নকল দেশপ্রেমিকদের লক্ষ্য করে বাঁধা একটা গান আমরা ছোটবেলায় শুনতাম। গানটা হল – ভাই রে ভাই মোর মতন আর দেশপ্রেমিক নাই। দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির রকমসকম দেখে এই ব্যঙ্গাত্মক গানটা এখন আমার বারবার মনে পড়ছে। তার কাজকর্মই এই পুরনো গানটাকে নতুন করে প্রাসঙ্গিক করে দিয়েছে। পুলওয়ামায় পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিদের হামলায় ভারতীয় জওয়ানদের শহীদ হওয়ার ঘটনার পর থেকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী এমন একটা ভাব করছেন যে, তিনি এবং তার দল বিজেপিই একমাত্র দেশপ্রেমী, বাদবাকিরা সবাই দেশের শত্রু। ভোটের মুখে এই আগমার্কা দেশপ্রেমের অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি একটা কথাই বলতে চাইছেন যে, বিরোধী দলগুলি সবাই দেশের শত্রু। তাই দেশকে বাঁচাতে তাকে এবং তার দলকেই ক্ষমতায় আনতে হবে।
বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এবং দেশজুড়ে বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ের প্রধান মুখ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায়, দেশ বাঁচাতে প্রাণ দেওয়া জওয়ানদের রক্ত নিয়ে রাজনীতি করছেন মোদি। জঙ্গিদের হানার বিরুদ্ধে ভারতীয় জওয়ানদের প্রত্যাঘাত, জঙ্গিঘাঁটিতে বায়ুসেনাদের বিমানহানা, সেই হানায় অংশ নিয়ে অভিনন্দনের পাক সেনাদের হাতে গ্রেপ্তার ও সসন্মানে মুক্তি থেকে শুরু করে প্রতিটি পর্বেই দেশের সব বিরোধী দল সেনাবাহিনীর কার্যকলাপকে মুক্তকণ্ঠে সমর্থন জানিয়েছে, শত্রু দমনে তাদের সাফল্যকে জানিয়েছে অভিনন্দন। তবুও মোদি-অমিতদের চোখে দেশের বিরোধী নেতারা দেশের শত্রুই থেকে গেছেন! দেশপ্রেমের সব ঠিকাই যেন আমাদের প্রধানমন্ত্রীমশাই নিয়ে নিয়েছেন! এ এক বিচিত্র রাজনীতি!
অবশ্য এ রাজনীতি ছাড়া মোদি-অমিতদের আর কোন উপায় নেই। বিরোধী দলগুলি সেনা বাহিনীর ভূমিকার প্রশংসার পাশাপাশি দেশের রক্ষাকর্তা হিসেবে নিজেদের ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়ানোর জন্য মোদি-অমিতদের মিথ্যাচারের প্রতিবাদ জানানোর পরই তাদের গোঁসা হয়েছে।
সেনাবাহিনী লাশ গোনেনা, তারা জানেন দেশকে রক্ষার জন্য জীবন দিয়ে প্রতিরোধ করতে, এখনও অবধি তারা তাই করছেন। কিন্তু এই ত্যাগ ও কর্তব্যপরায়ণতাকে বাদ দিয়ে মোদি অ্যান্ড কোং ফেঁদেছেন এক মিথ্যা সংখ্যাতত্ত্বের গল্প। কখনো তারা বলছেন, বায়ুসেনাদের হানায় পাকিস্তানে ৩৫০জন জঙ্গি নিকেশ হয়েছে, কখনো বা এই সংখ্যাটা কমে দাঁড়াচ্ছে ২৫০জনে। সেনাদের সাফল্যকে বোঝানোর জন্য নানা অতিরঞ্জিত গল্প ফেঁদে বস্তুত তাদের সাফল্যকেই ছোট করা হচ্ছে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধায় সহ দেশের বিরোধী নেতাদের অপরাধ তারা এই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সেই কারণেই তারা দেশদ্রোহী!
বিরোধী জোটের অন্যতম প্রধান নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, মোদি দেশের লজ্জা, তিনি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন তুলেছেন জঙ্গি হামলার আশঙ্কা নিয়ে গোয়েন্দাদের রিপোর্ট থাকা সত্ত্বেও কেন তা ঠেকানো গেল না? তার মতে মোদির এই মিথ্যাচারকে সমর্থন দিচ্ছে জাতীয় পর্যায়ের কয়েকটি নিউজ চ্যানেল। দেশের মানুষের কাছে প্রকৃত সত্যকে আড়াল করা হচ্ছে, এটা গণতন্ত্র নয়। তৃণমূল নেত্রী জানান, দেশবিরোধী বলে তাকে দেগে দিয়েও মোদিরা খুব একটা সুবিধা করতে পারবেন না। তিনি দেশের মানুষের পক্ষেই দাঁড়াবেন। দেশবাসীর কাছে প্রকৃত সত্যটাই তিনি তুলে ধরতে চান। এর জন্য তাকে শাস্তি দেওয়া হলেও দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে তিনি সত্যটা জানতে চাইবেন। তার মতে, জওয়ানরা রাজনীতি করেন না, কিন্তু তাদের রক্তের বিনিময়ে কেউ নির্বাচনে জেতার জন্য রাজনীতি করতে চাইলে তিনি তার প্রতিবাদ করবেন। কারণ তিনি দেশের পক্ষে, মানুষের পক্ষে, জনগণের পক্ষে কিন্তু মোদিবাবুর বিপক্ষে। বিরোধী দলনেত্রী বলেছেন, তিনি দাঙ্গার বিপক্ষে এবং শান্তির পক্ষে। কিন্তু দেশপ্রেমের নামে ঘৃণা ও সন্ত্রাসের রাজনীতির বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ জানাবেন।
জীবদ্দশায় অটলজীকে পাত্তা না দিলেও মোদি-অমিতরা নিজেদের ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়ানোর স্বার্থেই এখন কথায় কথায় অটলজীর উদাহরণ দেন। তাদের কে মনে করিয়ে দিই, পাক-ভারত যুদ্ধের সময় দেশের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দেশের সব বিরোধী দলকে ডেকে দেশের প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে জানিয়েছিলেন। গোপনীয়তা রক্ষার নামে কোন ভোটের রাজনীতি তিনি করেননি। ইন্দিরা এতটা উদারতা দেখিয়েছিলেন বলে অটলজী সহ সব বিরোধী নেতারা দেশের স্বার্থেই সেদিন তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। অথচ পুলওয়ামায় জঙ্গি সন্ত্রাসের প্রথম দিন থেকেই মোদি হাঁটছেন ঠিক উল্টো রাস্তায়। খোলাখুলি দেশবাসী ও বিরোধী দলগুলিকে সবকিছু জানানোর বদলে মোদি ক্রমাগত বিরোধী দলগুলিকে সেনাদের ও দেশবাসীর শত্রু বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন।
কোন প্রশ্ন, জিজ্ঞাসা, সংশয়, তর্ক, যুক্তির বদলে তারা চান শুধু নিঃশর্ত আনুগত্য। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তা করেন না বলে তার ওপর মোদি-অমিত অ্যান্ড কোং এর বিরাট রাগ। কিন্তু মোদিরা চাইলেও নিজেদের মনোমত এমন ভারত তারা কোনদিনই তৈরি করতে পারবেন না। আসমুদ্র হিমাচল তাদের কে তাড়া করে বেড়াবে একের পর এক প্রশ্ন। জওয়ানদের রক্তের বিনিময়ে মেকি দেশপ্রেমের যে রাজনীতি তারা করছেন সেই রাজনীতিই তাদের পতনের পথ প্রশস্ত করবে।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত