বালির শান্তিরাম রোডের বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির তিন মহলা বনেদি দুর্গাপুজো একটু অন্য স্বাদের। এই বাড়িতে দেবী দুর্গা অসুর বিনাশী নন। বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির দুর্গা ঘরের মেয়ে। ১৫৫ বছর পুরোনো এই পুজো অন্যন্য, তার কারণ, জাত-ধর্মের ঠুনকো বিশ্বাস ভেঙে, দেশ-কালের গণ্ডি পেরিয়ে বড় হল মূল্যবোধ। তৎকালীন সংস্কারবদ্ধ বাঙালি সমাজে ব্যতিক্রমী ভাবনার দৃষ্টান্ত রাখল বালির বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার।
ফোর্ট উইলিয়ামের কোর্ট অ্যান্ড জুডিকেচারের আইনজীবী ছিলেন জগৎচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। ইংরেজ আমলের দুঁদে আইনজীবী। নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ। আগে দায়িত্বটা তিনিই সামলাতেন। এখন বাড়ির পুজোর ভার এখন আইনজীবী অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর ভাই দেবমাল্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাঁধে।
ষষ্ঠী পেরিয়ে সপ্তমীর সকাল। বদলটা এল পুজোর মাঝেই। এই বাড়ির রীতি অনুযায়ী গঙ্গায় গিয়ে নয় ঠাকুরদালানেই গঙ্গা জলে স্নান করানো হবে কলাবউকে। বাড়ির মেয়েরা তখনও অবগুন্ঠনের আড়ালে থাকতো। বাড়ির চৌকাঠ পাড়া করার আদেশ নেই। কাজেই যা হবে চৌহদ্দির মধ্যেই। গঙ্গা জলের ঘটি তুলে ধরতেই বাধ সাধলেন জগৎচন্দ্র। শুধু গঙ্গা জল কেন? নবপত্রিকার অঞ্জলি হবে বিশ্বের নানা দেশের নদীর জলে। আত্মীয়-অনাত্মীয়দের অবাক করে দিয়ে সে দিন নবপত্রিকা স্নান করানো হয় গঙ্গা ও টেমস নদীর জলে। সেই শুরু। বংশানুক্রমিক ভাবে কখনও টেমস, কখনও মিশরের নীল নদ বা চিনের হোয়াংফু নদীর জলে কলাবউ স্নান করানোর রীতি চলে আসছে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারে।
এটাই বালির বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির পুজোর সেরা আকর্ষণ। সপ্তমীর সকালে নবপত্রিকা স্নান দেখতে ঠাকুরদালানে ভিড় জমান বহু মানুষ। গঙ্গার জলের সঙ্গে যখন টেমস আর নীল নদের জল মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। অশোকবাবু বলেছেন, “১৫৫ বছরের পুরনো পুজো। আমাদের বাড়ি থেকে কয়েক কদম হাঁটলেই গঙ্গা। তবে গঙ্গার ঘাটে নিয়ে গিয়ে কলাবউ স্নান করানোর রীতি নেই। প্রাচীন নিয়ম মেনে এখনও বাড়ির ঠাকুরদালানেই নবপত্রিকা স্নান হয়। আর গঙ্গা জলের সঙ্গে দরকার হয় নানা দেশের নদীর জল।”
বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির নিয়মানুযায়ী জন্মাষ্টমীর দিনেই কাঠামো পুজো হয়ে যায়। আরও একটা বৈশিষ্ট্য আছে এই পুজোর। বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়িতে কাঁধে চেপে বিসর্জনে যান দুর্গা। বাড়ির মেয়ে উমাকে কাঁধে চাপিয়েই গঙ্গায় নিয়ে যাওয়ার রীতি প্রচলিত। তাই ১৫৫ বছর পরেও রীতি মেনে হয় পুজো, আর কোথাও যেন শারদ ভোরে চণ্ডীপাঠের মন্ত্রের সঙ্গে এক হয়ে যায় বাংলা, লন্ডন, মিশর।