ্ধির প্রয়োজন নেই। তাই পরেশবাবু নিজেই ভোটে নামতে দ্বিধা করেন না।এই সিনেমায় তাঁর মাথায় সাদা ‘গান্ধী’ টুপি পরা নিয়েও তর্ক ওঠে সেন্সর বোর্ডে। শেষে নিজের টাক ঢাকতে টুপি পরেছেন এই যুক্তিতে আর বিরোধিতা করেনি সেন্সর বোর্ড। …
(সংগৃহিত)